ঢাকা, সোমবার, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১, ০১ জুলাই ২০২৪, ২৩ জিলহজ ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

কোর্ট হিলের অবৈধ স্থাপনা সরাতে ২৫ দফতরের চিঠি

সৈয়দ বাইজিদ ইমন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০২১
কোর্ট হিলের অবৈধ স্থাপনা সরাতে ২৫ দফতরের চিঠি ...

চট্টগ্রাম: নিরাপত্তা ও সৌন্দর্য রক্ষার্থে কোর্ট হিলের অপরিকল্পিত এবং অনুমোদনহীন স্থাপনাগুলো অপসারণের জন্য সরকারি ২৫টি দফতর থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি কর্তৃক ১নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত জমিতে দুইটি ভবন নির্মাণের প্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্তৃক জারি করা পত্র অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী ১নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত জমিতে নতুন কোনও ভবন নির্মাণ না করা এবং ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি কর্তৃক নির্মিত ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো অপসারণের নির্দেশ দিয়েছেন।

 

আইনজীবী সমিতির নতুন দুটি ভবন নির্মাণ নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়ায় জেলা প্রশাসন ও আইনজীবীরা। জেলা প্রশাসন ও নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, প্রস্তাবিত ভবন দুটি ঝুঁকিপূর্ণ ও অনুমোদনহীন।

আইনজীবী সমিতির মতে, অনুমোদন নিয়েই ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এরপর থেকে শুরু হয় জবাব-পাল্টা জবাব। পরে সরকারের ২৫টি দফতর পরীর পাহাড় থেকে অবৈধ ও অনুমোদনহীন স্থাপনা সরাতে উদ্যোগ নিয়ে কয়েক দফা চিঠি দেয়।  

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে পরীর পাহাড়ে ১নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত ফাঁকা জায়গায় দুটি বহুতল ভবন নির্মাণে পত্রিকায় দরপত্র বিজ্ঞপ্তি দিলে এ দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়। আইনজীবীদের দরপত্র আহ্বান বিজ্ঞপ্তির প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন স্থানীয় কয়েকটি পত্রিকায় সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এরপর থেকে বিষয়টি নিয়ে আইনজীবী সমিতির সদস্যরা কথা বলতে শুরু করেন।

চিঠি দেওয়া সরকারি দফতরগুলো হলো-

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, অ্যাটর্নি জেনারেল, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, চট্টগ্রাম ওয়াসা, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বিক্রয় ও বিতরণ কেন্দ্র- চট্টগ্রাম, পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম অঞ্চল কার্যালয়, পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স চট্টগ্রাম বিভাগ, বাংলাদেশ সচিবালয় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধিশাখা-৯, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ এবং পুলিশ অধিদফতর।

সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরগুলো বলছে, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের নিরাপত্তা এবং সৌন্দর্য রক্ষার্থে অপরিকল্পিত ও অনুমোদনহীন স্থাপনাগুলো অপসারণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয় বা সরকারি কোনও সংস্থার অনুমোদন ছাড়া ভবিষ্যতে ঝুঁকিপূর্ণ ও অপরিকল্পিত অবৈধ স্থাপনা না গড়তে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে বলা হয়েছে।  

ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে পাহাড় এলাকায় সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত পাহাড় শ্রেণির জমিতে অবৈধ স্থাপনা অপসারণ ও চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি যেন পুনরায় অবৈধভাবে সরকারি খাস জমি দখল না করতে পারে সে ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে মন্ত্রিপরিষদ ও ভূমি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে বিভাগীয় কমিশনার ও চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়।  

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা জানিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। ওই পাহাড় এলাকায় সরকারি ভবন ও স্থাপনাগুলো ছাড়া এবং জেলা প্রশাসকের অনুমোদনপত্র ছাড়া কোনও প্রকার গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ না দেওয়ার জন্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড থেকে অনুরোধ করা হয়।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে চিঠি দিয়ে ১ম শ্রেণির কেপিআই প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক-চট্টগ্রামের সার্বিক নিরাপত্তা ও সম্ভাব্য ঝুঁকি নিরসনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সীমানা দেওয়াল ঘেঁষে নির্মিত আইনজীবী ভবন সরানোর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছেন।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত বিভাগ চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে আইনজীবী ভবন অপসারণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন এবং পাশাপাশি কিভাবে সরকারের ১ নম্বর খাস খতিয়ানের জায়গায় অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করতে অনুমোদন দেওয়া হয়, তার কারণ দর্শানোর জন্য ব্যাখ্যা চেয়েছেন।  

পাশাপাশি অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও সরকারি দফতরগুলোও আইনজীবী ভবন অপসারণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দিয়েছেন।

চট্টগ্রাম আদালত এবং জেলা প্রশাসনের কার্যালয় নিয়ে থাকা পাহাড়টিকে ‘পরীর পাহাড়’ হিসেবে উল্লেখ না করতে ১০ নভেম্বর চট্টগ্রামের দেওয়ানী আদালতের প্রথম সহকারী জজ ইসরাত জাহান  অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন।

জানা যায়, এই পাহাড়ে প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয় প্রায় ১৩০ বছর আগে। বর্তমানে এখানে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, নতুন আদালত ভবন, চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভবন, আইনজীবীদের পাঁচটি ভবনসহ বেশকিছু সরকারি কার্যালয় রয়েছে। এগুলো ছাড়াও এর চারদিকে অপরিকল্পিত ও অনুমোদনহীন ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা গড়ে উঠেছে।  

