ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

ফিরে দেখা-২০১৪

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: খুনেই শুরু খুনেই শেষ

বিপ্লব পার্থ, চবি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: খুনেই শুরু খুনেই শেষ

চট্টগ্রাম : প্রথম ও শেষ মাসে খুন, আর পুরো বছর জুড়েই অস্থিরতা। এভাবেই কেটেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৪ সাল।

  তবে সহিংস ঘটনার মধ্যে ওয়াইফাই প্রযুক্তি সংযোজন, দুইটি হলের নির্মাণ কাজের অগ্রগতিসহ বিভিন্ন উদ্যোগ ছিল লক্ষ্যণীয়।

চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের এক নেতা সিলেটে নিজের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে হামলার শিকার হন।
এসময় তার পা ও হাতের রগ কেটে দেওয়া হলে এর জের ধরে পরদিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ-শিবিরের সংঘর্ষ বাঁধে। সংঘর্ষে নিহত হন শাহ আমানত হল শাখা শিবিরের সাধারণ সম্পাদক ও মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মামুন হোসাইন। এছাড়াও আহত হন উভয় সংগঠনের বেশ কিছু নেতাকর্মী।

এ ঘটনার পর ১২ জানুয়ারি রাতেই জরুরী সিন্ডিকেট বৈঠক ডেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য শাহ আমানত হল  বন্ধ ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

একইবছরের ৫ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড.আবু ইউচুফ আলম এর স্মরণ সভায় এসে ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক সংগঠন ভিএক্সের নেতাকর্মীদের হাতে লাঞ্চিত হন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাছির হায়দার বাবুল।   শুধু শারীরিকভাবে লাঞ্চিত নয়,বাবুলের গলায় জুতার মালাও পড়িয়ে দেয় তারা। এরপর শুরু হয় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ভিএক্স ও সিএফসির মধ্যে দ্বন্ধ। এরমধ্যে সাংগঠনিক গতি ফেরাতে ১০ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মী সমাবেশে আসেন ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগের নেতৃত্বে একটি টিম। কর্মী সম্মেলনে তিনি ছাত্রলীগের নামে সকল অপকর্ম থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান।

নাছির হায়দার বাবুলকে জুতার মালা দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকতে না পারা সিএফসির কর্মীরা নগরীতে সংবাদ সম্মেলন ও বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করতে থাকে।   নাছির হায়দার বাবুলকে জুতার মালা দেওয়ার ঘটনায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে ৭ মে থেকে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচীর ডাক দেয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ সভাপতি অমিত কুমার বসু ও যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক সুমন মামুনের নেতৃত্বে সিএফসির কর্মীরা।

সাতদিন অবরোধ চলাকালে অবরোধকারীরা শাটল ট্রেনের লোকো মাস্টারকে অপহরণ,শাটল ট্রেন চলাচল বন্ধ,ককটেল বিষ্ফোরণ,শাটল ট্রেনের হুস পাইপ কেটে দেওয়া,শিক্ষক বাস ভাংচুর,শিক্ষকবাসে সুপার গ্লুসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যায়। অবরোধে কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়। এ সময় অবরোধকারীদের প্রতিহত করার হুমকি দিয়ে মিছিল সমাবেশ করে ভিএক্স নেতাকর্মীরাও। সাতদিন অবরোধের পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আশ্বাসে অবরোধ কর্মসূচি স্থগিত করে সিএফসির কর্মীরা।

১০ জুন আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক সংগঠন ভার্সিটি এক্সপ্রেস(ভিএক্স) ও কনকর্ড।   দিনভর দফায় দফায় সংঘর্ষে উভয় গ্রুপের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী আহত হয়।   এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেইদিন রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সকল প্রকার কর্মকাণ্ড স্থগিত করে দেয়।

২৪ আগস্ট তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিবির নিয়ন্ত্রিত সোহারাওয়ার্দী হলের সামনে রাতে গোলাগুলিতে লিপ্ত হয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ও শিবিরের নেতাকর্মীরা। ওইদিন রাতে সোহরাওয়ার্দী হলে তল্লাশি চালিয়ে  উদ্ধার করা হয় পেট্রোল বোমাসহ বেশ কিছু দেশীয় অস্ত্র। পরদিন ওই হল থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগ করতে নির্দেশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।   এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সকল  হলে বৈধ শিক্ষার্থীদের তুলে দেওয়ার দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যনারে ৩১ আগস্ট থেকে লাগাতার ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেয় ইসলামী ছাত্র শিবির।

ধর্মঘট চলাকালে ১০ সেপ্টেম্বর হাটহাজারী ফতেয়াবাদ ছড়ারকুল এলাকায় শিক্ষকবাহী বোমা হামলা চালায় শিবিরের কর্মীরা। হামলায় ১২ শিক্ষকসহ প্রায় ১৭ জন গুরুতর আহত হন। ঘটনার পর দিন থেকে শিবির নিয়ন্ত্রিত এফ রহমান হল,আলাওল হল ও পাশ্ববর্তী কটেজে পুলিশ অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করে।

১৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন, সিন্ডিকেট, ফাইন্যান্স কমিটি ও একাডেমিক কাউন্সিল পর্ষদের বিভিন্ন শাখায় প্রতিনিধি নির্বাচন।

নির্বাচনে ১৮ পদের মধ্যে আওয়ামী-বামপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হলুদ প্যানেল থেকে ১৩টি, বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ সাদা প্যানেল থেকে ৩টি এবং স্বতন্ত্র থেকে ২টি পদে  প্রার্থীরা জয় লাভ করে।

এছাড়াও সেপ্টেম্বর মাসে ভিএক্স ও সিএফসির মধ্যে বেশ কয়েকবার রাতে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।

অস্থিরতা থাকলেও ২০১৪ সালে অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা। ভর্তি পরীক্ষায় প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার শিক্ষার্থী ফরম ক্রয় করেছিল। যা অতীতের সকল রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

নভেম্বরের শুরুতে আবার উত্তাল হয়ে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়। ৯ নভেম্বর পরীক্ষা দিয়ে ফেরার সময় হামলার শিকার হন সিএফসির কর্মী মিঠুন। এ ঘটনার জের ধরে পরদিন থেকে অবরোধের ডাক দেয় সিএফসির কর্মীরা। এতে অচল হয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়। এ ব্যাপারে ১২ নভেম্বর চট্টগ্রামে একটি অনুষ্ঠানে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর উপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা পরিবর্তনে নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে নির্দেশ দিয়ে যান । প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর ১৫ নভেম্বর নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসায় বৈঠকে বসেন ছাত্রলীগের বিবাধমান দু গ্রুপ ভিএক্স ও সিএফসি।   বৈঠকে উভয় গ্রুপের মধ্যে সকল প্রকার দ্বন্ধ ভুলে গিয়ে ক্যাম্পাসে একসাথে অবস্থানের ঘোষনা দেন উভয় গ্র“পের নেতারা।

পরদিন ১৬ নভেম্বর ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে দীর্ঘদিন বাইরে থাকা সিএফসির কর্মীরা। তাদের জন্য ১৯ নভেম্বর খুলে দেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্ববৃহত হল শাহ আমানত। শাহ আমানত হলে উঠার পর থেকে ভিএক্স ও সিএফসির মধ্যে নিরব কোন্দল চলে আসছিল। এ কোন্দলের প্রতিফলন ঘটে ১৪ ডিসেম্বর। শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবসে ফুল দিয়ে হলে ফিরে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় ছাত্রলীগের দু গ্র“প ভিএক্স ও সিএফসি। সংঘর্ষ চলাকালে পিস্তলের গুলিতে নিহত হন সংস্কৃত বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তাপস সরকার।

সংঘর্ষের দিন শাহজালাল হলে তল্লাশি চালিয়ে অস্ত্রসহ আটক করা হয় ২৭ ছাত্রলীগ কর্মীকে। এরপর থেকে ক্যাম্পাস ছাড়া হয় দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসে আধিপত্য করা ভিএক্স।

২০১৪ সালে রাজনৈতিক সহিংসতা ও ছাত্রসংগঠন গুলোর আভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে দীর্ঘদিন অচল ছিল বিশ্ববিদ্যালয়।   এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে নতুন করে দেখা দেয় সেশন জট।

এছাড়াও ২০১৪ সালে বিভিন্ন ঘটনায় প্রায় ৩৫জন শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এতসব সংঘর্ষের ঘটনা থাকলেও সাফল্যও কম নয় বিশ্ববিদ্যালয়ের।

শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধু হল হলের নির্মাণ কাজের অগ্রগতি, আইন অনুষদ ভবনের  কাজ সম্পন্ন করা, নববর্ষ পালন, ওয়াই ফাই সংযোগের মাধ্যমে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল লক্ষ্যণীয়। তবে বছরের শেষের দিকে এসে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সকল প্রকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড,মিছিল সমাবেশ নিষিদ্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

হিংসাদগ্ধ-অন্ধকূপের কুটিল রাত ডিঙিয়ে, জিজ্ঞাসার শ্বাপদ স্তুপ মাড়িয়ে, ঘৃণার পিচ্ছিল নর্দমা ছেড়ে গত বছরের সফলতাগুলোকে এগিয়ে নিয়ে এবং সকল জরা-জীর্ণতাকে এড়িয়ে নতুন  বছরে আরো সমৃদ্ধ হবে বিশ্ববিদ্যালয়- এমন প্রত্যাশা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের।

বাংলাদেশ সময়: ২০৪১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।