ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

ফিরে দেখা-২০১৪

খুন অপহরণ আর ধর্ষণের বছর

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪
খুন অপহরণ আর ধর্ষণের বছর ফাইল ফটো

চট্টগ্রাম: রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দমনের তাড়া না থাকায় মোটামুটি স্বস্তিতেই বছর কেটেছে চট্টগ্রাম নগর ‍পুলিশের। তবে পুলিশ স্বস্তিতে থাকলেও নগরীতে অপরাধের কমতি ছিলনা।



বরং চলতি সালের নভেম্বর পর্যন্ত সংঘটিত অপরাধ গত ১৪ বছরের রেকর্ড ভেঙ্গেছে। অপরাধ বিবেচনায় শেষ হতে যাওয়া বছরটি চট্টগ্রামবাসীর জন্য ‘খুন-অপহরণের’ বছর হিসেবেও পরিচিতি পেতে পারে বলে অভিমত নগরবাসীর।


র‌্যাবের বিরুদ্ধে মামলা করে আলোচিত ধনাঢ্য স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল ধরকে দিনে-দুপুরে অপহরণ, বাসায় ঢুকে মা-মেয়েকে কুপিয়ে হত্যা, ছিনতাইকারীর হাতে পুলিশ খুন হওয়া, দুই ছাত্রলীগ কর্মীকে খুন করে ম্যানহোলে ঢুকিয়ে রাখা, কোতয়ালি থানার সামনে স্বর্ণের দোকানে বোমা মেরে ডাকাতি, ফোর এইচ গ্রুপের ভল্ট ভেঙ্গে তিন কোটি টাকা চুরি কিংবা বছরের শেষদিকে দুই ভাইকে হত্যা-একটির পর একটি ছিল চাঞ্চল্যকর ঘটনা।

পুলিশ অধিকাংশ ঘটনা তদন্ত করে আসল রহস্য উদঘাটন এবং এর সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে পারলেও কিছু ঘটনা কিংবা জড়িতদের ধারেকাছেও ঘেষতে পারেনি। এর মধ্যে আছে মৃদুল ধরের অপহরণ রহস্য। এ ঘটনার সঙ্গে র‌্যাবের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় নগর পুলিশ এর কোন কূলকিনারা করতে পারছে না বলে মনে করেন সাধারণ মানুষ।

নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) বনজ কুমার মজুমদার বাংলানিউজকে বলেন, তুলনামূলকভাবে হিসাব করলে ২০১৪ সালে নগরবাসীকে আমরা অনেক বেশি স্বস্ত্বিতে রাখতে সক্ষম হয়েছি। মানুষ নিজেদের অনেক বেশি নিরাপদ বোধ করছেন এখন। তবে কিছু সামাজিক অপরাধ আমরা ঠেকাতে পারিনি যে ঠেকানো আদৌ সম্ভব নয়।

মৃদুল ধরকে অপহরণের তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্ত এখনও অব্যাহত আছে। তদন্ত শেষ হলে অভিযোগ পত্র দেয়া হবে।

রেকর্ড ভেঙ্গেছে এক বছরের অপরাধ
২০১৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত নগরীর ১৬ থানায় বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে ৪ হাজার ৮০৪টি মামলা রেকর্ড হয়েছে। ২০১৩ সালে রেকর্ড হয়েছিল ৪ হাজার ২৮৮টি মামলা।

২০১৪ সালে নগরীতে ১১১টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। ২৭৪টি চুরির ঘটনায় মামলা হয়েছে। ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৭০টি। অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ৪৮টি। চারটি ডাকাতি, ৫৫টি দস্যুতা, ৯০টি সিঁধেল চুরি, ১৫টি দাঙ্গা, ২টি দাঙ্গাসহ খুন এবং নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ২৯২টি। অস্ত্র আইনে মামলা হয়েছে ১১৩টি। ২ হাজার ২৬৩টি মাদক আইনে এবং ৪৯টি চোরাচালান আইনে মামলা হয়েছে।

২০১৪ সালে এর আগের বছরের তুলনায় খুনের ঘটনা বেড়েছে ১৯টি। অপহরণের ঘটনা বেড়েছে ৩১টি। ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে ২২টি। তবে এ বছর মাদক উদ্ধারে সাফল্যের পাল্লা ভারি ছিল নগর পুলিশের।

