চট্টগ্রাম: আর্যপূর্ব দ্রাবিড় যুগে হিমালয়ের পাদদেশে জন্ম নেওয়া সোনাঝরা সোনালু বাংলার প্রকৃতিতেও রং ছড়িয়েছে। পাহাড়-সমুদ্রঘেরা চট্টগ্রামে বৈশাখের খরতাপেও পথিকের নজর কাড়ছে এই ফুল।
গাছে কিশোরীর কানের দুলের মতো হাওয়ায় দুলতে থাকে হলুদ-সোনালি রঙের থোকা থোকা ফুল। আবার ফুলের ফাঁকে দেখা মেলে লম্বা ফল।
বীজ ও শেকড়ের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে ভারত ছাড়িয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে নিজের রূপলাবণ্য ছড়িয়ে দিয়েছে এই ফুল। পেয়েছে বিশেষ মর্যাদাও।
ফুলটির শুদ্ধ নাম কর্ণিকার। থাইল্যান্ডের জাতীয় এই ফুলের নাম রাচাফ্রুরুয়েক। বিভিন্ন দেশে এটির নাম- আরববক, কৃতমান, রাজবৃক্ষ, চতুরঙ্গুল, অবঘাতক, গোল্ডেন শাওয়ার ইত্যাদি। বাংলাদেশে কেউ বলে বান্দরলাঠি, সোদেল, সোমরাল, সোনালু।
গ্রীষ্মের প্রকৃতিতে প্রাণের সজীবতা নিয়ে ফোটে সোনালু। এটির বৈজ্ঞানিক নাম কেসিও ফেস্টুলা। মাঝারি বৃক্ষ। উচ্চতা ১০-১৫ ফুট। চৈত্রে পাতা ঝড়ে যায়। বৈশাখ নতুন পাতার ফাঁকে ঝাড়বাতির মতো ঝুলতে থাকে ফুল।
প্রতিটি ফুলে পাঁচটি পাপড়ি। পুংকেশর দশটি। ফুলগুলো এক ইঞ্চির মতো প্রশস্ত। আছে দীর্ঘ মঞ্জুরিদণ্ড। গর্ভকেশর সবুজ, কাস্তের মতো বাঁকা। ফুলের আকৃতি অনেকটা আঙুলের ডগার মতো। লাঠির মতো ফল দুই-তিন হাত লম্বা হয়।
সুগোল এই লাঠির ভেতরে অনেক বীজ থাকে। এ বীজ থেকে চারা হয়। আবার শেকড় থেকেও চারা গজায়। বাকল ধূসর ও মসৃণ। কাঠ খুব মূল্যবান না হলেও আগে গ্রামে ঢেঁকি বানানোর কাজে ব্যবহার করা হতো।
বাংলাদেশের পাহাড়গুলোতে এই গাছ বেশি জন্মে। বর্তমানে অনেক বনসাই শিল্পী টবে সোনালু গাছ লাগাচ্ছেন। এই ফুল আছে দেবতার কর্ণমালায়, দেব-দেবীর চরণে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদনে। মহাভারতে ব্যাসদেব শ্রীকৃষ্ণের কানে এই ফুলকে গয়না হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
বোধিসত্ত্বে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘গিয়াছে প্রবাসে বাছা, কে আনিবে আর/শল্লকী, কুটজ, বিস, শ্যামা, করবীর,/কুরুন্দি আজি মোর ভোজনের তরে?/বাড়িবে এসব এ বে এই অরণ্যতে, ফুটিবে পর্বত-পাদে কর্ণিকার ফুল। ’
মহাকবি কালীদাস লিখেছেন, ‘বর্ণপ্রকর্ষে মতি কর্ণিকারং নির্গন্ধতায়স্ম দুনোতি চেতঃ’। মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখেছেন, ‘হায়, কর্ণিকা অভাগা/বরবর্ণ বৃথা যায় সৌরভ বিহনে/ সতীত্ব বিহনে যথা যুবতী যৌবন!’।
মেঘদূত কাব্যে মল্লিনাথ লিখেছেন, ‘কর্ণিকার বৃক্ষের সমীপে যদি যুবতী আহ্লাদে নৃত্য করে তবে বৃক্ষের গর্ব হয়’। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে রোপণ করা এই গাছের কারণে রাস্তার নামকরণ করেছেন-সোনাঝুরি।
কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করেন, এ গাছের কাঠ খুব একটা দামি নয় বলে কিংবা গাছটি খুব ধীরে বাড়ে বলেই কেউ আর তেমন উৎসাহ নিয়ে সোনালু গাছ রোপণ করেন না।
প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা সোনালু ফুল গাছ তার হলুদ-সোনালি রঙের সৌন্দর্য বিতরণ করেই অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। অযত্ন-অবহেলায় বেড়ে উঠলেও তার রূপে আকৃষ্ট হয়ে কাছে আসে সবাই, ক্যামেরায় বন্দি করে রাখে সোনা রঙ।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪০ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০২১
এসএস/এসি/টিসি