কলকাতা: ঈদ হোক বা পূজা, কেনাকাটা মানে কলকাতার নিউ মার্কেট। উৎসবমুখর বাঙালি মানে এ অঞ্চলে কেনাকাটার ভিড়ে তৈরি হয় জনজোয়ার।
বলা চলে এ অঞ্চলে, শ্রীলেদার্স এর সড়ক ধরে অপর প্রান্তে খাদ্য ভবন পর্যন্ত বা তার বিপরীতে সিটিমার্ট এলাকার দোকান, ফুটপাতে তৈরি হয় জনজোয়ার। আর এই ভিড়ে সুযোগ নেয় অপরাধ জগতে যুক্ত কিছু গ্যাং।
খেয়াল করে দেখবেন, আপনি কেনাকাটায় মশগুল। কিন্তু, উচ্চস্বরে এমন কিছু শব্দ হঠাৎ কানে ভেসে এলো যা শুনতে আপনি অভ্যস্ত নন। অর্থাৎ শব্দগুলো অচেনা বা কানে লাগার মতন। যেমন ভাবুন, হঠাৎ আপনার পাশ দিয়ে অচেনা কেউ আপনার বিপরীতমুখী মানুষটাকে বলে উঠল ‘ডাব্বা, ডাব্বা’! আসলেই যা আপনার অচেনা। কিন্তু, এটা শুধুই শব্দ নয়, এটা অপরাধীদের ‘কোড ল্যাঙ্গুয়েজ’! এই ডাব্বা মানে দামি বা আইফোন জাতীয় মোবাইল।
এছাড়া আছে, কাওয়া, লালি, তিন আঁখে বা আরও দুর্বোধ্য শব্দ। এসব শব্দের মাধ্যমে অপরিচিত পুরুষ বা নারীটিকে কী বোঝাতে চাইছেন, তা ভাবার আগেই আপনাকে নিজের পকেট বা মানিব্যাগ এবং মোবাইল সামলাতে হবে। নাহলে কিছুক্ষণ পর টের পাবেন, কেনাকাটার মুখে ‘সর্বনাশ’ করে দিয়েছে পকেটমার। এসব শব্দ আসলে বিদেশি বা ভিন রাজ্যের কোনো আঞ্চলিক ভাষা নয়। এসব অপরাধীদের ‘কোড ল্যাঙ্গুয়েজ’ অর্থাৎ নিজেদের বানানো ভাষা।
কোনো গ্যাং-এর কাছে দামি স্মার্টফোনকে বলা হয় ‘কানপাট্টি’। কেউ আবার ‘ডাব্বা’ বা ‘কাওয়া’র মতো শব্দের মাধ্যমে ভিড়ে মিশে থাকা সহকারীকে বুঝিয়ে দেয়। যেমন, তিন লেন্সযুক্ত ক্যামেরা মোবাইলকে গ্যাং-এর সদস্যরা বলে থাকে ‘তিন আঁখে’। ‘সুতো’ মানে স্বর্ণের হার। ‘লালি’ মানে স্বর্ণ। ‘তাস’ মানে ব্লেড। চেরাই মানে পকেট কাটা বা নগদ অর্থ হাতানো। অথবা ওয়াইফাই যুক্ত ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড। এ ধরনে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড এখন অত্যাধুনিক। অর্থাৎ সোয়াইপ মেশিনে পাঞ্চ করলে পিন নম্বরের প্রয়োজন হয় না। কেনাকাটা করে বিল মেটানোর সময় যন্ত্রটিতে স্পর্শ করা মাত্র বিক্রেতার কাছে চলে যায় প্রাপ্য অর্থ।
এই ধরনের একটি কার্ড আপনি মানিব্যাগে রেখেছেন বা লেডিস পার্সে ঝুলিয়ে মনমতো দোকানে প্রবেশ করার কথা ভাবছেন। সেইমত দূর থেকে কোনো গ্যাং আপনাকে ফলো রেখেছে এর আগে আপনি কোন দোকানে এ ধরনের কার্ড ব্যবহার করেছেন। আপনি যখন পথে। কানের পাশ দিয়ে এলো একটাই শব্দ ‘চেরাই কর দে’। মুহূর্তে সোয়াইপ মেশিন আপনার মানি ব্যাগ বা পার্স স্পর্শ করে গেল। যতক্ষণে আপনার মোবাইল ম্যাসেজে ভেসে ওঠা টাকার অঙ্ক দেখে ভেবে কুল পাবেন না। ততক্ষণে সবশেষ!
