চট্টগ্রাম: ২০১৪ সালের জানুয়ারি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভর্তি পরীক্ষা দিতে দামপাড়া থেকে রাত সাড়ে ১০টায় বাসে উঠেছিলেন নাহিদা সরওয়ার নিভা।
শুধু কি নিভা। পরীক্ষা, চাকরির সাক্ষাৎকার, অফিসের জরুরি মিটিং, মধ্যপ্রাচ্যের ফ্লাইট কত কিছুই না মিস করেছেন এ জনপদের মানুষ। ঢাকা কত দূর? এ প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে কত সদর দপ্তর, অধিদপ্তর, প্রধান কার্যালয়, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, শিল্প-কারখানা, বিনিয়োগ রাতারাতি পাততাড়ি গুটিয়েছে।
বর্তমানে নিভা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি পড়ছে। নিভা-নিশা এখনো নিয়মিত ঢাকা যায়। চট্টগ্রাম আসে। তবে এখন সেই যানজট আর দুর্ভোগ পোহাতে হয় না। বদলে গেছে দেশের লাইফ-লাইন খ্যাত ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক’। চার লেনের সুফল পাচ্ছেন মানুষ। সাঁ সাঁ ছুটছে গাড়ি।
থোকা থোকা সবুজ দুপাশে। চোখের পলকেই মাইল পার! দূরত্ব যেমন কমছে তেমনি দুর্ঘটনাও। খুশি গাড়ি চালক, যাত্রীরা। খুশি পেশাজীবী থেকে শুরু করে শিল্পোদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারীরাও।
চার লেন প্রকল্পের মাঝখানে যে ডিভাইডার তার প্রশস্ততা ৫ মিটারের মতো। যেটি হয়তো ফুল আর পাতাবাহারে নয়নাভিরাম হয়ে উঠবে। একপাশে ৯ দশমিক ৩ মিটার সড়কের দুই লেনে একমুখী গাড়ি চলাচল করছে। ফলে বিপরীতমুখী গাড়ির ডিভাইডার পেরিয়ে এপাশে আসার সুযোগ নেই।
মঙ্গলবার (৫ জানুয়ারি)। সকাল সাতটায় কুমিল্লা বার্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো মাইক্রোবাস। চালক রণজিতের মোবাইল বাজলো। ফোন রিসিভ করেই বললেন, ‘আমরা এখন গরিবউল্লা শাহের (র.) মাজার পেরোচ্ছি। ’ ২২ মিনিট পর আবার ফোন এলো। যথারীতি গাড়ি থামিয়ে রিসিভ করলেন।
বললেন, ‘আমরা এখন সীতাকুণ্ড পেরোচ্ছি। ’ অপরপ্রান্তে বিস্ময়। তাকে বললেন, ‘এ কি করে সম্ভব! এত তাড়াতাড়ি এতটা পথ পাড়ি দিলি কেমনে!’
বিস্ময় রণজিতের চোখেমুখেও। রবির গান ‘গ্রামছাড়া ওই রাঙামাটির পথ আমার মন ভুলায় রে’র ভলিয়ুম ছোট করে দিলেন। বললেন, একটা সময় ছিল এ সড়কে ভাড়া নেওয়াই বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট। পদে পদে হার্ড ব্রেক। মোড়ে মোড়ে বিপদ। খানাখন্দ, ভাঙা সড়ক। ডাকাতের উপদ্রব। ওষ্ঠাগত প্রাণ। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চিরচেনা সেই দৃশ্য বদলে গেছে। স্বপ্নের চেয়েও বেশি প্রাপ্তি এ সড়কে। ’
কথায় কথা বাড়ে। বললেন, এমন দিনও গেছে এ সড়কেই রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা কাটাতে হয়েছে। এখন মধ্যপ্রাচ্যের মতো মনে হয় স্টিয়ারিং ধরলে। হুট করে কোনো গাড়ি সামনে পড়ার আশঙ্কা নেই। বড়জোর পেছন দিকে টোকা লাগাতে পারে।
চট্টগ্রাম অংশের কাজ প্রায় সম্পন্ন। বাকি আছে সড়কের ওপর মার্কিং করা এবং ট্রাফিক সিগন্যাল লাগানো। ফেনীর মহিপালে চলছে ফ্লাইওভার নির্মাণের মহোৎসব। ফলে এখানটায় চৌদ্দগ্রামের আগপর্যন্ত কিছুটা যানজট এখনো আছে। এরপর ঢাকা পর্যন্ত প্রায় নির্বিঘ্নে চলছে গাড়ি।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন উন্নীতকরণ প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক অরুণ আলো চাকমা দেখভাল করছেন চট্টগ্রাম অংশের ৬৬ দশমিক ৩ কিলোমিটার। বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ঢাকা পর্যন্ত ১৯২ কিলোমিটার চার লেন প্রকল্পের ৯০ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। চট্টগ্রাম অংশে রোড প্যাকেজে ৯টি সেতু, ১১১টি কালভার্ট, জোড়-আমতল ও বারআউলিয়া বাইপাসের কাজ শেষ। ফেনী-চট্টগ্রাম সীমান্তের ধুমঘাট সেতুও হয়ে গেছে। সলিমপুরে রেলওয়ে ওভারপাসের ডেক স্লাব (ওপরের অংশ) তৈরির কাজ চলছে, এক সপ্তাহে শেষ হবে।
