চট্টগ্রাম: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্পিরিচুয়াল পাওয়ার ছিল উল্লেখ করে কমোডর এডব্লিউ চৌধুরী বীর উত্তম, বীর বিক্রম বলেছেন, স্পিরিচুয়াল পাওয়ার বা রুহানি শক্তির কারণেই সাতই মার্চের ভাষণ আমাকে ফ্রান্সে, সাবমেরিনের মধ্যেই আকৃষ্ট করেছিল।
ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এডব্লিউ চৌধুরী এসব কথা বলেন।
শুক্রবার (৩০ ডিসেম্বর) প্রেসক্লাবের ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের উদ্বোধন করেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন।
এডব্লিউ চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের অপারেশন জ্যাকপট চট্টগ্রামের মাটিতেই সফলতা পেয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ঘটনাবলি উল্লেখ করে তিনি বলেন, পঁচিশে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ট্যাংক চালিয়ে পাকিস্তান জঘন্য অপরাধ করেছিল। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রতারণা করেছে তারা। আমরা যুদ্ধ করে সেই পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছি। পৃথিবীতে ইউনিফর্মে আত্মসমর্পণ জঘন্যতম কলঙ্কের বিষয়।
এডব্লিউ চৌধুরী আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, পাকিস্তানি যে সাবমেরিনে আমি চাকরি নিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের শুরুর সময় সেটি ফ্রান্সে ছিল। ১০ জনকে নিয়ে দেশের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। একজন অজুহাত তুলে পালাল। নয়জন থাকল দলে। এর মধ্যে সিলেটের একজন ইংল্যান্ড চলে গেল। রইলাম আটজন। জেনেভা, বার্সেলোনা হয়ে, রোমে ১০ ঘণ্টার দীর্ঘ যাত্রাবিরতি শেষে ভারতের রাজনৈতিক আশ্রয়ে বম্বে উড়ে এলাম।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ মানুষের জীবনে বারবার আসে না। অপারেশন জ্যাকপটের জন্য ভারতে ৩০০ ছেলেকে ট্রেনিং দেওয়া হয়। এসবই হতো ১০ নম্বর সেক্টরের অধীন। তবে খুবই সিক্রেট। যমুনা নদীর তীরে, কুতুবমিনারে আমাদের আটজন সাবমেরিনারের আলাদা ট্রেনিং হতো। মিত্রবাহিনীর টার্গেট ছিল আগস্টে জাহাজে আক্রমণ করা। একটি জাহাজে তিনটি করে ম্যাগনেটিক মাইন লাগানো হবে ছয় ফুট পানির নিচে।
এডব্লিউ চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রামের ডা. শাহ আলম ছিল আমাদের ডেপুটি লিডার। সে সাঁতার জানত না। আমি ভাগিরথী নদীতে তার পেটের তলে হাত রেখে সাঁতার শিখিয়েছি। আমরা ৬০ জন কমান্ডো নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হই। প্রথমে ট্রাকে চড়ে কলকাতা। সেখান থেকে বিমানে আগরতলা। তারপর হরিণা ক্যাম্প হয়ে বাংলাদেশে। বিমানে ওঠার পর জেনারেল অরোরা আমার কাঁধে হাত দিয়ে জানতে চাইলেন অপারেশন কোন দিন হবে জানি কিনা। আমি বিস্ময় প্রকাশ করি। তখন তিনি বললেন ‘মে বি ফিফটিন’। এর আগে আমাকে দুটি গান নিয়মিত শোনানো হতো ট্রানজিস্টারে ‘আমি তোমায় শুনিয়েছিলাম’ ও ‘আমার পুতুল আজকে যাবে শ্বশুর বাড়ি’। ওই গান দুটিই ছিল আমাদের অপারেশনের প্রস্তুতি ও শুরুর সংকেত।
তিনি বলেন, এখানে তিনজন নৌকমান্ডো উপস্থিত আছেন। নুরুল হক, জিলানি আর আনোয়ার। আমাদের কেউ বলেনি, অপারেশন শেষে তোমরা আবার ফেরত আসবে। খরচের খাতায় রেখে দেওয়া হয়েছিল আমাদের। ওই যে কথায় বলে ‘বলির পাঁঠা’ সেই রকম আরকি। তারপরও আমরা উত্তেজিত ছিলাম যুদ্ধের জন্য। দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য। বাংলাদেশে ঢোকার আগে একদিন আ স ম আবদুর রব জঙ্গলে নিয়ে গেলেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন মনি ভাইয়ের সঙ্গে। মেজর রফিক সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। উনার সঙ্গে দেখা হয়েছে পরে।
এ ডব্লিউ চৌধুরী বলেন, আমাদের ৬০ জনের কাছে ছিল একটি করে ডেটোনেটর ও লিমপেট মাইন্ড। কিছু স্টেনগান আর গ্রেনেড। চট্টগ্রামবাসীর সহায়তায় বিশেষ করে এসএম ইউসুফ, মৌলভী সৈয়দ, হারিছ, মঈনুদ্দিন খান বাদল, ইঞ্জিনিয়ার আজিজ ও মতিন প্রমুখের সহায়তায় আমরা সফল অপারেশন করেছি। যারা আমাদের গোলাবারুদ বয়ে এনেছে তাদের আনপ্যারালাল কৃতিত্ব রয়েছে। আমার বডিগার্ড ছিল খুরশীদ। অপারেশন শুরুর আগে তাকে আমার পিস্তল দিয়ে বলেছিলাম, ধরা পড়লে সে যেন শ্যুট করে দেয়। আমাদের সৌভাগ্য আমরা কর্ণফুলীর প্রবল স্রোত উপেক্ষা করে ১৪ আগস্ট রাত ১২টায় ঝাঁপিয়ে পড়ি। ৩৩ জন ১১টি জাহাজে মাইন লাগিয়ে দিই। নিরাপদে ফিরেও আসি। ফেরার সময় চাইনিজ রাইফেলের বুলেট আমার কানের পাশ দিয়ে চলে যেতে দেখি।
প্রেসক্লাবের সভাপতি কলিম সরওয়ারের সভাপতিত্বে সম্মেলনের উদ্বোধন পর্বে স্বাগত বক্তব্য দেন সাধারণ সম্পাদক মহসিন চৌধুরী। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সহসভাপতি শহীদ উল আলম ও চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিইউজে) সভাপতি রিয়াজ হায়দার চৌধুরী।
অনুষ্ঠানে আবৃত্তিশিল্পী ফারুক তাহেরের নির্দেশনায় বৃন্দ আবৃত্তি পরিবেশন করে প্রেসক্লাব সদস্যের সন্তানরা। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন যুগ্ম সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ। পরে অতিথিরা প্রেসক্লাবে বঙ্গবন্ধু বহুমাত্রিক হলের উদ্বোধন করেন।
বিকেলে সাংগঠনিক অধিবেশন এবং শনিবার (৩১ ডিসেম্বর) দ্বিবার্ষিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এবার ১৫ পদে ৩৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৬
এআর/আইএসএ/টিসি