চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: যথাযথ নিয়োগ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের তিনটি পদে শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগ উঠেছে। এমনকি নিয়োগ বোর্ডে কোনো বিশেষজ্ঞ না রেখেই শেষ করা হয়েছে নিয়োগ প্রক্রিয়া।
বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্যাডিউট অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়োগ বোর্ডে অবশ্যই সংশিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ রাখার নিয়ম রয়েছে।
সিলেকশন বোর্ডে বিষয় সংশ্লিষ্ট কোনো বিশেষজ্ঞ না রাখায় প্রশ্ন উঠেছে নিয়োগের স্বচ্ছতা নিয়ে। এছাড়া তিন পদের বিপরীতে কিভাবে ৫ জন সুপারিশ করা হয় তা নিয়েও চলছে নানান আলোচনা-সমালোচনা। শুধু তাই নয়, পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আরও বেশ কিছু অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। যা উঠে এসেছে বাংলানিউজের অনুসন্ধানে ।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ২০১৯ সালের ১৪ জুন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর মেয়াদ শেষ হতে যাওয়ায় মাত্র ২৪ দিন আগে ১৬ মে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। এতে আবেদনের সময় হিসেবে উল্লেখ করা হয় ২৬ মে পর্যন্ত। ফলে আবেদনের জন্য প্রার্থীরা সময় পান মাত্র ১০ দিন। আবার সেই ১০ দিনের মধ্যে ৯ দিনই ছিলো সাপ্তাহিক ও গ্রীষ্মকালীন ছুটি। তাই মাত্র ১ কার্যদিবসে সব প্রক্রিয়া শেষ করা সুযোগ পান আবেদনকারীরা। এছাড়া আবেদনপত্র সংগ্রহের একমাত্র মাধ্যম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট ১৬ মে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর থেকে অকার্যকর ছিলো বলে অভিযোগ আবেদনকারীদের। এমন জটিলতায় অনেক আগ্রহী আবেদনকারী প্রার্থী আবেদন করতে পারেননি। এ ঘটনায় ঢাবির আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের ফারসি ভাষার খণ্ডকালিন শিক্ষক মো. কামাল হোসাইন সার্বিক অসুবিধার বিষয়টি উল্লেখ করে চবির রেজিস্ট্রার বরাবর ২৬ মে আবেদনের সময় বাড়ানোর জন্য একটি চিঠি দেন। তবে এতে কোনো সাড়া দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আবার একজন প্রার্থী আবেদন করতে না পেরে উচ্চ আদালতে একটি রীট করেন। রীট নম্বর ৮২৪৯/২০১৯। পরে হাইকোর্ট এ বিজ্ঞপ্তি কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না মর্মে রুল জারি করেন। সেই সঙ্গে আবেদনকারীর দরখাস্ত নিষ্পত্তির করতে উচ্চ আদালত নির্দেশনা দেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ লিখিতভাবে আবেদনকারীর আবেদন গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এ রুলের নিষ্পত্তি না করেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিয়োগ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখেন।
নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিষয়ে উচ্চ আদালতে রীটকারী মো. কামাল হোসাইন বাংলানিউজকে বলেন, রীটের দুটি অংশ ছিলো। একটি হলো সময় বাড়ানো ছাড়া বিজ্ঞপ্তি কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না। আরেকটি অংশ হলো আবেদনকারীর আবেদন ১৫ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবেদন গ্রহণ করা সম্ভব নয় বলে আবেদনকারীকে লিখিত জানালেও রীটের দ্বিতীয় অংশ সময় বাড়ানো ছাড়া বিজ্ঞপ্তি কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তার নিষ্পত্তি করেনি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রীট শুনানিতেও অংশগ্রহণ করেনি।
অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী দ্রুত এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চান। কিন্তু মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি। সেসময় গঠিত নিয়োগ বোর্ডের সদস্য ছিলেন ঢাবির ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দীন ও চবির ফারসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবুল হাসেম। ওই নিয়োগ বোর্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ২০২০ সালে আরও একটি বোর্ড গঠন করা হয়। নতুন গঠিত বোর্ডে চবির কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন ও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মহীবুল আজিজ এবং ঢাবির আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শামিম বানুকে রাখা হলেও রাখা হয়নি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো বিশেষজ্ঞ। এছাড়া পদাধিকারবলে নিয়োগ বোর্ডের আরেকজন সদস্য হলেন চবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার। তিনিও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক।
অন্যদিকে মৌখিক পরীক্ষার প্রবেশপত্র সংগ্রহের জন্যও দেওয়া হয়েছিলো মাত্র এক সপ্তাহ সময়। প্রবেশপত্রগুলো ডাকযোগে পাঠানো হলেও একজন আবেদনকারী প্রবেশপত্র পাননি। আরেকজন প্রবেশপত্র ছাড়াই দিয়েছেন পরীক্ষা।
নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এমন তড়িঘড়ি সন্দেহজনক বলে প্রতিবাদ জানিয়েছেন আবেদনকারী ও ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষকরা।
আবেদনকারী ঢাবি শিক্ষার্থী সাহিদা আক্তার সানি বাংলানিউজকে বলেন, আমার বাড়ি নেত্রকোণা। এখান থেকে চট্টগ্রাম আসতেও দুইদিন লেগে যায়। তার ওপর আবেদনের সময় এতটাই কম দেওয়া হয়েছে যে, অনেক চেষ্টা করেও কাগজপত্র গিয়ে পৌঁছেছে আবেদনের শেষ দিন। তবুও আমি ভেবেছিলাম পরীক্ষার প্রবেশপত্র পাবো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাইনি। কিসের এত তড়িঘড়ি ছিলো সেটাই বড় প্রশ্ন।
তিনি বলেন, এমন নিয়োগ প্রক্রিয়া কলঙ্কজনক। যা শুনতে পাচ্ছি, যারা সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছেন তারা তেমনটা যোগ্যতা সম্পন্ন নয়। আমরা চাই যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানকে সমুন্নত রাখা হোক।
চবির ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও বিভাগের একমাত্র অধ্যাপক ড. মো. আবুল হাসেম বাংলানিউজকে বলেন, সিলেকশন বোর্ডে সদস্যদের মধ্যে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ থাকতে হয়। কিন্তু এবারের সিলেকশন বোর্ডের কেউ ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন। এমন ঘটনা নিন্দনীয় এবং হাস্যকর। তাছাড়া নিয়োগ প্রক্রিয়া তড়িঘড়ি থেকেও বোঝা যাচ্ছে এখানে কোনো অসঙ্গতি থাকতে পারে। বাংলাদেশে ঢাবি, রাবি ও চবিতে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ রয়েছে। সেখান থেকেও কোনো প্রতিনিধি রাখা হয়নি সিলেকশন বোর্ডে। সিলেকশন বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক শামিম বানু আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের ফারসি ভাষার শিক্ষক হলেও তিনি ফারসি সাহিত্যের বিশেষজ্ঞ নন।
চবির ফারসি বিভাগের সভাপতি আব্দুল করিম বাংলানিউজকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী সিলেকশন বোর্ড গঠনের জন্য বিভাগের কাছে নাম চাওয়া হয়। আমরা সেখানে বিশেষজ্ঞদের নাম দেই। তবে সিলেকশন বোর্ডে কাকে রাখা হবে, সেটা সিন্ডিকেট সভায় সিদ্ধান্ত হয়। আমরা চারজনের নাম দিয়েছিলাম। তবে সিলেকশন বোর্ডে কারা থাকবে বা নিয়োগ প্রক্রিয়া কিভাবে সম্পন্ন করা হবে সেটা কর্তৃপক্ষের বিষয়।
তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয় ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এস এম মনিরুল হাসান বাংলানিউজকে বলেন, সিলেকশন বোর্ডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামিম বানু ছিলেন, তিনি ফার্সির শিক্ষক। সবকিছু বিবেচনা করেই সিলেকশন বোর্ড গঠন করা হয়।
উচ্চ আদালতের রীটের নিষ্পত্তি করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের রীটের জবাব বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েছে। এতে রীট কারীর আবেদন গ্রহণ না করার কারণ ব্যাখ্যা করেছি।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০, ২০২১
এমএ/টিসি