পুরো প্রকল্পটি প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার উল্লেখ করে তিনি জানান, তাহের ব্রাদার্স লিমিটেড, সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড ও রেজা কনস্ট্রাকশন বিভিন্ন প্যাকেজে চট্টগ্রাম অংশের কাজ করছে। অন্য সময় বৃষ্টি, বন্যার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হলেও এখন সেই সমস্যা নেই। অর্থ ও রসদ দুটোর জোগানও পর্যাপ্ত। আশা করা হচ্ছে মার্চের মধ্যে শতভাগ কাজ শেষ হবে।
আন্তঃজিলা মালামাল পরিবহন সংস্থা ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সভাপতি মুনির আহমদ বাংলানিউজকে জানালেন, স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের দাবি ছিল এ মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করার। সরকার আমাদের স্বপ্নটি পূরণ করেছেন। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন না হলেও এখন সুফল মিলছে চার লেনের। ফলে গাড়িভাড়াও কমে গেছে। আগে যেখানে ১৫ টনের ট্রাক ভাড়া নেওয়া হতো ১৭-১৮ হাজার টাকা, এখন তা ১৪ হাজার টাকায় নেমে এসেছে। কাভার্ডভ্যান ভাড়াও সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছে। এর ফলে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকেরা উপকৃত হচ্ছেন।
চট্টগ্রাম জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের মহাসচিব আবুল কালাম আজাদ বলেন, রাস্তা যখন ছোট ছিল, খানাখন্দে ভরা ছিল তখন আমাদের টায়ার টিউব টিকতো না। ঘন ঘন যন্ত্রাংশ বিকল হতো। মেরামত খরচ বেশি পড়তো। এখন চার লেনের কাজ প্রায় শেষ হওয়াতে ওই খাতে ব্যয়ের হিসাব ছোট হচ্ছে। সাড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টায় ঢাকা পৌঁছানো যাচ্ছে। আগে তো অনিশ্চিত যাত্রা ছিল।
তিনি মনে করেন, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার আন্তরিকতা ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নজরদারি আর তাগাদার কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার লেনের মহাযজ্ঞ বাস্তবায়ন হয়েছে। যার সুফল পাবে পুরো দেশ।
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর পোর্ট অ্যান্ড শিপিং স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনের সুফল ইতিমধ্যেই আমরা পেতে শুরু করেছি। পণ্য পরিবহনে সময় ও অর্থ দুটোই সাশ্রয় হচ্ছে। পুরোপুরি সুফল পেলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে দৃশ্যমান পরিবর্তন আসবে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সহসভাপতি, চিটাগাং চেম্বার ও পোর্ট ইউজার্স ফোরামের সভাপতি মাহবুবুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, সরকারের যুগান্তকারী উদ্যোগ ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্প। ইতিমধ্যে মানুষ চার লেনের সুফল পেতে শুরু করেছে। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে বিনিয়োগ, উৎপাদন, পর্যটনসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে।
তিনি বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে দেশের সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে সারা দেশের সেতুবন্ধন রচনা করছে সড়কটি। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার সঙ্গে তাল মেলাতে হলে যত দ্রুত সম্ভব দেশের লাইফলাইন খ্যাত এ মহাসড়ককে আট লেনে উন্নীত করতে হবে। চালু করতে হবে এক্সপ্রেস ওয়ে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৭, ২০১৬
এআর/টিসি