ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

ফিরে দেখা-২০১৪

এনসিটি ইস্যুতে বছর জুড়েই উত্তপ্ত চট্টগ্রাম বন্দর

মো.মহিউদ্দিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪
এনসিটি ইস্যুতে বছর জুড়েই উত্তপ্ত চট্টগ্রাম বন্দর ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

চট্টগ্রাম: আট বছর আগে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়া চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল(এনসিটি) ইস্যুতে বছর জুড়েই উত্তপ্ত ছিল দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম বন্দর।

অভিযোগ রয়েছে, মন্ত্রণালয় ও বন্দর চেয়ারম্যান মিলে বিশেষ একটি প্রতিষ্ঠানকে অবৈধভাবে টার্মিনালটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার পাঁয়তারা করছেন।

এর বিরোধিতা করছেন আরেকটি পক্ষ। দুই পক্ষে বাক-বিতণ্ডা, সভা-সমাবেশ থেকে আন্দোলনে গড়িয়েছে।
এরপরও চালু হয়নি গুরুত্বপূর্ণ এই টার্মিনাল।  

সাইফ পাওয়ারটেক নামে ওই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে দরপত্রের শর্ত শিথিল করেছিল বন্দর কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগ রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে আন্দোলনে নামে শ্রমিক-কর্মচারীরা। পরে এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী।

মহিউদ্দিন চৌধুরী শ্রমিকদের পক্ষ নিলেও নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাহাজান খান ও চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান প্রতিষ্ঠানের পক্ষ নেন, কাজ দিতে যুক্তি তুলে ধরেন। বিভিন্ন সময়ে কৌশলে কাজ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে প্রতিবাদের মুখে পিছু হটতে হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন আওয়ামী লীগের দুই নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরী ও মন্ত্রী শাজাহান খান। এক সময় দু’জনের মধুর সম্পর্ক থাকলেও বন্দর নিয়ে বিরোধের জের ধরে সম্পর্ক তিক্ততায় রূপ নেয়।

জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে দু’জনের বিরোধ সুরাহা না হওয়ায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে রয়েছে সরকার ও দলের নেতা-কর্মীরা।

বন্দর উপদেষ্টা কমিটির অষ্টম বৈঠকে আলোচনায় বসার ইঙ্গিত দেন নৌ-মন্ত্রী। এরপর বন্দর চেয়ারম্যানের মাধ্যমে মহিউদ্দিন চৌধুরীর কাছে পত্র পাঠান। কিন্তু নবম বৈঠকে তিনি জানান, মহিউদ্দিন চৌধুরীর কিছু বিতর্কিত বক্তব্যের কারণে আলোচনায় বসা সম্ভব হয়নি।

সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডকে কাজ দিতে মন্ত্রী ও বন্দর চেয়ারম্যানের অনড় অবস্থানের কারণে চলতি বছরের ৫ আগস্ট জেলা পরিষদ মিলনায়তনে ডক বন্দর শ্রমিক-কর্মচারী পরিষদের মতবিনিময় সভায় প্রথমবারের মতো সাইফ পাওয়াটেক’র বিরুদ্ধে কথা বলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী।

এরপর ২৫ আগস্ট চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনের সংবাদ সম্মেলন করে সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড’র বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন।

সংবাদ সম্মেলনে বন্দর নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে অভিযোগ করে এ ষড়যন্ত্রের জন্য সাইফ পাওয়ারটেককে দায়ী করেন। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।

সাইফ পাওয়ারটেককে ‘মাফিয়া চক্র’ আখ্যা দিয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, একটি প্রতিষ্ঠান বন্দরকে কুক্ষিগত করে রাখতে পারে না। এই মাফিয়া চক্রের হাত থেকে বন্দরকে রক্ষা করতে চাই, বাঁচাতে চাই।  

সংবাদ সম্মেলন থেকে সাইফের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ১৫ দিনের সময় দেওয়া হয়। এছাড়া ২৭ আগস্ট বন্দর গেইটের দক্ষিণ পাশে শ্রমিক-জনতার সমাবেশ আহ্বান করা হয়। সেখানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মহিউদ্দিন চৌধুরী সাইফ পাওয়ারটেক’র অনিয়ম দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে বন্দর চেয়ারম্যানকে সতর্ক করেন।

