কলকাতা: ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা’ কবিগুরু নিজেই হারিয়ে যেতে চেয়েছিলেন বন্ধনহীন প্রকৃতির বুকে। কিন্তু পরলোক গমনের এত বছর পেরিয়ে গেলেও সমানভাবে প্রত্যেক বাঙালির হৃদয়ে বেঁচে আছেন তিনি।
তার প্রতিটি জিনিসকে সাজিয়ে গুছিয়ে সংরক্ষণ করেছে বাঙালিরা। কিন্তু সত্যি কী তাই! এই প্রশ্ন তুললে রে রে তেড়ে আসতে পারেন অনেকেই!
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তীর প্রাক্কালে তার বসবাস করা কিছু বাড়ির ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে নানা অভিজ্ঞতা হয়েছে।
সবাই জানি, কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি ছাড়াও আরও কয়েকটি বাড়িতে কিছু দিন করে থেকেছেন কিংবা তার সৃষ্টির কাজ করেছেন বিশ্বকবি।
গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গে বিশ্বকবি বসবাস করেছেন এমন ৫৭টি ঠিকানার সন্ধান পেয়েছেন গবেষকরা। এরমধ্যে কলকাতায় রয়েছে ১৬টি ঠিকানা। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের উত্তর অংশের পাহাড় অঞ্চলে ১৪ এবং রাজ্যের দক্ষিণে পেয়েছেন ২৭ টি বাড়ি।
বিশ্বকবির বাড়িগুলোর অবস্থা কী-তা জানতেই ২৫শে বৈশাখ বিশ্বকবির জন্মদিনের প্রাক্কালে কলকাতায় চষে বেরিয়েছে বাংলানিউজ।
আর এতে সহযোগিতা করেছে রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি দফতর ও নানা মানুষ।
কলকাতার বুক থেকে কর্পূরের মতো উড়ে গেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত বেশ কয়েকটি বাড়ি। অবাক করার মতো বিষয় হল- কিছু ঠিকানায় এরইমধ্যে নতুন বাড়িও তোলা হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী এবং তিনি নিজে ‘রাজা ও রাণী’ নাটকে এক সঙ্গে মঞ্চে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তারা। আর সেটিই ছিল মৃণালিনী দেবীর জীবনে প্রথম এবং একমাত্র মঞ্চে অবতীর্ণ হওয়া।
এই নাটকে বিক্রমের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নারায়ণীর ভূমিকায় ছিলেন মৃণালিনী দেবী।
বিভিন্ন সূত্র জানায়, কলকাতার রবীন্দ্র সদনের কাছে সেন্ট পলস চার্চের পাশের বাড়িটি ভাড়া দিয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই বাড়িতে একসময় নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন কবিগুরু।
তবে পুরো এলাকায় অনুসন্ধান চালিয়েও ইতিহাস প্রসিদ্ধ বাড়িটির খোঁজ পাওয়া যায়নি। এমন কিছু পাওয়া যায়নি, যা দেখে ‘কবিগুরু কোন সময়ে এই বাড়ি’তে নিয়মিত আসতেন তা অনুমান করা যায়।
চার্চের পাশেই জহরলাল নেহেরু শিশু মিউজিয়াম, এরপাশে মেট্রো রেলের কাঠামো আর কলকাতা ট্রাফিক পুলিশের দফতর। কোনভাবেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সঠিক জবাব দিতে পারেনি।
তবে কী সময়ের গহ্বরে হারিয়ে গেল- কবিগুরুর স্মৃতি বিজড়িত সেই বাড়িটি। হয় তো তাই!