কলকাতা পুলিশের প্রধান সদর দপ্তর লালবাজার থানা বলছে, ঈদ, বড়দিন বা পূজোয় জমিয়ে শপিং করুন, সমস্যা নেই। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে সতর্ক থাকুন। দূরত্ব বজায় রাখুন এবং চোখ-কান খোলা রাখুন। কারণ, শীতকালীন পরিযায়ী পাখির মতো যেকোনো উৎসবের মুখে ভিন রাজ্য থেকে এসব গ্যাংদের আগমন ঘটে কলকাতায়। ওরা আসে উৎসবমুখর মানুষের পকেট কাটতে। তাই একটু অন্যমনস্ক হলেই বিপদ।
লালবাজারের পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কাছে এসব সাংকেতিক ভাষা নতুন কিছু নয়। বানজারা, ইরানি, সাউথ ইন্ডিয়ান, গুজরাট গ্যাং, ঝাড়খণ্ড, বিহার গ্যাংয়ের মতো ভিন রাজ্য বা প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা পকেটমার, লিফটার, কেপমারদের অনেক সময় ‘সোর্স’ বানিয়ে অনেক সময় অপরাধের কিনারা করেন পুলিশের গোয়েন্দারা। সব মিলিয়ে এসব সাংকেতিক শব্দে গোয়েন্দারাও রপ্ত হয়ে গিয়েছে।
সেই সূত্রে পুলিশের সতর্কবার্তা, এসব নিরীহ শব্দ বা শব্দবন্ধ কানে এলেই সাধারণ জনতা যদি সচেতন হয়ে যায়, তাহলে ব্যর্থ হবে দুষ্কৃতীরা। কীভাবে সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করে কাজ হাসিল করে পকেটমাররা? উদাহরণ দিয়ে এক পুলিশ কর্তা বলেছেন, ধরুন, ভিড়ের মধ্যে আপনি শুনতে পেলেন, ইয়ার ছোটু দেখ দেখ, উসকা মে কাগজ হ্যায়। তাস লাগা দে। এর অর্থ, ছোটু ওই লোকের সঙ্গে অনেক নগদ অর্থ আছে। ব্লেড দিয়ে পকেট কেটে দে।
এছাড়াও উৎসবের ভিড়ে পুলিশ কর্তাদের রীতিমতো মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে ভিন রাজ্য থেকে আসা সুন্দরীদের গ্যাং। লাল বাজার সূত্রে যায়, গুজরাট এবং দক্ষিণ ভারত থেকে আসা এসব গ্যাংয়ের সুন্দরীরা ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে পুরুষদের কার্যত প্রলুব্ধ করে কাছাকাছি আসার জন্য। সেই টোপ গিলে তরুণীদের ধারেকাছে ঘেঁষলেই সুকৌশলে মোবাইল, মানিব্যাগ হাতিয়ে নিতে একটুও দেরি করে না তারা।
তাই কলকাতা পুলিশের অভিমত, পূজো হোক বা ঈদ। অবশ্যই আনন্দ করে নিজের এবং পরিবারের জন্য কেনাকাটা করবেন। তবে উৎসবমুখর শহর কলকাতায় পথে-ঘাটে চোখ-কান খোলা রাখুন এবং দূরত্ব বজায় রাখুন। তবেই সমস্যা মোকাবেলা করা যাবে। বিশেষ করে, দুর্গা পূজায় যে পরিমাণ ভিড় কলকাতার নিউমার্কেটে হয়, তা সারাবছর হয় না। তবে সতর্ক থাকলে সমস্যা হয় না।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০২৩
ভিএস/এসআইএ