ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

সব ভুলে বই উৎসবে মেতেছেন কলকাতাবাসী

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২৩
সব ভুলে বই উৎসবে মেতেছেন কলকাতাবাসী

কলকাতা: কলকাতার আকাশে সন্ধ্যা নেমেছে সবে। উজ্জ্বল আলোর নিচে ঝলমল করছিল বইমেলা প্রাঙ্গণ।

মেলার মাঠে ঢোকার মূল তোরণগুলির নিচে ব্যস্ত তখন কলকাতা পুলিশ। মেটাল ডিটেক্টটর দিয়ে তৈরি গেট মেশিন অবিরাম বেজে যাচ্ছে। কারণ, তার মধ্যদিয়ে তখন মানুষের জনস্রোতে। বইমেলা প্রাঙ্গণজুড়ে তখন জনজোয়ার।  

রোববার (৫ ফেব্রুয়ারি) সাপ্তাহিক ছুটির অবকাশটুকু হাতছাড়া করতে চাননি কেউই। শীতের বিদায় আর বসন্তের আগমনী হাওয়ায় মাখা বই উৎসবে এটুকুর জন্যই তো সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন কলকাতার বইপ্রেমীরা। জনসংখ্যা কত? বইমেলার আয়োজক পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ডের সম্পাদক ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়ের তথ্য, সন্ধ্যা পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছে।

লাখো মানুষ যখন বইমেলার আঁকাবাকা পথে হাঁটছিলেন, তখন মনে হচ্ছে, কোনো নেশার টানে তাঁরা স্রোতের মত এগিয়ে যাচ্ছেন। পাথরে ধাক্কা খাওয়ার মত তাঁরা থামছেন বিভিন্ন বইয়ের স্টলের সামনে। তাঁদের বেশিরভাগের হাতেই ছিল বইয়ের ঝোলা। সেসব ঝোলায় বিপনীতে প্রকাশকের নাম। নামজাদা বইওয়ালাদের পাশাপাশি ছিল অনেক অনামী প্রকাশনাও।

ডিজিটাল বইয়ের রমরমা বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু, দুই মলাটের মধ্যে থাকা বইয়ের জগতে যে এখনও ঘুণ ধরেনি, বরং তা আরও সতেজ হয়েছে, তার প্রমাণ দিচ্ছিল ৪৬তম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা। শুধু নতুন বই নয়, বাংলাদেশ প্যাভেলিয়ানের কাছে পুরনো বইয়ে আশ্রয় খুঁজছিলেন অনেকে। বহু প্রবীণ মানুষ এসেছিলেন মেলায়। কেউ হুইল চেয়ারে, কেউ বা অপরের কাঁধে ভর দিয়ে। কিন্তু দমেননি এতটুকু। বই দেখার ফাঁকে ফাঁকে তাঁদের মধ্যে কেউ ক্যুইজে অংশ নিলেন, কেউ বা নতুন প্রজন্মের সঙ্গে গানের কলিতে গলা মেলালেন। প্রবীণ-নবীনে গাঢ় হলো বন্ধুত্ব।
   
রোববার যে মানুষের জনস্রোত নামবে তার আন্দাজ পাওয়া গিয়েছিল বইমেলা খোলার সময় থেকেই। নিরাপত্তার বেষ্টনীতে মেলা প্রাঙ্গণ উন্মুক্ত থাকলেও স্টলগুলো খোলে দুপুর ১২টা থেকে। এদিন তারও অনেক আগে থেকে নামিদামি স্টলের সামনে পাঠকের লম্বা লাইন। কলকাতা পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্তা মেলা প্রাঙ্গণে ঢুকেই তার জুনিয়রকে নির্দেশ ‘... আরিব্বাস, এত লাইন। আর সময় পাবে না। লাঞ্চ করে নাও। ’