২০০১ সালে নগরীতে বিভিন্ন অপরাধে মামলা হয়েছিল এক হাজার ৫৮৭টি, ২০০২ সালে হয়েছিল এক হাজার ৭৭২টি, ২০০৩ সালে হয়েছিল ৩ হাজার ৮টি, ২০০৪ সালে হয়েছিল ৩ হাজার ৯৪টি, ২০০৫ সালে ২ হাজার ৫৮৯টি, ২০০৬ সালে ২ হাজার ৭১২টি, ২০০৭ সালে ৩ হাজার ৭৪৪টি, ২০০৮ সালে ৪ হাজার ৩৭৭টি, ২০০৯ সালে ৩ হাজার ৭৭৭টি, ২০১০ সালে ৪ হাজার ৬৩টি, ২০১১ সালে ৪ হাজার ১২৬টি এবং ২০১২ সালে ৪ হাজার ৬২০টি মামলা দায়ের হয়েছিল।

‘র‌্যাবের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলি কেন ?’
১১ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নগরীর পুরাতন টেলিগ্রাফ রোডে নিজ বাসার সামনে থেকে র‌্যাবের বিরুদ্ধে মামলা করে আলোচিত ধনাঢ্য স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরীকে তুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনার পর মৃদুল চৌধুরীর পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, জানুয়ারির মাঝামাঝিতে র‌্যাবের এক কর্মকর্তাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ৮০ ভরি স্বর্ণ লুটের একটি মামলা দায়ের করেন মৃদুল চৌধুরী। এ ঘটনার জের ধরে র‌্যাব তাকে অপহরণ করেছে বলে সন্দেহ করেন মৃদুলের স্ত্রী ও ভাই।

১৭ ফেব্রুয়ারি অপহরণকারিদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার পর মৃদুল ধর আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে জানায়, অপহরণকারিদের নির্যাতনের মুখে তিনি চিৎকার করে বলেন, স্যার আমার কি অপরাধ ? এসময় অপহরণকারীরা বলে, র‌্যাবের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলি কেন ? বেশি কথা বলবিনা। বেশি কথা বললে খবর আছে।

প্রেমিকের নৃশংসতার বলি মেয়ে, সঙ্গে মা-ও
২৪ মার্চ সকালে নগরীর ডবলমুরিং থানার আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকার ১৭ নম্বর সড়কে যমুনা নামে একটি ভবনের চতুর্থ তলায় জনৈক সিএন্ডএফ ব্যবসায়ীর স্ত্রী রেজিয়া বেগম (৫০) এবং মেয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী সায়মা নাজনীন নিশাতকে (১৬) পায়ের রগ কেটে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

এ ঘটনায় সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী মো.রেজাউল করিম বাদি হয়ে দু’জনকে আসামী করে একটি মামলা দায়ের করেন। আসামীরা হল, মেয়ে নিশাতের প্রেমিক আবু রায়হান এবং রায়হানের বন্ধু ও ভাড়াটে খুনি শহীদ।

২৬ মার্চ ভোরে রায়হানকে ঢাকার আরামবাগে একটি হোটেল থেকে এবং শহীদকে চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী থানার মাষ্টার লেন থেকে গ্রেফতার করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ।

২৫ মে এ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ডবলমুরিং থানার এস আই মাঈনউদ্দিন। অভিযোগপত্রে মেয়ের বন্ধু আবু রায়হান ওরফে আরজু (২১) এবং ভাড়াটে খুনি শহিদকে (২৫) আসামী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়।

৮ জুলাই আদালত দু’আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরুর আদেশ দেন। ৪ আগস্ট থেকে আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।   আদালত সূত্রে জানা গেছে, আট পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রে ৩৭ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। প্রেমে প্রত্যাখাত হয়ে প্রতিশোধ নিতে রায়হান খুনি শহীদকে ভাড়া করে দু’জনে খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।

