ঢাকা, শনিবার, ১৫ আষাঢ় ১৪৩১, ২৯ জুন ২০২৪, ২১ জিলহজ ১৪৪৫

চট্টগ্রাম প্রতিদিন

আইন প্রয়োগের দুর্বলতায় বাড়ছে শব্দদূষণ

মিজানুর রহমান, স্টাফ করসেপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০২২
আইন প্রয়োগের দুর্বলতায় বাড়ছে শব্দদূষণ ...

চট্টগ্রাম: বেশ কিছুদিন আগে শব্দ দূষণের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেন সুজন বড়ুয়া নামে এক ব্যক্তি। প্ল্যাকার্ড হাতে মাঝ রাস্তায় দুই সন্তান নিয়ে বসে থাকা কিংবা অনশন সবই করেছেন তিনি।

 

উদ্দেশ্য একটাই, শব্দদূষণ বন্ধে উদ্যোগ নিবে প্রশাসন, সচেতন হবে সাধারণ জনগণ। কিন্তু ফলাফল শূন্য।

প্রায় ৩২ দিনের আন্দোলনে ঘুম ভাঙেনি কর্তৃপক্ষের। এমনকি পাশেও দাঁড়ায়নি কেউ, আসেননি কোনো প্রশাসনিক কর্তা-ব্যক্তিও। শেষ পর্যন্ত তাঁকে হতাশ হয়ে ফিরতে হয় বাড়িতে।  

আক্ষেপের সুরে সুজন বড়ুয়া বলেন, ‘মানবতাহীন এ পৃথিবীতে কেউ কারো নয়। এতদিন ধরে আন্দোলন করলাম, কারো কোনো সহযোগীতা পেলাম না। কেউ এসে বললো না- আপনার আন্দোলন যৌক্তিক, আমরা পাশে আছি’।  

প্রতিনিয়ত শব্দদূষণ বাড়লেও যেন দেখার কেউ নেই। শব্দদূষণের শাস্তি হিসেবে অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই বিভিন্ন এলাকায় বাড়ছে এর মাত্রা।  

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইন থাকলেও সঠিক প্রয়োগ না থাকায় শব্দ দূষণ কমছে না। তাই সুজন বড়ুয়ার মতো সাধারণ নাগরিকরা আন্দোলন করলেও ঘুম ভাঙে না কর্তৃপক্ষের।  

শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ এ শব্দদূষণের অপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে। এ আইনের ১৭ ধারার ১ উপধারায় উল্লেখ করা হয়, ১০ ধারার উপ-ধারা (১) এর দফা (ক) এবং (ঙ) এর অধীন ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা দায়িত্ব পালনের সময়, এই বিধিমালার অধীন দণ্ডনীয় কোনো অপরাধ সংঘটনের প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার হতে পারে এমন কোনো শব্দের মানমাত্রা অতিক্রমকারী যন্ত্রপাতি, বা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সরঞ্জামাদি আটক করতে পারবেন।  

এছাড়া একই আইনের ১৮ ধারা ১ উপধারায় বলা হয়েছে, ১৫ এর উপধারা (২) এর বিধান অনুসারে এই বিধিমালার বিধি ৭, ৮, ৯, ১০, ১১, ১২ এবং ১৩ এর বিধান লংঘন এবং বিধি ১৪, ১৫ এবং ১৬ এ প্রদত্ত নির্দেশ পালনের ব্যর্থতা, অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে।  

অন্যদিকে একই ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি উপ-বিধি (১) এর অধীন নির্ধারিত অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি প্রথম অপরাধের জন্য অনধিক ১ মাস কারাদণ্ডে বা অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য অনধিক ৬ মাস কারাদণ্ডে বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।

কিন্তু আইনে উল্লেখ থাকলেও সঠিক প্রয়োগ না থাকায় শব্দদূষণের মাত্রা বাড়ছে বলে দাবি দূষণ নিয়ে কাজ করা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ইকবাল সরওয়ারের।  

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, শব্দ দূষণ এমন একটি বিষয় জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য দূষণের মত এটিও বাড়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষণ হয় যানবাহন থেকে। এছাড়া নগরায়নের ফলেও বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ, কল-কারখানা স্থাপনের শব্দদূষণের মাত্রা বাড়ছে।

ইকবাল সরওয়ার বলেন, শব্দ নিয়ে একটি গবেষণার কাজ চলছে। আমরা চট্টগ্রাম শহরের শব্দদূষণের মাত্রা পরিমাপ করেছি। এর মধ্যে আমরা দেখতে পেয়েছি মুরাদপুর, অক্সিজেন, আগ্রাবাদ, বহদ্দারহাট, চকবাজার এলাকায় মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণ হচ্ছে।  
  
শব্দদূষণ রোধে যে আইন রয়েছে এটি যুগোপযোগী কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, শব্দদূষণ আইন হয়েছে কিন্তু তার প্রয়োগ তেমন একটা নেই বললেই চলে। তাছাড়া যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আইন সংশোধন করা দরকার। কারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। ১০/১৫ বছর আগে মানুষের যে আয় ছিল এখন তা দ্বিগুন-তিনগুণ হয়েছে। ফলে আইন ভঙ্গ করলেও জরিমানা দিতে অনেকের গায়ে লাগছে না। তাই শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আইন সংস্কারের পাশাপাশি কর্তৃপক্ষকে আরও কঠোর হতে হবে।  