প্রথমবার বইমেলায় এসেছেন বেনাপোল মিউনিসিপালিটির সাবেক মেয়র আশরাফুল আলম লিটন। তার অভিমত, আজকের বইমেলা বলে দিচ্ছে ডিজিটাল যুগেও বইয়ের পাঠক একই রকম রয়ে গেছে। সব থেকে ভালো লাগছে স্টলের বাইরে পাঠকের লম্বা লাইন। তারা সিরিয়াল দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নির্দিষ্ট বই সংগ্রহ করার জন্য। বইয়ের প্রতি তাদের কতটা আগ্রহ সেই চিত্র ফুটে উঠছে। সামগ্রিক পরিবেশটা অসাধারণ মনোমুগ্ধকর। অনেক সময় মেলা হয়ে ওঠে কফি-ফুচকা-আড্ডার জায়গা। কিন্তু আমি ঘুরে দেখলাম, সেই সংখ্যাটা কলকাতা বইমেলায় অনেক কম। তারা চা খাচ্ছেন, আড্ডা মারছেন কিন্তু, সবার হাতেই বইয়ের প্যাকেট। এর থেকে বোঝা যায় পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বই ভোলেননি।

তাঁর প্রথমবার আসা নিয়ে বলেন, আসলে পশ্চিমবঙ্গের প্রতি আমাদের একটা ভালো লাগার জায়গা থাকে। মনে হয় এটা আমাদেরই জায়গা। এটা যেন আমারও ভূমি। এ ভূমির পবিত্রতা আমি টের পাই। আমাদের পূর্বপুরুষের আবাসস্থল এইভূমিতেও। একই ভাষার বই, একই ভাষার লেখক-দুই বাংলার, বাংলা ভাষার বই পড়েই বড় হয়েছি। সুতরাং একুশের বইমেলা আর কলকাতার বইমেলার মধ্যে আমি তফাৎ দেখি না। যদিও কলকাতা একটা আন্তর্জাতিক বইমেলা। ফলে এর অবয় অন্যরকম এবং অনেক সুন্দর। বিশেষ করে এখানে পাঠকের উপস্থিতি। আসলে বইয়ের শক্তি অপরিসীম। জীবনানন্দ দাশ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কবিগুরু এদের সৃষ্টি গ্রহণ করে আমরা বড় হয়েছি। কখনোই বিচার করিনি এরা কোন বাংলার লেখক। মনে থাকে শুধু, এনারা বাঙালি লেখক এবং বাংলার লেখক।

আমি সবসময় মনে করি আমাদের ভূমি অভিন্ন, ভাষা অভিন্ন, খাবার অভিন্ন এবং ভাষা অভিন্ন। ভাষার একটা শক্তি আছে। দুই বাংলা নিয়ে বেনাপোল বর্ডারে আমি একুশের মঞ্চ করি। সেখানে দুই দেশ বলতে পারেন, দুই বাংলা মিলিয়ে ৫০ থেকে ১ লাখ লোক হয়। সেখানে ভাষার কাছে তাঁরকাটার কোনো শক্তি থাকে না। আমি মন থেকে সবসময় প্রার্থনা করি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা অমর হোক।  

শুধু তিনি নন, মেলাকে কেন্দ্র করে এখন বহু বাংলাদেশি। তবে মেলার ভিড় আর রোদ্দুর কষ্ট বাড়াচ্ছিল বহু মানুষকে। তাই বইয়ের সঙ্গেই যতটা বিক্রি হল ফিশফ্রাই, চিকেন পাকোড়া তার চেয়ে অনেক বেশি বিকোলো আইসক্রিম, লাচ্ছি, কোল্ড ড্রিঙ্ক, ফ্রুট জুস। তবে পানি কিনে খেতে হয় না। রাজ্য সরকারের তরফে বিনামূল্যে পানির পাউচের বাস্কেট সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা আছে। সেসবের মধ্য দিয়ে শীতল খুঁজলেন বহু মানুষ। কিছুটা জিরিয়ে ফের নতুন উদ্যমে মাঠে নামলেন তারা। বইয়ের স্টলে যাওয়ার দীর্ঘ লাইন। মেলা ফিরতিদের বাস ধরতে নাকানি-চোবানি খাওয়া, খাবারের স্টলে অপেক্ষা, কার পার্কিং সমস্যা আর বইমেলার মাঠজুড়ে গুতোগুতির মধ্যেও মানুষের হাসিমুখ জানান দিচ্ছিল, এ উৎসব চিরন্তন। বই উৎসব জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সবার। আর তো মাত্র হাতে কটা দিন। এরপরই তো বিদায়...।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০২৩
ভিএস/আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।