চট্টগ্রাম: কর্মব্যস্ত জীবনের অবসাদ দূর করতে চলচ্চিত্র অনন্য এক মাধ্যম। মানুষের চিন্তাধারা বিকাশের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি।
চট্টগ্রামে হলমুখী দর্শকের অভাবে বন্ধ হতে চলেছে সিনেমা হলগুলো।
মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের পরিচালিত আলমাস সিনেমা হল ছাড়া দিনার, সিনেমা প্যালেস, পূরবী, ঝুমুর, নূপূর সিনেমা হলগুলো এখন ধুঁকে ধুঁকে চলছে। একমাত্র আলমাস সিনেমা হল ঐতিহ্য ধরে রেখে এখনও পর্যন্ত নিয়মিত হারে বাণিজ্যিক ও ভিন্নধারার চলচ্চিত্র প্রর্দশিত হচ্ছে। আলমাসের বিরুদ্ধেও অশ্লীল চলচ্চিত্র প্রর্দশন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, স্যানিটেশন সমস্যা, ভাঙা সিট সমস্যার অভিযোগ রয়েছে।
চট্টগ্রামে ১৯২৭ সালে প্রথম লায়ন সিনেমা হল নির্মাণের পর রঙ্গম, সিনেমা প্যালেস এবং ষাট দশকের শেষভাগে প্রথম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আলমাস সিনেমা হল চালু হয়। সেসময়ের প্রধান সিনেমা হলগুলো ছিল নূপূর, জলসা, আলমাস,দিনার,উপহার,ঝুমুর,মেলোডি,লায়ন,পূরবী,উজালা,
বনানী,সাগরিকা,সানাই,কর্ণফুলী,আকাশ,মহল,অলংকার,সংগীত,গুলশান ও রিদম। এছাড়া নৌবাহিনীর সিনেমা হল,বন্দরের নেভি হল,পতেঙ্গায় বিমান বাহিনীর নিয়ন্ত্রনাধীন শাহীন হল,হালিশহরে বিডিআর হল এবং চট্টগ্রাম সেনাবাহিনীর গ্যারিসন সিনেমা হলে একসময় নিয়মিত চলচ্চিত্র প্রর্দশিত হত।
পাকিস্তান আমলেও লাইন ধরে টিকেট কেটে চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ মর্ণিং,ম্যাটিনি,নাইট শো দেখত। পুরো পরিবার নিয়ে হলভর্তি দর্শকে মুখর থাকত। ৯০ দশকের গোড়ায় এসে টেলিভিশনের পর্দায় সিনেমার চল হওয়ায় হলমুখী দর্শকের সংখ্যা কমে যেতে থাকে।
বাংলানিউজের সরেজমিন পর্যবেক্ষণে পূরবী, সিনেমা প্যালেস ও আলমাস সিনেমা হলে দেখা যায় হলের বাইরের দেয়াল জুড়ে এ সপ্তাহের চলতি সিনেমা যথাক্রমে জিরো টু টপ হিরো, হিটম্যান, প্রেম করবো তোমার সাথে সিনেমার পোস্টার সাঁটানো। তিনটি সিনেমা হলেরই একপাশে চায়ের টং, খাবারের দোকানের রমরমা ব্যবসা। কিন্তু কোনো সিনেমা হলে হাতে গোনা দশজন দর্শকও নেই। খাঁ খাঁ করছে পুরো হল প্রাঙ্গণ।
দর্শকের বদলে দেখা গেল শুধু সিনেমার পোস্টার দেখতে আসা ভাসমান মানুষ। হলের ভেতরে পর্যাপ্ত সিট থাকলেও তা ভাঙাচোড়া, ফোম উঠে গেছে। নেই দর্শকের জন্য স্বাস্থ্যকর টয়লেটের ব্যবস্থা। টিকেট চেকাররা হলে আসা যুগলদের ডেকে বক্স কেবিন দেখিয়ে দিচ্ছে। বেশিরভাগ দর্শকই শ্রমজীবী শ্রেণীর।
হলগুলোতে মালিক কিংবা ম্যানেজারের দেখা পাওয়া যায়নি। হল মালিকের নাম্বার দিতেও অস্বীকৃতি জানায় উপস্থিত কর্মচারীরা। নাম্বার পাওয়ার পর দীর্ঘসময় যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া গেল না মালিককে।
পূরবী সিনেমা হলের টিকেট কাউন্টারের কর্মকর্তারা জানায়, দিনভর দর্শকের আনাগোনা নেই বললেই চলে। সারা মাসে ৬ থেকে ৭হাজার টাকা যে লাভ হয় তা তাদের বেতনেই চলে যায়।
একই কথা জানায় সিনেমা প্যালেসের ম্যানেজার। তিনি বলেন,ঈদের মৌসুমেও তেমন লাভ হয়না। ঈদে সবাই বাড়িতে চলে যায়,টিভিতেই সিনেমা দেখে।