এ গবেষক মনে করেন, চালকদের মধ্যে একটা প্রবণতা রয়েছে ‘কে কার আগে যাবে’। কেউ এক মিনিট অপেক্ষা করতে চায় না। ফলে রাস্তায় কারণে অকারণে হর্ন বাজিয়ে থাকেন। এ প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। সবচেয়ে বড় বিষয়, চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে হর্ন ব্যবহারের নিয়মনীতি সম্পর্কে কতটুকু জ্ঞান আছে তা যাচাই বাছাই করা উচিত।


 
চট্টগ্রামে শব্দ দূষণের অবস্থা

মানুষ সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ ডেসিবেল শব্দে কথা বলে। ৭০ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দ মানুষের কান গ্রহণ করতে পারে। ৮০-এর বেশি গেলেই ক্ষতি শুরু হয়। চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিফদতরের গবেষণাগারের তথ্যানুযায়ী, নগরের গত আগস্ট মাসে ৩০টি স্পটে শব্দের মাত্রা পরীক্ষা করে ১৪টি নীরব এলাকায় শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে ৬৭ দশমিক ৫০ থেকে ৭৭ দশমিক ৫০ ডেসিবেল পর্যন্ত। যদিও আইন অনুযায়ী, নীরব এলাকায় রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে।  

গবেষণাগারের এ জরিপে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ গেট এবং জাকির হোসাইন রোডের ইউএসটিসি হাসপাতালের সামনে শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে ৭৬ দশমিক ৫০ ডেসিবেল। আন্দরকিল্লা জেমিসন রেডক্রিসেন্ট হাসপাতাল এলাকায় ৬৯ দশমিক ৫০, পাঁচলাইশ সার্জিস্কোপ হাসাপাতাল, লালখান বাজার মমতা ক্লিনিকের কাছে ৬৭ দশমিক ৫০ এবং আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালের সামনে পাওয়া গেছে ৭৩ দশমিক ৫০ ডেসিবেল।  

এছাড়া নগরীর আবাসিক এলাকাগুলোতেও নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি শব্দের তীব্রতা পেয়েছে পরিবেশ অধিদফতর। আবাসিক এলাকার সাতটি স্পটে করা জরিপে দেখা গেছে, দক্ষিণ খুলশী এলাকায় শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে সর্বোচ্চ ৭৭ ডেসিবল ও চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার সামনে সর্বনিম্ন ৬৪ দশমিক ৫ ডেসিবেল। জরিপে বাণিজ্যিক এলাকার ছয়টি স্পটের মধ্যে নগরীর জিইসি মোড়ে শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা ছিল ৮৩ ডেসিবেল আর সর্বনিম্ন ছিল সিপিইজেড মোড়ে ৭৭ দশমিক ৫০ ডেসিবেল। অন্যদিকে অক্সিজেন মোড়ে ৮০ দশমিক ৫০, আগ্রাবাদ মোড়ে ৭৯ দশমিক ৫০, বহদ্দারহাট মোড়ে ৮১ দশমিক ৫০ ও একে খান মোড়ে ৭৯ দশমিক ৫০ ডেসিবেল, মুরাদপুর একুশে হাসপাতালের সামনে ৭৩ দশমিক ৫০ ও মেহেদীবাগ ম্যাক্স হাসপাতালের সামনে ৭৬ ডেসিবেল মাত্রার শব্দদূষণ পেয়েছে পরিবেশ অধিদফতর।

মাত্রাতিরিক্ত শব্দে মানসিক ক্লান্তি ও অবসাদসহ বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয় জানিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যলয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মো. শাহীনুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, অধিক শব্দ দূষণের ফলে মাথা ব্যথা, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার মত সমস্যায় ভুগে মানুষ। যা পরবর্তীতে উচ্চ রক্তচাপ বা হৃদরোগ সহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তাই শব্দদূষণ রোধে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। শুধু তা-ই নয়, প্রশাসনকে আইন প্রয়োগে আরও কঠোর হতে হবে। দূষণ সৃষ্টিকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আইন মানতে বাধ্য করতে হবে।  

এদিকে শব্দদূষণ প্রতিরোধে প্রশাসনের উল্লেখযোগ্য তেমন উদ্যোগ না থাকলেও পরিবেশ অধিদফতরের দাবি, প্রতিনিয়ত অভিযানে জরিমানা ও মামলা দায়ের করা হচ্ছে।  

পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মুফিদুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আনতে আমরা বিভিন্ন স্পটে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছি। এতে উচ্চশব্দ সৃষ্টিকারী হাইড্রোলিক হর্ন জব্দ করে জরিমানা করা হয়। হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করা প্রায় গাড়ি হলো প্রভাবশালীদের। এতে জরিমানা আদায় করতে আমাদের বেগ পেতে হয়। কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বহনকারী একটি গাড়ির অতি উচ্চমাত্রার হাইড্রোলিক হর্ন জব্দ করে জরিমানা করায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষ ‘ক্ষমতা’দেখানোর মতো ব্যবহার করেছেন। বিষয়টি দুঃখজনক।

তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার বন্ধে ৮০টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। জব্দ করা হয় ৬৫০টি হর্ন। কিন্তু তারপরও হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।  

শব্দদূষণ বন্ধে বিধিমালায় উল্লেখিত শাস্তি ও জরিমানার পরিমাণ যুগোপযোগী কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিধিমালা ২০০৬ এ যে শাস্তি দেওয়া আছে তা খুবই নগন্য। তাই আমাদের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর বিভিন্ন ধারা অনুসরণ করে জরিমানা করতে হয়। বিধিমালাটি বাস্তবসম্মত করা জরুরি।  

আরও >>> শব্দদূষণ বন্ধে প্রতিবাদ: নিঃসঙ্গ সুজনের পাশে নেই কেউ

বাংলাদেশ সময়: ১৪১৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০২২
এমআর/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।