চার্চের সেই বাড়িটির ঠিক বিপরীতে ‘ক্যলাকাটা ক্লাব’। যে জমিতে ক্লাবটি গড়ে উঠেছে সেই জমিটি ইন্দিরা দেবীর স্মৃতি বিজড়িত। যা ক্লাবের কফি টেবিলে রাখা বইয়ের লেখা নজরে আসতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই খাতায় লিখেছেন, কবিগুরু কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় নানা সময় কাটিয়েছেন। সেই জায়গাগুলোর তার সৃষ্টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
ক্যালকাটা ক্লাব-এর কফি বুকে বিখ্যাত শিল্পী সুভাপ্রসন্ন লেখেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্পী মন কখনই তাকে এক জায়গায় বদ্ধ হয়ে থাকতে দেয়নি।
রবীন্দ্র ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সৌভিক মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক পার্থ শঙ্কর মজুমদার এবং অধ্যাপক রামানুজ মুখোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের হেরিটেজ কমিশনারের কাছে তারিখ এবং বিভিন্ন প্রমাণসহ কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ অবস্থান করেছেন এমন বেশ কয়েকটি ঠিকানার তালিকা জমা দিয়েছেন।
এরমধ্যে রয়েছে কলকাতার পার্ক স্ট্রিট অঞ্চলের তিনটি ঠিকানা। এগুলো হচ্ছে- ৪৯ পার্ক স্ট্রিট, ৫০ পার্ক স্ট্রিট এবং ৫২/২ পার্ক স্ট্রিট। কিন্তু টানা সাড়ে চার ঘণ্টা চেষ্টা করেও এসব ঠিকানা পাওয়অ যায়নি।
অবশেষে বাধ্য হয়ে সাহায্য নিতে দ্বারস্থ হতে হয় পুলিশের। স্থানীয় পার্ক স্ট্রিট থানার সেরেস্তায় বেশ আন্তরিক চেষ্টা করেন পুলিশ কর্মকর্তারা। কিন্তু তারাও হদিস দিতে পারলেন না। তাদের বলা জায়গাগুলিতে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেল না এই বাড়ি তিনটি।
৪৯ পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে বসে ‘গীতবিতান’ এবং ‘মায়ার খেলা’-তে সুর দিয়েছিলেন কবিগুরু।
তবে কী আগের বাড়িটির মতোই তিলোত্তমী কলকাতার বুক থেকে মিলিয়ে গেল ৪৯ পার্ক স্ট্রিট ,৫০ পার্ক স্ট্রিট এবং ৫২/২ পার্ক স্ট্রিট। তবে কিছুটা হতাশা দূর করলো- কলকাতার নিউ মার্কেট অঞ্চলের সদর স্ট্রিট।
১০ নম্বর সদর স্ট্রিট। এই বাড়িতে বসে বিশ্বকবি লিখেছিলেন ‘নির্জরের স্বপ্নভঙ্গ’। এখানে বহুদিন বসবাস করেছেন কবিগুরুর দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাদম্বরী দেবী।
বিভিন্ন হাত বদল হয়ে সেটি এখন একটি হোটেল। তবে কবিগুরুর স্মৃতিতে সেখানে একটি নাম ফলক স্থাপন হয়েছে। আছে একটি আবক্ষ মূর্তিও। সেখানেই যদিও জন্ম দিনের নিয়ম রক্ষার ফুল ও মালা প্রতি বছরের মতো এবারও পড়েছে।
আর্ট কলেজের বাড়িটির অধ্যক্ষের কোয়ার্টারে বেশ কিছুদিন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। যা বেশ যত্ন করে রাখা হচ্ছে।
১৪ লোয়ার সার্কুলার রোড় এবং ২৩৭ লোয়ার সার্কুলার রোডের দুটিতে বিয়ের পরই মৃণালিনী দেবীকে নিয়ে বসবাস করেন রবীন্দ্রনাথ। এই বাড়ি দুটি থেকেই কাছের লরেটো হাউজ বিদ্যালয়য়ে পড়তে যেতেন মৃণালিনী দেবী। এ বাড়িতে বসেই তিনি লিখেন ‘ছবি ও গান’।
এখন এই রোডের নাম বদল হয়ে হয়েছে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বোস রোড। এখানকার বাড়িটি এখন স্থানীয় পুলিশের দফতর হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এদিকে কয়েকজন রবীন্দ্র গবেষক বিশ্বকবির নানা বিষয় নিয়ে গবেষণার চেষ্টা চালাচ্ছেন, যা খুবই আশার কথা। কিন্তু সময়ের গ্রাস থেকে রবীন্দ্রনাথের আবাসগুলো পাওয়া খুবই কঠিন।
এভাবেই হয়তো সংরক্ষণ আর তদারকির অভাবে একদিন কলকাতার বুক থেকে মুছে যাবে বিশ্বকবির স্মৃতি বিজড়িত ঠিকানাগুলো। তিনি লিখেছেন- ‘ফিরিবার পথ নাহি; দূর হতে যদি দেখ চাহি/পারিবে না চিনিতে আমায়।
হে বন্ধু, বিদায়। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪০ ঘণ্টা, মে ০৯, ২০১৫
বিএস/এমএ