চট্টগ্রাম: বাঁশখালী থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে দায়ের হওয়া মামলায় গ্রেফতার হয়নি কোনো আসামি। তাই এ মামলায় আসামি হাজতে থাকার প্রশ্নই আসে না।
বিষয়টি এতটুকু পর্যন্ত থাকলেও কথা ছিল।
সবকিছু ছক করা পথে যেন ঠিকঠাক মতোই চলছিল। কিন্তু গোল বাঁধে যখন খবর পেয়ে মামলার বাদি তৎক্ষণাৎ আদালতের সামনে হাজির হন। তিনি জানতে চান-কার জামিন চাওয়া হচ্ছে? জবাবে তাকে বলা হয় হাজতি আসামির। এসময় তিনি চিৎকার করে বলে উঠেন, আসামিতো গ্রেফতারই হয়নি। হাজতে কিভাবে থাকবে? এ নিয়ে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে আসামির জামিন আবেদনের ফাইলে থাকা গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র আদালতের সামনেই ‘ছিঁড়ে ফেলেন’ আসামিপক্ষ।
বাদিপক্ষের আইনজীবী তার স্বাক্ষর ও সীল সম্বলিত লেখার স্থানটি কলম দিয়ে খুঁচিয়ে দেন। কিন্তু ততক্ষণে বাদি তার মোবাইলে ওই ফাইলে থাকা ডকুমেন্টগুলো ধারণ করে রাখেন। আদালতে এ নিয়ে তোলপাড় চলে। তোলপাড় শুরু হয় পুরো এলাকায়। বাঁশখালীর আদালতে ঘটে যাওয়া এ ঘটনা গড়ায় চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ আদালত পর্যন্ত।
জানা যায়, বাদি ঘটনার বিষয়ে জানিয়ে জেলা ও দায়রা জজ আদালত বরাবর অভিযোগ দিলে এ ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন হয়। চট্টগ্রামের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কামরুন নাহার রুমির নেতৃত্বে কাজ করছেন তিন সদস্যের বিচারক দল। কমিটির সামনে ডাকা হয়েছে সংশ্লিষ্ট মামলার বাদি ও আসামিপক্ষের আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টদেরকে। বক্তব্য নেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট সকলের। এখন বাকি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা।
বাঁশখালীর কোকদণ্ডী এলাকার নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছাত্রীকে অপহরণ পরবর্তী মামলায় আসামির জামিন নিতে গিয়ে বাঁশখালী আদালতে এমন ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় বাঁশখালী আদালতে জিআরও শাখায় কর্মরত মুন্সি চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের কনস্টেবল সাদ্দামকে বদলি করা হয়েছে।
ঘটনার শুরু যেভাবে
কোকদন্ডী এলাকার এক ব্যক্তি তার মেয়েকে অপহরণ করা হয়েছে জানিয়ে বাঁশখালী থানায় গত ১২ অক্টোবর নিখোঁজ ডায়েরি করেন। তার মেয়ে বাহারছড়ার একটি স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ে বলে এতে উল্লেখ করা হয়। মেয়েটি তার ইলশাস্থ নানার বাড়ি থেকে ওইদিন বিকাল ৪টা ১০ মিনিটে একই গ্রামের এক শিক্ষকের বাড়িতে প্রাইভেট পড়ার জন্য যাচ্ছিলো। সাড়ে ৪টায় তাকে খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করেন তিনি।
পরে ১৪ অক্টোবর বাঁশখালী থানায় একটি মামলা (নম্বর: ১৭ [১০] ২০) দায়ের করেন মেয়ের বাবা। মামলা হয় অপহরণ করে ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক যৌন নিপীড়ন সংক্রান্ত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ধারায়। বাঁশখালী থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রেজাউল করিম মজুমদার মামলাটি গ্রহণ করে তদন্ত শুরু করেন।
এ মামলায় আসামি করা হয় বাঁশখালীর বাহারছড়া এলাকার নুরুল আমিনের ছেলে ইয়াসিন আরাফাত সিফাত (২০) ও একই এলাকার ফজলুল কাদেরের ছেলে মোরশেদকে (২৫)। সাক্ষী করা রয়েছে ভিকটিম ও বাদিসহ ৭ জনকে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামি সিফাত স্কুলে যাওয়ার পথে ভিকটিমকে প্রায়ই উত্যক্ত করে কুপ্রস্তাব দিয়ে আসছিল কিছুদিন ধরে। এ বিষয়ে আসামির পরিবারকে জানানো হলেও তারা আসামিকে সমর্থন দিতে থাকেন। ঘটনার দিন প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় ২ নম্বর আসামি সিএনজি অটোরিকশার ড্রাইভার মোরশেদের সহযোগিতায় ১ নম্বর আসামি ইয়াসিন আরাফাত সিফাত ওই ছাত্রীকে জোরপূর্বক সিএনজি অটোরিকশায় তুলে নেয়। এরপর ১৩ অক্টোবর রাত ১১টার দিকে ২ জন অজ্ঞাত মহিলা ওই ছাত্রীকে বাহারছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কার্যালয়ের সামনে রেখে যায়।