আলমাস হলে সিনেমা চলাকালীন দেখা গেছে পর্দায় নায়িকার সংলাপের দৃশ্যে লেজার লাইট ফেলা হচ্ছে। নায়িকার বা নায়কের বিশেষ সংলাপে কিছু দর্শক কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ছুঁড়ে দিচ্ছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়,ভাল সিনেমা মুক্তি পেলেই হলে সিনেমা দেখতে যান তারা। বিবিএ তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুতনুকা সায়ন্তী টুপুর,আইন বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী সিদরাতুল মুনতাহা তৃণা বাংলানিউজকে জানান,বন্ধুরা মিলে সিনেমা হলে যাওয়ার মজাই আলাদা। মনপুরা,তারকাটা,চোরাবালি,নিঃসার্থ ভালবাসা,থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার,টেলিভিশন সিনেমাগুলো আমরা হলে দেখেছি। কিন্তু অন্যান্য সিনেমাগুলোর কাহিনী,উপস্থাপনায় কোনো ভিন্নতা নেই।
তারা অভিযোগের সুরে বলেন,হলে কোনরকম নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় একা যাওয়া যায়না। সিটগুলোও আরামদায়ক নয়। আলমাস সিনেমা হলে তাও যাওয়া যায়। অন্যান্য সিনেমা হলে সেই পরিবেশও নেই। আলমাসেরও আধুনিকায়ন প্রয়োজন।
চট্টগ্রামের দর্শকরা হলমুখী না হওয়ার প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের সংস্কৃতিকর্মী ও চলচ্চিত্রবোদ্ধারা বাংলানিউজকে জানান,সরকারের যথোপযুক্ত উদ্যোগে আধুনিক সুবিধা সম্বলিত সিনেপ্লেক্স নির্মাণ,হল মালিকদের সদিচ্ছা ও বাংলা চলচ্চিত্র সম্পর্কে ইতিবাচক প্রচারণা চট্টগ্রামের সিনেমা হলের সুদিন ফিরিয়ে আনতে পারবে।
চট্টগ্রামে প্রবীণ নাট্যজন প্রদীপ দেওয়ানজী বাংলানিউজকে জানান,এটি একটা ত্রিপক্ষীয় বিষয়। সরকার,হল মালিক কর্তৃপক্ষ এবং চলচ্চিত্র নিমার্তারা মিলেই এ সমস্যার সমাধান করতে পারবে। চট্টগ্রামের জন্য পর্যাপ্ত উদ্যোগের অভাব আছে,যে কারণে সব পক্ষের সুনজর প্রয়োজন। ভাল নির্মাতার অভাব নেই,অভাব পর্যাপ্ত সরকারী উদ্যোগের।
শিল্পপতিদের ভূমিকাও এখানে অনস্বীকার্য বলে মনে করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে একমত পোষণ করে চট্টগ্রাম থিয়েটার ইনস্টিটিউটের কালচারাল ডিরেক্টর ও নাট্যশিল্পী আহমেদ ইকবাল হায়দার বাংলানিউজকে বলেন,চট্টগ্রামে শিল্পপতিরা বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করছে। তারা সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসলে চট্টগ্রামে একটি আধুনিক প্রযুক্তির সিনেপ্লেক্স নিমার্ণ কঠিন কিছু নয়। পতেঙ্গাস্থ বাটারফ্লাই পার্কের উদাহরণ দিয়ে তিনি তরুণ শিল্পপতিদের এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান।
চট্টগ্রাম মেডিকেলের ইন্টার্ন ডাক্তার অমি দেব ও চবির ফিন্যান্স বিভাগ থেকে সদ্য পাস করা শিক্ষার্থী অনুপ ব্যানার্জী বলেন, সিনেমা হলের চেয়ে টিআইসি,শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজিত ফিল্ম ফেস্টিভ্যালগুলোতে চলচ্চিত্র দেখা আরামদায়ক। তিনি জানান, তিনি কখনও সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেননি।
সিনেমা হলে যাওয়া হয়নি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন,ভাল ছবি খুব কমই নির্মাণ হয়। দেখার মতো কাহিনী পাইনি বলে দেখা হয়না।
সম্প্রতি টিআইসিতে সিনেমা হলের পরিবর্তে বিকল্প প্রর্দশনীর ব্যবস্থা হিসেবে দুইটি বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী পরিচালিত পিপঁড়াবিদ্যা ও চলচ্চিত্র নির্মাতা সানিয়াত হোসেন নির্মিত শখ-নিলয় জুটির অল্প অল্প প্রেমের গল্প চলচ্চিত্র দুটি মুক্তির পর ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পায়।