খুন করে লাশ ম্যানহোলে
১৭ মার্চ সকাল ১১টার দিকে নগরীর খুলশী থানার ষোলশহর দু’নম্বর গেইট এলাকায় একটি সেপটিক ট্যাংক থেকে দুই বন্ধু কামরুল ও ফোরকানের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তারা উভয়ই নগরীর ওমরগণি এমইএস কলেজ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। কামরুল ইসলাম এমইএস কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আর ফোরকান সিইপিজেডে একটি কারখানায় কর্মরত ছিল।

এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় যুবলীগ নামধারী ৯ আসামির বিরুদ্ধে গত ১৪ ডিসেম্বর আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। অভিযুক্তরা হলেন, যুবলীগ নামধারী আবুল বশর, সাদ্দাম ওরফে ব্লেড বাচা, মো. শাহেদ, শাহ আলম, মো. জাহাঙ্গীর, মো. বাহার, আবদুল আলী ওরফে লেদু, নুর আলম ভুট্টো ও মো. হাছান। অভিযোগপত্রে বলা হয়, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি ও মারধরের প্রতিশোধকে কেন্দ্র করে দুই সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে বিরোধের জের ধরে ওই হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। আসামিরা গলায় রশি প্যাঁচিয়ে দুই যুবককে খুন করে। খুন করার পর ভুক্তভোগীদের হাত-পায়ের রগ কেটে দেয় আসামিরা। এরপর এদের লাশ গুমের উদ্দেশ্যে সেপটিক ট্যাংকে ফেলে দেয়া হয়।

ছিনতাইকারির হাতে প্রাণ গেল পুলিশ সদস্যের
১৪ জানুয়ারি রাতে নগরীর আগ্রাবাদ ব্যাংক কলোনি গেইটে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে পুলিশ সদস্য নায়েক ফরিদুল ইসলাম নিহত হন। এ ঘটনার পর পুলিশ ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে দু’জনকে গ্রেপ্তার করেন। পরে তারা ‘ক্রসফায়ারে’ মারা যান। ক্রসফায়ার শিকার দু’জনের স্বজনরা অভিযোগ করেন, পুলিশ মিথ্যা অভিযোগে দু’জনকে ধরে পরিকল্পিতভাবে খুন করেছে।

এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় ১৭ এপ্রিল আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন মামলার  তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ডবলমুরিং থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আতাউর রহমান খন্দকার। অভিযোগপত্রে আসামি করা হয় জসিম উদ্দিন রাজু, মাবুদ দুলাল, অর্জন দে ও মো. মনিরকে। মামলায় ৩১ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। মামলাটি বর্তমানে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর অপেক্ষায় আছে।

১২ অক্টোবর নগরীর খুলশিতে বেসরকারি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান গ্রুপ ফোরের কার্যালয় থেকে তিন কোটি টাকা চুরি করে ওই প্রতিষ্ঠানেরই এক কর্মী। একদিনের মাথায় গ্রেপ্তারের পর সে জানায়, গ্রুপ ফোরের কর্মকর্তাদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে এবং গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দিতে সে টাকাগুলো চুরি করেছে।

১৩ ডিসেম্বর নগরীর জিপিও’র সামনে গিণি গোল্ড জুয়েলার্স ও অপরুপা জুয়েলার্সে বোমা মেরে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এতে একজন নিহত ও কমপক্ষে ১২ জন আহত হয়। ডাকাতি শেষে পালিয়ে যাবার পথে নগরীর পাহাড়তলী থানায় পুলিশের চেকপোস্টে বাবুল আটক হয়। এরপর পুলিশ আরও চারজনকে আটক করে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে অপরাধী গ্রেপ্তার করতে পারায় পুলিশ মহাপরিদর্শকের পুরস্কারও জিতে নেয় কোতয়ালি ও পাহাড়তলি থানা।

গত ১৯ নভেম্বর রাতে নগরীর চান্দগাঁও এলাকায় কাঠের ব্যবসা নিয়ে খুন হন আবু সিদ্দিক (৪২) ও তার বড় ভাই ফরিদুল আলম (৪৫)।

নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) বনজ কুমার মজুমদার বাংলানিউজকে বলেন, চান্দগাঁওয়ে খুনের ঘটনার তদন্ত চলছে। স্বর্ণের দোকানে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সব ঘটনার তদন্ত নির্মোহভাবে শেষ করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অভিযোগপত্র দেয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৬৫৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।