এতে আরও উল্লেখ করা হয়, অপহরণ করার পর আসামিরা ছাত্রীর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে নিপীড়ন করে। ওইদিন রাত ২টার পর ভিকটিমকে বাঁশখালী থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে চট্টগ্রাম মেডি্ক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে নেওয়া হয়।
আদালতে ভিকটিমের জবানবন্দি
এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান বাঁশখালী থানার পরিদর্শক মোহাম্মদ মোবারক হোসেন। গত ১৪ অক্টোবর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ভিকটিমের ২২ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ডের আবেদন জানান তিনি। মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে ভিকটিমের জবানবন্দিও প্রয়োজন রয়েছে বলে আবেদনে উল্লেখ করেন এ পুলিশ কর্মকর্তা।
গত ১৫ অক্টোবর ভিকটিম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২২ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেয়। জবানবন্দিতে ওই ছাত্রী তাকে সিএনজি অটোরিকশায় উঠিয়ে নেওয়া থেকে শুরু করে শারীরিক নিপীড়নসহ অপহরণ ঘটনার পুরো বর্ণনা দেয় বিচারকের কাছে।
আসামি গ্রেফতার না হলেও হাজতে রয়েছে উল্লেখ করে জামিনের আবেদন
২৭ অক্টোবর আসামি ইয়াসিন আরাফাত সিফাতের আইনজীবী মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন বাঁশখালীর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ইয়াসিন আরাফাত সিফাতের জামিনের আবেদন জানান। আসামি সিফাত গ্রেফতার কিংবা কারাগারে না থাকলেও তাকে হাজতি আসামি উল্লেখ করে জামিনের আবেদন জানানোর ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়ায়। ওই আবেদনে বাদিপক্ষের আইনজীবী তোফায়েল বিন হোসাইনেরও স্বাক্ষর ও সীল রয়েছে। তিনি নিজেও ওই সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
মামলার বাদিকে না জানিয়ে মিলেমিশে এভাবে জামিন আবেদন করার বিষয়টি বাদি জানতে পেরে তৎক্ষণাৎ বাঁশখালী আদালতে উপস্থিত হন। বাদি আদালতে উপস্থিত হয়ে প্রথমে বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এসময় তিনি আদালতের উদ্দেশ্যে বলেন, মামলার আসামি গ্রেফতারই হয়নি-তার জামিন চাওয়া হচ্ছে কীভাবে? একইসঙ্গে তিনি তার আইনজীবী তোফায়েল বিন হোসাইনের কাছেও এ ব্যাপারে জানতে চান।
এমন ঘটনায় আদালতের সামনে অনেকটা হট্টগোল লেগে যায়। এসময় মামলার ফাইল বিচারকের সামনে থেকে নিয়ে আসামিপক্ষের লোকজন এ সংক্রান্ত নথিগুলো ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করেন। বাদির আইনজীবী তার স্বাক্ষর ও সীল মারা অংশটি কলম দিয়ে খুঁচিয়ে দেন যাতে স্পষ্ট করে দেখা না যায়। তবে উল্লেখিত তৎপরতার আগেই বাদি নথিগুলোর ছবি তার মোবাইলে ধারণ করে রাখেন। যা প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাঁশখালী থানার পরিদর্শক মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ১৭ (১০) ২০ নম্বর মামলায় অভিযুক্ত দুই আসামি গ্রেফতার হয়নি। তারা কারাগারেও নেই।
তবুও আসামি ইয়াসিন আরাফাত সিফাতকে হাজতি আসামি উল্লেখ করে জামিনের আবেদনের বিষয়টি তাকে জানালে পরিদর্শক মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বলেন, ইয়াসিন আরাফাত সিফাত পলাতক। তাকে গ্রেফতার করা যায়নি। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
জেলা জজের কাছে নালিশ