এরপর ২৯ আগস্ট বন্দর রক্ষা পরিষদের আন্দোলন পর্যালোচনা সভায় ১০ সেপ্টেম্বর লালদীঘি মাঠে সমাবেশ করার ঘোষণা দেন মহিউদ্দিন। এছাড়া ১ থেকে ৩ সেপ্টেম্বর কালো ব্যাজ ধারণ ও ৭ সেপ্টেম্বর বন্দর ভবনের সামনে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনশন কর্মসূচি পালন করে।

সমাবেশে থেকে এক মাসের কর্মসূচি ঘোষণা করেন বন্দর রক্ষা পরিষদের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন। সমাবেশ থেকে সাইফের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ১৫ দিনের সময় দেওয়া হয়।

এদিকে বন্দরের বিদ্যমান সমস্যা ও চলমান আন্দোলন নিয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরীর কাছে আলোচনার প্রস্তাব দেন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। সেই প্রস্তাব গ্রহণ করে আলোচনায় বসার আগ্রহ প্রকাশ করে নৌমন্ত্রীকে চিঠি দেন বন্দর রক্ষা পরিষদের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন চৌধুরী।

২৫ অক্টোবর পাঠানো চিঠিতে মহিউদ্দিন চৌধুরী বিষয়টি জনসম্পৃক্ত হওয়ায় চট্টগ্রামের দুই মন্ত্রী গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এবং পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ চৌধুরীর উপস্থিতিতে আলোচনায় বসার কথা বলেছেন।

চিঠি পাওয়ার পর ৯ নভেম্বর বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে চিঠির জবাব দেন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রস্তাবটি মেনে নিয়ে বন্দরের উপদেষ্টা কমিটির পরবর্তী সভায় চট্টগ্রামের দুই মন্ত্রীর উপস্থিতিতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার কথা বলা হয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে পাঠানো ওই চিঠিতে।

গত ২৩ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বন্দর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বন্দর উপদেষ্টা কমিটির নবম বৈঠকে নৌ-মন্ত্রী বলেন, মহিউদ্দিন চৌধুরী এমন কিছু কথা বলেছেন যাতে আর আলোচনায় সভা সম্ভব হয়নি।

গত ১০ নভেম্বর চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মহিউদ্দিন অভিযোগ করেন, চট্টগ্রাম বন্দরের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে মন্ত্রী ও বন্দর চেয়ারম্যান টাকার ভাগ পান।

নৌ-মন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় মহিউদ্দিন চৌধুরী বন্দরের বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন। চট্টগ্রাম বন্দরের টাকায় পায়রা বন্দর নির্মাণের প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, এখানে প্রয়োজনীয় উন্নয়ন না করে আরেকটা বন্দর করা হয়েছে। এটা চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম বন্দর বিদ্বেষী মনোভাব থেকে করা হয়েছে।

সর্বশেষ গত ২৩ ডিসেম্বর বন্দর উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি টার্মিনাল চালুর দাবি জানিয়েছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। যে কোন মূল্যে এটি চালুর দাবি জানান, উপদেষ্টা কমিটির সংসদ সদস্য শামসুল হক।

এদিকে ১৬ ডিসেম্বর চুক্তি ভঙ্গের পরও সাইফ পাওয়াটেক লিমিটেড’র বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত। চার সপ্তাহের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। গত ১৪ ডিসেম্বর শুনানি শেষে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের গঠিত বেঞ্চ এ রুল জারি করেছেন।

ঢাকা কমলাপুর আইসিডি (ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো) কন্টেইনার হ্যান্ডলিং কাজে সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড চুক্তি ভঙ্গ এবং চুক্তি অনুযায়ী জরিমানা ও কালো তালিকাভুক্ত না করায় রুল জারি করা হয়।

মূলত চট্টগ্রাম বন্দর ঘিরে এই প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণেই এনসিটি টার্মিনাল চালু করা সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ব্যক্তিগত স্বার্থের কথা চিন্তা না করে দেশ ও বন্দরের উন্নয়নে দ্রুত এনসিটি চালুর দাবি জানিয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ সময়: ১৯২২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।