কলকাতা: শ্রাবণ সন্ধ্যায় কলকাতার রোটারি সদনে কল্যাণী কাজির চোখের কোনে জমা হল বৃষ্টি। গলা বারবার ভিজে গেল বেদনার আদ্রতায়।
কেমন ছিল কবির শেষ জীবন? বলতে গিয়ে টুকরো স্মৃতি উঠে এলো কল্যাণী কাজির কথায়। যে স্মৃতি একবারে পারিবারিক, ব্যক্তিগত। যা হয়ত কোন দিনই জনসমক্ষে আসা সম্ভব ছিল না। কিন্তু শনিবার(৮ আগস্ট) নজরুল ভক্তদের আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সেই সব পারিবারিক স্মৃতির ঝাঁপি মেলে ধরলেন কল্যাণী কাজী।
‘আজকাল কেউ খুব একটা শুনতেও চায় না, তাই আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করলাম। মনটা ভাল লাগলো। ’- শ্রোতাদের বললেন কল্যাণী কাজী। কিন্তু কি সেই স্মৃতি যা তিনি সমস্ত নজরুল ভক্তদের জানাতে চান। খুব পরিকল্পনা মাফিক একেবারেই নয়, কথার পিঠে উঠে আসা কথার মধ্যে দিয়ে হাজির আর্দ্রতায় ভেজা সেই সব স্মৃতি।
সারা জীবন দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করেছেন কবি নজরুল ইসলাম। একটা সময় যখন কবি পরপর লিখে চলেছেন গান। কারণ কবিতা লিখে তো আর পেট চালানো যায় না। সেই সময় কবির এক গুণগ্রাহী তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘কেন কবিতা লেখা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন?’
কবি হাসলেন, তাকে বললেন- কবিতা লিখে কিছু উত্তরীয় আর মালা পাওয়া যায়। আমারও তো সংসার আছে। আমি কি ঐ মালার দড়িগুলি জড়িয়ে গলায় দেব? এই মর্মবিদারক কথা জানালেন কল্যাণী কাজী।
একথাই শেষ নয়, গোটা অনুষ্ঠান জুড়ে ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর গান, কবিতা এবং স্মৃতি। এক পুত্রবধূর ব্যক্তিগত স্মৃতির সাগর থেকে একে একে উঠে আসছিল মনি-মুক্তা যা নজরুল প্রেমীদের কাছে অমূল্য।
৪২ বছর বয়সে অসুস্থ হয়ে পড়েন কবি। বন্ধ হয়ে যায় তার কথা বলার শক্তি এবং লেখার ক্ষমতা। প্রায় ঘর বন্দি হয়ে পড়েন তিনি। হারিয়ে ফেলেন সূক্ষ্ম বোধশক্তিগুলিও। এই সময়েই পুত্রবধূ হিসেবে কাজী পরিবারে আসেন কল্যাণী কাজী। সবাইকে চিনতে না পারলেও পরিবারের অনেককেই চিনতে পারতেন কবি। বিশেষ করে ছেলেদের।
স্নান করিয়ে দিতে হলেও একটা সময় পর্যন্ত সারা বাড়িতে খুব ধীরে ধীরে চলেফিরে বেড়াতেন কবি নজরুল।
সেই সময়ে তার একটি নতুন অভ্যাস তৈরি হয়। বাড়ির কোথাও কিছু পড়ে থাকলে সেটিকে তুলে নিয়ে আসতেন কবি। রেখে দিতেন নিজের বালিশের তলায়। এই রকমই একদিন ঘটে যায় একটি বিপদ। কবি ভুল করে একটি জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরো তুলে এনে তার স্বভাব মত বালিশের তলায় রেখে দেন। কিছুক্ষণ পরে ধোঁয়ায় ভরে যায় গোটা ঘর। সবাই ছুটে আসেন, আবিষ্কার হয় আগুনের উৎসস্থল।
কবির সঙ্গে এই টুকরো টুকরো স্মৃতির ঝাঁপি শ্রাবণ সন্ধ্যায় খুলেছিলেন কল্যাণী কাজী। কবির কথা উঠলো আর উঠবে না কবি পত্নীর কথা তা কি হয়! কল্যাণী কাজী জানালেন, কবির আগে থেকেই পক্ষাঘাতের শিকার হয়েছিলেন কবি পত্নী। তিনি হাঁটাচলা করতে পারতেন না। কিন্তু তার মধ্যেই প্রায় প্রতিদিন ঐ অশক্ত শরীরে পরিবারের জন্য সবজি কাটার কাজটি তিনি উৎসাহ নিয়ে করতেন। গোটা সংসারের প্রতি ছিল তার গৃহকর্তীর দৃষ্টি। কল্যাণী কাজী জানালেন, বিয়ের পর তিনি অনুভবই করতে পারেননি যে এমন একটি পরিবারে এসেছেন যেখানে দুই জন মানুষ অসুস্থ।
শনিবার বাংলা মাসের হিসেবে ছিল ২২ শ্রাবণ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ দিবস। বাংলা সমাজ জীবনে রবীন্দ্র–নজরুল শব্দ দুটি প্রায় এক লপ্তে উচ্চারিত হয়। খুব প্রাসঙ্গিক ভাবেই উঠে এলো কবিগুরুর সঙ্গে বিদ্রোহী কবির সম্পর্কের কথা। কল্যাণী কাজী জানালেন, কবি নজরুল ইসলাম ছিলেন তৎকালীন নবীন কবিদের ‘পাসপোর্ট’। রবীন্দ্রনাথকে কিছু জানাতে হলে অনেকেই নিজে সে কথা কবিগুরুকে বলতে সাহস পেতেন না। তার এসে ধরতেন নজরুলকে। কবি নজরুল ইসলামের মাধ্যমেই কবিগুরুর কাছে পৌঁছে যেতো তরুণ কবি-লেখকদের প্রশ্ন, অনুরোধ বা আবদার।
কথার শেষে কল্যাণী কাজী জানালেন, নজরুল প্রেমীদের সঙ্গে এই স্মৃতিগুলি ভাগ করে নিয়ে তিনি আনন্দ বোধ করছেন। আর এই টুকরো স্মৃতির মনি মাণিক্য ঐ প্রেক্ষাগৃহের বাইরে গোটা বিশ্বের নজরুল প্রেমীদের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব কাঁধে নিলো বাংলানিউজ।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৫ ঘণ্টা, আগস্ট ৯, ২০১৫
ভিএস/জেডএম