হাজতে না থাকা আসামিকে হাজতি দেখিয়ে জামিনের আবেদন করার ঘটনায় জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেনের আদালতে নালিশ দেন মামলার বাদি। নালিশে চারজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করা হয়। তাদের মধ্যে আছেন- জিআরও এএসআই জাহাঙ্গীর হোসেন, আসামিপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন ও বাদির আইনজীবী তোফায়েল বিন হোসাইন। গত ৫ নভেম্বর এ নালিশ করেন ভুক্তভোগী।
৫ নভেম্বর জেলা ও দায়রা জজের কাছে নালিশ করার পর চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কামরুন নাহার রুমির নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট আইনজীবী, আইনজীবীর মুন্সি, জিআরও, পেশকার ও বাদির বক্তব্য নেন বলে জানা গেছে।
বাদিপক্ষের আইনজীবী ফয়েজ উদ্দিন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, জেলা ও দায়রা জজ আদালতের কাছে এখনও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়নি বলে জানতে পেরেছি। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল হলে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক অভিযুক্তদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন নিশ্চই।
বাদির মিস মামলা
এ ঘটনার প্রেক্ষিতে গত ৮ নভেম্বর ফৌজদারি কার্যবিধি ৫২৮ (২) ধারা মতে বাঁশখালী আদালত থেকে মামলা স্থানান্তরের জন্য চট্টগ্রামের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কামরুন নাহার রুমির আদালতে মিস মামলা দায়ের করেন বাদি। মামলার আরজিতে বাঁশখালী আদালতে বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।
রোববার (২০ ডিসেম্বর) মামলাটি (মূল মামলা) স্থানান্তরের বিষয়ে আদেশ দেওয়ার কথা ছিল। তবে আদেশের বিষয়ে রোববার রাত পর্যন্ত কিছু জানা যায়নি বলে বাংলানিউজকে জানান চট্টগ্রাম আদালতে বাদিপক্ষের আইনজীবী ফয়েজ উদ্দিন চৌধুরী।
ভুক্তভোগী ও মামলার বাদি বাংলানিউজকে বলেন, এমন ঘটনায় আমি হতবাক হয়েছি। যেখানে আসামি গ্রেফতারই হয়নি সেখানে তাকে হাজতি আসামি উল্লেখ করে জামিনের আবেদন করেছেন আসামিপক্ষ। আর এতে আমাদের আইনজীবী সহযোগিতা করেছেন। আমি এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনার প্রতিকার চেয়ে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে নালিশ দিয়েছি।
তিনি বলেন, প্রতারণার মাধ্যমে জামিনের আবেদন করলেও আমাদের আইনজীবী বিরোধিতা না করে উল্টো আসামিপক্ষের হয়ে কাজ করেন। দুইজন আইনজীবী এমন প্রতারণার আশ্রয় নেওয়ায় প্রতিকার চেয়ে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।
বাদি বলেন, ২৭ অক্টোবরের ঘটনার পর ৯ নভেম্বর আমি ২৭ অক্টোবরের আদেশ, ভিকটিমের ২২ ধারার জবানবন্দি ও মামলার অন্যান্য বিষয় সহি মুহুরী নকলের জন্য আবেদন করি। কিন্তু এখনও আদালত থেকে সেই নকল পাওয়া যায়নি। আমি ন্যায়বিচার চাই। আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রতিকার চাই। আমি প্রয়োজনে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হবো।
অভিযুক্তদের বক্তব্য
আসামিপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ সাইফুদ্দীন বাংলানিউজকে বলেন, ভুলে ওই আসামির জামিন চাওয়া হয়েছিল। বিষয়টি আমরা বসে মিটমাট করে ফেলেছি।
বাদির আইনজীবী তোফায়েল বিন হোসাইনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। পরে মোবাইল ফোনে কিছু বলবেন না জানিয়ে এ প্রতিবেদককে দেখা করার অনুরোধ জানান।
জিআরও এএসআই জাহাঙ্গীর হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, আমি নতুন যোগদান করেছি। এ মামলার বিষয়ে অবগত ছিলাম না। জিআরও শাখায় কর্মরত মুন্সি কনস্টেবল সাদ্দাম স্বাক্ষর করে আদালতে নথি উপস্থাপন করেছিলেন। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাকে বাঁশখালী আদালতের জিআরও শাখা থেকে বদলি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০২০
এসকে/এসি/টিসি