কিন্তু বছর শেষে একটি মৃত্যুতে চট্টগ্রামের আওয়ামী পরিবারে নেমে এসেছে বিষাদের ছায়া। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, দলমত নির্বিশেষে পুরো চট্টগ্রামকেই যেন ছুঁয়ে গেছে বিষাদে।
দলীয় এবং প্রশাসনিক পদ-পদবির বাইরেও মহিউদ্দিন চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের আপামর মানুষের কাছে তাদের অভিভাবক। অভিভাবক হারানোর বেদনা নিয়েই চট্টগ্রামবাসী বিদায় দিচ্ছে ঘটনাবহুল ২০১৭ সালকে!
২০১৭ সালে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের অর্জন-অপ্রাপ্তি কী, প্রশ্ন ছিল মহানগর কমিটির সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজনের কাছে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, গৃহকরের মতো একটি জনসম্পৃক্ত আন্দোলন আমরা গড়ে তুলতে পেরেছি এবং সেটাতে সুফল পেয়েছে চট্টগ্রামসহ সারাদেশের মানুষ।
‘নিজের দল ক্ষমতায় থাকার পরও চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ জনতার আন্দোলনে শরীক হতে পিছপা হয়নি, এটাই বড় অর্জন। আর এই আন্দোলনের মহানায়ক যিনি, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, তাকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। প্রাপ্তির চেয়েও শেষ মুহূর্তে হারানোর এই বেদনা আমাদের কাছে বিশাল। ’
নগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ফরিদ মাহমুদ বাংলানিউজকে বলেন, আমরা অভিভাবক হারিয়েছি। এই শূন্যতার জন্য চট্টগ্রামবাসীকে অনেক বেগ পেতে হবে। ভবিষ্যৎ বলবে মহিউদ্দিন চৌধুরী কতটুকু অনস্বীকার্য ছিলেন। সারা বছরে কোন্দলে বেশ কয়েকটি তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। এটা খুবই দুঃখজনক। আমরা ভবিষ্যতে হানাহানিমুক্ত চট্টগ্রাম চাই।
গত ১৪ ডিসেম্বর গভীর রাতে নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর জীবনাবসান ঘটে।
চলতি বছরের এপ্রিলে গৃহকর নিয়ে মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একাংশের আন্দোলন শুরু হয়। লালদিঘীর মাঠে গৃহকর এবং ফিশারিঘাট থেকে মাছের পাইকারি বাজার সরানো নিয়ে ১০ এপ্রিল মহিউদ্দিন লালদীঘির মাঠে জনসভা করেন। জীবদ্দশায় ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দানে মহিউদ্দিনের সেটাই ছিল বড় আকারের শেষ জনসভা। সেই জনসভায় সিটি মেয়র ও নিজের কমিটির সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের বিরুদ্ধে কড়া বক্তব্য দেন মহিউদ্দিন। স্বাভাবিকভাবে প্রতিক্রিয়া আসে মেয়র শিবির থেকেও। তবে ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি আঁকড়ে রাখেন মেয়র।
লালদীঘির মাঠে ক্ষোভ ঝাড়ার সাতদিনের মাথায় আবার আরেক সমাবেশে নাছিরকে পাশে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ পথচলার কথাও বলেন মহিউদ্দিন। আবার একদিন পরেই আউটার স্টেডিয়ামে সুইমিং পুল নির্মাণ প্রতিহত করতে গিয়ে মহিউদ্দিনের অনুসারী ছাত্রলীগ মেয়রের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে জড়ায়।
আবার বছরজুড়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকার নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি ভর্তি ফি নেওয়ার বিরুদ্ধে জোরালো আন্দোলন করে নগর ছাত্রলীগ। অন্যদিকে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগ পেয়েছে নতুন কমিটি।
জানতে চাইলে নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নূরুল আজিম রণি বাংলানিউজকে বলেন, ২০১৭ সালের এই বছরটা আমাদের হৃদয়ে গেঁথে থাকবে। এই বছরটা আমাদের জন্য শোকের বছর। আমরা অভিভাবকহীন হয়েছি। এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর আদেশ-পরামর্শে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভর্তি ফি নিয়ে আন্দোলন করেছি। আগামী দিনের লড়াই-সংগ্রামেও মহিউদ্দিন ভাই থাকবেন আমাদের অনুপ্রেরণা এবং লড়াইয়ের শক্তি।
বছরের শেষদিকে দুটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড পুরো নগরজুড়ে তোলপাড় ফেলে দেয়। গত ৬ অক্টোবর সকালে নগরীর সদরঘাট থানার দক্ষিণ নালাপাড়ায় বাসার সামনে খুন হন মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাস। এই হত্যাকাণ্ডের দলের একটি অংশের সম্পৃক্ততার তথ্য উঠে আসে গণমাধ্যমে। প্রতিবাদে মাঠে নামে ছাত্রলীগ।
গত ০৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় নগরীর সদরঘাট থানার মাদারবাড়ি এলাকায় শুভপুর বাসস্ট্যান্ডের পাশে নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এস টি ট্রান্সপোর্টে ব্যবসায়ী মো. হারুনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। হারুন ছিলেন সদরঘাট থানা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক। এই হত্যাকাণ্ডও চট্টগ্রামে তোলপাড় সৃষ্টি করে। যুবদল নেতা হলেও যথারীতি খুনিদের গ্রেফতারের আন্দোলনে শরীক হয় আওয়ামী লীগও।
নগর আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ জনতার পাশে আছে। জনসম্পৃক্ত আন্দোলনে আওয়ামী লীগ জনতাকে ছেড়ে যায়নি। এজন্য সুযোগ থাকার পরও চট্টগ্রামের রাজপথ দখলে নিতে পারেনি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। এখানে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাফল্য এবং আমাদের অভিভাবক প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সাফল্য।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক জয়নাল আবেদিন বাংলানিউজকে বলেন, বছরটা আওয়ামী লীগের জন্য বিষাদের বছর। বিশেষ করে চট্টগ্রামের গণমানুষের নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে আমরা হারিয়েছি। আরেকজন জনপ্রিয় মেয়র আনিসুল হককেও হারিয়েছি। তবে আসছে বছর নির্বাচন। শোককে শক্তিতে পরিণত করে আমাদের দলকে এগিয়ে নিতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৭
আরডিজি/টিসি/এসএইচ