পাহাড়ে মানুষের ভিড়, রাস্তার দুইপাশে গাড়ি পার্কিং, বিভিন্ন দোকানপাট, খাবার হোটেল, কম্পিউটার দোকান, এমনকি কাঁচাবাজার ও শুঁটকির দোকান পর্যন্ত রয়েছে। নানা রকম দোকানপাট ও স্থাপনা মিলিয়ে প্রায় ৩৫০টি অবৈধ স্থাপনা আছে ঐতিহ্যবাহি পাহাড়টিতে। এসব স্থাপনা পাহাড়ের সৌন্দর্যকে ম্লান করছে, নষ্ট করছে পরিবেশ। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন বর্তমানে পাহাড়ে গড়ে ওঠা এসব জঞ্জাল ও স্থাপনা উচ্ছেদে উদ্যোগ নিলেও নানামুখি বাধা এবং দ্বন্দ্বের কারণে উচ্ছেদ করা সম্ভব হচ্ছে না।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পাহাড় বা টিলা শ্রেণির জমির কোনরূপ পরিবর্তন করা যাবে না। এটা আইনি বাধ্যবাধকতা। বাঁশখালী, মিরসরাই, লোহাগাড়াতে অনেক পাহাড় কাটা বন্ধ করেছি। চট্টগ্রামের অবৈধ ১৫৬টি ইটভাটা বন্ধ করা হয়েছে পাহাড় শ্রেণির জমিতে হওয়াতে। এই পাহাড়ে ওঠার পথে পুরাতন বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন লাগোয়া পথের পাশে আইনজীবী সমিতির ভবন। সেখানে পরপর এনেক্স-১, এনেক্স-২, শাপলা ও দোয়েল ভবন। পাঁচটি ভবনের কোনোটিতে গাড়ি রাখার জায়গা নেই।  

জানা গেছে, আইনজীবীদের পাঁচটি ভবনে মোট সাড়ে তিন হাজার আইনজীবীর চেম্বার রয়েছে। বর্তমানে সমিতির ভোটার ছয় হাজার। এমন অবস্থায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন বলছে, নতুন করে আরও দুটি ভবন নির্মাণ হলে আরও ঝুঁকিতে পড়বে পাহাড়টি।

ইতিমধ্যে এই পাহাড় নিয়ে ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স এবং পরিবেশ অধিদফতর তাদের দেওয়া প্রতিবেদনে আইনজীবীদের ৫টি ভবনকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যার ফলে  সেখানে যেকোনও সময় অগ্নিকাণ্ড, পাহাড় ধস ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়সহ ব্যাপক প্রাণহানি ঘটতে পারে বলে প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।  

জেলা প্রশাসক বলেন, যেহেতু ভবন দুটির জায়গা পাহাড় শ্রেণির জমি। তাই চাইলেও আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কিছু করা যাবে না। এখানে ভূমিকম্প, ভূমিধস বা অগ্নিকাণ্ডের মত কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা আছে, যা ফায়ার সার্ভিস ও পরিবেশ অধিদফতরের রিপোর্টে উঠে এসেছে। তাই সবাই যেন সচেতন থাকে এবং ভবিষ্যতে কোনও পরিস্থিতির উদ্ভব হলে যাতে কেউ এড়িয়ে যেতে না পারে সেজন্য সকলকে সতর্ক করা হয়েছে।  

‘অবৈধ স্থাপনার কারণে এই পাহাড়ের ওঠানামার রাস্তাগুলো সরু হওয়ায় অগ্নিকাণ্ডসহ যেকোনও দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে উদ্ধারকারী টিম ও যানবাহন দ্রুততার সঙ্গে এ স্থানে আসতে পারে না। সে জন্যই সকলকে সতর্ক করতে স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়েছে। পরীর পাহাড়ে আইনজীবীদের চিহ্নিত ৫টি ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে ভূমি মন্ত্রণালয়, কালেক্টর, সিডিএ, পরিবেশ অধিদফতর বা সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার অনুমোদন নেওয়া হয়নি।

জেলা প্রশাসন বলছে, আইনজীবী সমিতির নির্মিত ৫টি বহুতল ভবনের সবগুলোর নকশা অনুমোদিত নয় এবং ১৯৭৭ সালে তৎকালীন সামরিক শাসনামলে আইনজীবী সমিতিকে ১৪৮৮৮ নম্বর যে লিজ দলিলমূলে ০.১২৯০ একর তথা ১২.৯০ শতক জমি বরাদ্দ প্রদান করা হয় সে একই লিজ দলিল ব্যবহার করে ১টি ভবনের স্থলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) আইনজীবী সমিতিকে বিভিন্ন সময়ে পরপর ৫টি বহুতল ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদন প্রদান করে। সরকারের ১নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত জমির লিজ দেওয়ার প্রথম শর্তেই উল্লেখ আছে, নকশা অনুমোদন করতে ও ভবন নির্মাণে জেলা প্রশাসককে অবহিত করে অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে চউক এসব অবৈধ স্থাপনার অনুমোদন দেয়। সেজন্যই গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় চউককে কারণ দর্শানোর চিঠি দিয়েছে।  

অনুসন্ধানে জানা যায়, আইনজীবীদের ভবন দুটি শুধু লিজ দলিলের ভিত্তিতে নকশা অনুমোদন করা হয়েছে। আবেদনকারীর মালিকানার স্বপক্ষে কোনও খতিয়ান, রেকর্ড, নামজারি খতিয়ান কিংবা ভূমি উন্নয়ন কর প্রদানের রসিদ চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ যাচাই করেনি। এছাড়া মালিকানা প্রমাণের এসব  দলিলাদি উপেক্ষা করেই নকশা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১১২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০২১ 
বিই/এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।