ঢাকা, সোমবার, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ মে ২০২৪, ০৪ জিলকদ ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

রোহিঙ্গাভাষা-চট্টগ্রামের ভাষার কতটুকু মিল-অমিল?

তাসনীম হাসান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৩৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৭
রোহিঙ্গাভাষা-চট্টগ্রামের ভাষার কতটুকু মিল-অমিল? মানচিত্র

চট্টগ্রাম: চলতি বছরের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহের কথা। উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে ঢুকতেই দেখা মোটামুটি স্মার্ট এক রোহিঙ্গা তরুণের সঙ্গে। মোবাইল ফোন কানে চেপে কথা বলছিলেন তিনি। পাশে গিয়ে নাম জিগ্যেস করতেই জানালেন ফজে আলম। এসেছেন মিয়ানমারের মংডু থেকে।

‘চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কী বলছিলেন?’ জানতে চাই। কিছুটা টেনে টেনে বলা কথায় ফজে আলমের জবাব, ‘মুই ভাইরে ফোন মাইজ্জি যে (আমি আমার ভাইকে ফোন করেছি)।

অথচ এই কথাক’টি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলার সময় গলায় টান না রেখেই বলা হয়, ‘অ্যাঁই ভাইয়্যরে ফোন গইজ্জি। ’
 
একই ক্যাম্পে কথা হয় চল্লিশোর্ধ্ব নারী রশিদা বেগমের সঙ্গে।
তার কাছে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ‘হত্তুন আইস্যেন’ (কোথায় থেকে এসেছেন) জানতে চাইলে তিনি মিয়ানমারের দিকে হাত দেখিয়ে বলেন, ‘আঁরা হেততুন হেততুন ধাই আইস্যি যে। ’ 

যার সরল বাংলা অর্থ: ‘আমরা ওইখান থেকে পালিয়ে এসেছি। ’। চট্টগ্রামের মানুষজন হলে বলতেন ‘আঁরা ওইত-তুন পালাই আইস্যি। ’

শুধু এই দুটি না, রোহিঙ্গাদের ভাষার সঙ্গে বৃহত্তর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার অমিল প্রতি কথাতেই স্পষ্ট। রোহিঙ্গারা তো বাংলা ভাষার প্রধান রূপ প্রমিত বাংলায় কথা বলতেই পারে না। লিখতে পারা তো ‘হনুজ দূরআস্ত’! চট্টগামের বাসিন্দাদের বেলায় তার ঠিক উল্টো!
 
অথচ মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনী শুরু থেকেই বারবার ভাষার মিলের ভুল অজুহাত দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের বাঙালি বলে প্রচার করে আসছে। ভাষার অভিন্নতার কারণেই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে চলে এসেছে এমন বক্তব্যও আসে তাদের তরফ থেকে।
 
রোহিঙ্গাদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রাহমান নাসির উদ্দিন। এই জাতিগোষ্ঠী নিয়ে সম্প্রতি তার ‘রোহিঙ্গা নয়, রোয়াইঙ্গা’ শীর্ষক একটি গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে।  
 
অধ্যাপক ড. রাহমান নাসির উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ভাষা আর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা একই’- এই দাবি সত্যি নয়। রোহিঙ্গাদের ভাষার সঙ্গে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার কিছুটা মিল আছে বটে, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অমিলের দিকটাই বড়। ’
 
তিনি বলেন, ‘একটা সময় আরাকান স্বাধীন রাজ্য ছিল। তখন বর্তমান বাংলাদেশের ফেনী-নোয়াখালী পর্যন্ত আরাকানের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে এই অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে সেই অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ ছিল। এ থেকে আরাকানের মানুষের ওপর এ অঞ্চলের মানুষের ভাষা ও সামাজিক-সংস্কৃতির প্রভাব ছিল। কিন্তু তাই বলে একথা সত্য নয় যে, রোহিঙ্গারা বাঙালি, তাদের ভাষার সঙ্গে চট্টগ্রামের ভাষার বড় রকমের মিল আছে। ’
 
‘রোহিঙ্গাদের ভাষায় বার্মিজ, রাখাইন, আরবি ও ফার্সি শব্দই বেশি। ধরা যাক, রোহিঙ্গাদের যে অংশটি আমাদের সরকারের সহযোগিতা নিয়ে তাদের দেশে ফেরত যেতে চায়, এই কথাটি তারা যদি তাদের ভাষায় বলে তাহলে তা হবে এরকম: ‘অনারার মুল্লুকের রাজার হাচে মোরার ফরিয়াদ আঁরারে ওয়াহপেস পাঠাওন। ’ 

‘এটা সাধারণ একটা উদাহরণ। এরকম অনেক শব্দ বা বাক্য তারা অহরহ বলে যা বৃহত্তম চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় নেই’-যোগ করেন অধ্যাপক রাহমান নাসির উদ্দিন।
 
এই গবেষক আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মুখের কথ্য ভাষার কোনো লেখ্য রূপও নেই। ’
 
তিনি তার গবেষণার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘আমি উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের কাছে জানতে চেয়েছি রোহিঙ্গাদের পৃথক করার সহজ উপায় কি? তারা চারটি পার্থক্যের কথা বলেছেন। এর মধ্যে প্রথমটিই হলো ভাষার অমিল। স্থানীয়রা বলেছেন, তাদের সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বললেই যে কেউ বুঝতে পারবে তারা রোহিঙ্গা। ’
 
এ তো গেল গবেষকের কথা। রোহিঙ্গারা যাদের এলাকায় ভাগ বসিয়েছেন সেই উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয়রা কী বলছেন?
 
এই দুই এলাকার বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ মানুষের সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের। তাদের প্রায় সবাই বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ভাষার সঙ্গে আমাদের ভাষার মিল মাত্র ৩০ ভাগ। বাকিটা অমিল।
 
গবেষক আর স্থানীয়দের বক্তব্য থেকেও এই কথা স্পষ্ট। সেই সঙ্গে অকাট্যও। ‘রোহিঙ্গারা বাঙালি, তারা চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলে’-মিয়ানমারের এহেন বক্তব্য আসলে ধোপে টেকার নয়।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৭
টিএইচ/টিসি/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।