ঢাকা, রবিবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

ফিরে দেখা ২০২০

কক্সবাজার কাণ্ডে আলোচনায় সাবেক ওসি প্রদীপ 

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৩৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২০
কক্সবাজার কাণ্ডে আলোচনায় সাবেক ওসি প্রদীপ  ফাইল ছবি।

চট্টগ্রাম: বাংলাদেশ পুলিশের সাময়িক বরখাস্ত হওয়া পরিদর্শক প্রদীপ কুমার দাশ। কক্সবাজারের টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) থাকাকালে মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দেশজুড়ে আলোচনায় আসেন তিনি।

ক’দিন আগেও সেখানে তার প্রভাব ছিল চোখে পড়ার মতো। মাদক নিয়ন্ত্রণে অভিযানের নামে ধরাকে সরা জ্ঞান করা প্রদীপ কুমার দাশ মাদক ব্যবসায় জড়িতদের পাশাপাশি নিরীহ অনেককে মাদক ব্যবসায়ী বানিয়ে পাঠিয়েছেন জেলে।

 

র‌্যাবের তদন্তে উঠে এসেছে, মাদক নির্মূলে কাজের অন্তরালে প্রদীপ কুমার দাশ নিজেই জড়িয়ে পড়েন মাদক ব্যবসার সঙ্গে। তার এ অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জেনে যাওয়ায় খুন হতে হয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে। আর সিনহা হত্যাকাণ্ডের পরই ফেঁসে যান প্রদীপ কুমার দাশ। সিনহা হত্যা মামলায় জেলে যেতে হয় তাকে। বর্তমানে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি রয়েছেন তিনি।  

গত ৩১ জুলাই কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ফাঁড়িতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। মারিশবুনিয়ার একটি পাহাড়ে ভিডিওচিত্র ধারণ করে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে কক্সবাজারের হিমছড়ির নীলিমা রিসোর্টে ফেরার সময় এ ঘটনা ঘটে।  

৫ আগস্ট কক্সবাজার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হত্যা মামলা করেন সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস। এতে টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ জনকে আসামি করা হয়।  

এ মামলা তদন্ত শেষে র‌্যাব গত ১৩ ডিসেম্বর প্রদীপ কুমার দাশ, লিয়াকত আলীসহ মোট ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেয়। পরে ব্রিফিংয়ে র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ সাংবাদিকদের জানান, সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান টেকনাফে তার ইউটিউব চ্যানেল চালুর অংশ হিসেবে গিয়েছিলেন। তার সঙ্গে এলাকাবাসীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তিনি টেকনাফের মানুষের ওপর প্রদীপ কুমার দাশের নির্যাতন-নিপীড়নের কথা জানতে পারেন। ইয়াবা ব্যবসায় প্রদীপ কুমার দাশের সম্পৃক্ততারও প্রমাণ পান।  

‘এমন কিছু তথ্য সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান সংগ্রহ করেছিলেন, যেগুলো প্রকাশ পেলে প্রদীপ কুমার দাশ অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যেতে পারতেন। এসবের ভিত্তিতে তিনি টেকনাফ থানায় প্রদীপ কুমার দাশের সাক্ষাৎকার নিতে যান। এ সময় প্রদীপ কুমার দাশ তাদের এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার জন্য বলেন এবং সরাসরি হুমকি দেন। কিন্তু সিনহা তার কাজ চালিয়ে চান। পরে প্রদীপ থানাতেই পরিদর্শক লিয়াকত ও তিন তথ্যদাতার সঙ্গে বৈঠক করেন। হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে প্রদীপই নির্দেশ দেন’ যোগ করেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ।  

সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে হত্যার পর পুলিশ বাদি হয়ে টেকনাফ ও রামু থানায় তিনটি মামলা করে। ওই তিন মামলায় সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান, সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথের বিরুদ্ধে মাদক ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। এসব মামলার অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি চেয়ে র‌্যাব চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে আদালতে।

নানা কারণে বিভিন্ন সময় আলোচিত ও সমালোচিত প্রদীপ কুমার দাশ ১৯৯৫ সালে উপ-পরিদর্শক (এসআই) হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দেন। বিভাগীয় মামলার কারণে পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতিতে দেরি হয় তার। ২০০৯ সালে এসে পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি পান। চাকরি জীবনে তার দীর্ঘসময় কেটেছে চট্টগ্রামে।  

খুঁটির জোরে ঘুরেফিরে পোস্টিং নিতেন শুধু সিএমপি আর কক্সবাজার জেলায়। মাঝখানে কিছুদিন তিনি সিলেটে ছিলেন। চাকরি জীবনে ঘুষ দাবিসহ নানা অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত, প্রত্যাহার ও বদলি হয়েছেন একাধিকবার। কিন্তু সব সামলে ঠিকই বাগিয়ে নিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ থানার ওসি পদ।

প্রদীপ কুমার দাশ টেকনাফের আগে কক্সবাজারের মহেশখালী থানার ওসি, সিএমপির পতেঙ্গা, বায়েজিদ ও পাঁচলাইশ থানার ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যেখানেই দায়িত্ব পালন করেছেন সেখানেই বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। একাধিকবার স্ট্যান্ড রিলিজও হয়েছেন। কিন্তু প্রতিবারই অদৃশ্য ছায়ায় পার পেয়ে গেছেন।  

সর্বশেষ টেকনাফ থানায় যোগদান করে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন প্রদীপ কুমার দাশ। মাদক ব্যবসায়ীদের বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা, নিরীহ লোকজনকে বন্দুকযদ্ধের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে তাদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।  
 
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কোতোয়ালী থানায় কর্মরত থাকাকালে পাথরঘাটা এলাকায় জায়গা দখলকে কেন্দ্র করে সাময়িকভাবে বরখাস্ত হন প্রদীপ কুমার দাশ। সিএমপি থেকে বদলি হয়ে যান কক্সবাজার জেলায়। কক্সবাজার সদর থানা এলাকায়ও একটি জায়গা দখলকে কেন্দ্র করে প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়।

২০১৩ সালে পাঁচলাইশ থানার ওসি থাকাকালে এক আইনজীবীকে তুলে এনে নির্যাতনের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এক আসামিকে রিমান্ডে আনতে পুলিশের করা আবেদনের বিরোধিতা করায় ওই আইনজীবীকে তুলে এনে নির্যাতন করা হয়।  

২০১৫ সালে বায়েজিদ থানার ওসি থাকাকালে বেসরকারি তেল শোধনাগার সুপার রিফাইনারির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে হয়রানির অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত হন প্রদীপ কুমার দাশ।  
 
এদিকে সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় গ্রেফতারের পর প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যার অভিযোগে বিভিন্ন আদালতে আটটি মামলা দায়ের হয়।  

গত ২৩ আগস্ট প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রী চুমকি কারনের বিরুদ্ধে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ মামলা দায়ের করেন দুদকের সহকারী পরিচালক মো. রিয়াজ উদ্দীন। প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রী চুমকী কারনের বিরুদ্ধে দুদকে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে ১৩ লাখ ১৩ হাজার ১৭৫ টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য গোপন এবং ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে ৩ কোটি ৯৫ লাখ ৫ হাজার ৬৩৫ টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এ মামলা দায়ের হয়।  

২০১৮ সালে প্রদীপ ও চুমকীর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তদন্ত শুরু করে দুদক। গত ১২ সেপ্টেম্বর দুদকের মামলায় হাজিরা দিতে প্রদীপ কুমার দাশকে কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হয়।  

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২০
এসকে/এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।