হলে মুক্তি না পেয়ে মিলনায়তনে মুক্তি পাওয়ার কারণ জানতে চাইলে টিআইসির কালচারাল ডিরেক্টর আহমেদ ইকবাল হায়দার বলেন,হল মালিকদের আগ্রহ এখানে একটি বড় বিষয়। তাদের সদিচ্ছার অভাবে অনেক ভাল ভাল সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়না। টিআইসি সিনেপ্লেক্সের চাহিদা কিছুটা পূরণ করতে পেরেছে বলে হয়তো এখানে মানসম্মত চলচ্চিত্র প্রর্দশিত হচ্ছে।
সিনেমায় পুরোনো ধারণা চলে গেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন,নায়ক,নায়িকা নির্বাচন থেকে শুরু করে পোশাক,সিনেমার লোকেশন,অ্যাকশন সিকুয়েন্স সবকিছুতেই নতুনত্ব এসেছে। প্রেক্ষাগৃহের উন্নতি না হওয়া এবং চলচ্চিত্র নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণার কারণে সাধারণ মানুষ ভয়েই হলবিমুখ হয়ে পড়েছে।
চট্টগ্রামের দর্শককে হলমুখী করা এবং চলচ্চিত্রবান্ধব সংস্কৃতি তৈরির লক্ষ্যে চলচ্চিত্র সংসদের মাধ্যমে ১৯৭২ সালে অধ্যাপক আবুল ফজলের সভাপতিত্বে ঢাকার বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদের শাখা হিসেবে চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদ গঠিত হয়। ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদ ঢাকার শর্ট ফিল্ম ফোরামের সাথে যৌথভাবে আয়োজন করে দ্বিতীয় জাতীয় স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসব। আশির দশকে নির্মিত বিশ্ববিখ্যাত সব স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রগুলো প্রর্দশন ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র কেন্দ্র(সিএফসি)১৯৯৩ সাল থেকে চলচ্চিত্র আন্দোলনের সাথে জড়িত।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সিএফসি নিয়মিতভাবে দেশি,বিদেশি চলচ্চিত্র প্রর্দশনী,ডকুমেন্টারি ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রর্দশন,কর্মশালা আয়োজন,চলচ্চিত্র বিষয়ক ম্যাগাজিন প্রকাশিত করছে। এ আন্দোলনে সম্প্রতি যোগ হয়েছে আরো একটি নাম,ফিল্ম মেকারস গিল্ড। রফিকুল আনোয়ার রাসেলের পরিচালনায় চলতি বছরের ২০ জুন গিল্ডের ১০জন সদস্যের নির্মিত ১০টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নিয়ে একটি প্রর্দশনী করে তাদের চলচ্চিত্র আন্দোলনের সূচনা করে।
সিএফসির পরিচালক শৈবাল চৌধুরী বলেন,ঢাকার পর খুলনাতেও সিনেপ্লেক্স নির্মাণ হয়েছে,কিন্তু বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম এখনও পিছিয়ে আছে।
তার মতে সুস্থ প্রতিযোগিতা না থাকায় ভাল চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছেনা। সুস্থ পরিবেশ না থাকায় প্রেক্ষাগৃহে দর্শক যাচ্ছেনা।
প্রেক্ষাগৃহের পরিবেশ বিষয়ে ফিল্ম মেকারস গিল্ডের পরিচালক রফিকুল আনোয়ার রাসেল বাংলানিউজকে বলেন,মধ্যবিত্ত শ্রেনী সামাজিক নিরাপত্তা চায়। দর্শকের কমফোর্টের কথা বিবেচনা করে ভাল চলচ্চিত্রের পাশাপাশি ভাল সিনেপ্লেক্স নির্মাণ তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজন।
তিনি বলেন,বই পড়া,গান শোনার মত আমাদের সংস্কৃতিতে চলচ্চিত্রের প্রভাব কমে গেছে। চট্টগ্রামের হলগুলোর দ্রুত আধুনিকায়ন না হলে এ শিল্প ধ্বংসের মুখে পড়বে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৬ ঘন্টা,ডিসেম্বর ৩১,২০১৪