ঢাকা: জনমত সমীক্ষা ও বুথফেরত জরিপ, মিডিয়ায় ‘এক্সিট পোল’কে যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, ভোটের ফল প্রকাশের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তা নিয়ে সব সময়ই থাকে জল্পনা কল্পনা।
কোনো কোনো পূর্বাভাস পুরোপুরি মিলে যায় আবার কারও পূর্বাভাস কিছুটা এদিক ওদিক হতে পারে।
কিন্তু বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে দেখা গেল তেমনই এক নজিরবিহীন চিত্র। ওই নির্বাচন সামনে রেখে ভারতের বেশিরভাগ মূল ধারার সংবাদ মাধ্যম ও নামকরা জরিপ সংস্থাগুলোর তথাকথিত এক্সিট পোলের ফল ভোটের আসল ফলাফলের সামনে যেভাবে উড়ে গেল, তাতে প্রশ্নবিদ্ধ হলো ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের এক্সিট পোল প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাই।
যার জেরে নৈতিক দায়বদ্ধতা এবং মুখরক্ষার জন্য হলেও দুঃখ প্রকাশ করলেন সেদেশের নামজাদা নিউজ চ্যানেল এনডিটিভির প্রধান প্রণয় রায়।
এছাড়া আগেভাগেই ভোটের ট্রেন্ড বুঝে যাওয়ার দাবি করে কলাম লিখে কিংবা টকশোতে আলোচনা করে কিস্তিমাত করতে চান যে সব ‘বিশেষজ্ঞ’, তাদের কাছেও বিহার বিধানসভা নির্বাচন শিক্ষণীয় হয়ে রইলো।
এখন দেখা যাক, বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে আসলে কি এমন ঘটলো যার জেরে নাকানিচুবানি খেতে হলো তাবৎ বড় বড় মিডিয়াকে। এমনকি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করতে হলো ভারতের প্রতাপশালী মিডিয়া মোঘলদের একজনকে।
আসলে রোববার ভোট গণনার শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াতে শুরু করে ভারতীয় মিডিয়া।
মূল ধারার মিডিয়া হিসেবে পরিচিত এনডিটিভি, টাইমস নাউ, নিউজ এক্স, চানক্য, জি নিউজ বিজেপিকে এগিয়ে রাখতে শুরু করে। তবে সিএনএন আইবিএন নীতিশ-লালুর মহাজোটকে এগিয়ে রাখলেও আভাস দেয় হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের। সকাল এগারোটা পর্যন্ত বজায় থাকে এ ধারা।
ব্যতিক্রম ছিলো শুধু একটি অখ্যাত সংস্থা ‘এক্সিস এপিএম’। তারাই জানিয়ে রেখেছিলো মহাজোট পাবে ১৭০-১৮০ আসন, অপরদিকে বিজেপির ঝুলিতে যাবে ৫৮-৭০টি আসন।
এমনকি ভারতের খ্যাতনামা রাজনৈতিক জরিপ সংস্থা টুডেস চানক্য, যারা গত লোকসভা নির্বাচনের আগে ঠারে ঠারে সঠিক পূর্বাভাস করে বাজিমাত করেছিলো তারাও বিপুল আসনে এগিয়ে রেখেছিলো বিজেপিকে। তাদের জরিপে বিজেপি জোটের জেতার কথা ১৪৪-১৬৬টি আসনে। আর লালু-নীতিশের ভাগে পড়ে মাত্র ৬০টি।
এনডিটিভির প্রণব রায়ও বলেন, ‘এই ট্রেন্ড বজায় থাকলে বিজেপি জোট অন্তত ১৪৫টি আসন পাবে।
মিডিয়ার এসব প্রচারণায় জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হয়ে রোববার সকালে পাটনা ও দিল্লিতে বিজেপির সদর দফতরের সামনে বাজি ফোটাতে শুরু করেন নেতাকর্মীরা। বিতরণ হয় মিষ্টি,লাড্ডু। অর্ডার দেয়া হয় কচুরি-সিঙ্গারার।
কিন্তু বেলা এগারোটার পর যখন অধিকাংশ কেন্দ্রেরই ভোট গণনার ফলাফল আসতে শুরু করলো তখন পাল্টে গেল পুরো চিত্র। ভারতের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল ও ওয়েবসাইটগুলোতে এগিয়ে থাকা বিজেপি ও পিছিয়ে থাকা মহাজোটের মধ্যে ব্যবধানের পারদ কমতে থাকলো ক্রমশই। ফাঁকা হতে শুরু করলো বিজেপির অফিস, ভিড় বাড়লো দিল্লির আকবর রোডের কংগ্রেস অফিসে। দিন শেষে ফলাফল তো সবারই জানা।
পুরো ব্যাপারটিতে ভোট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন ঘটনা নজিরবিহীন। ভোট বিশেষজ্ঞ ও প্রাক্তন আম অাদমি পার্টির নেতা যোগেন্দ্র যাদবের মতে ‘এমন অসামঞ্জস্য এই প্রথম’।
তবে একটি সূত্রের দাবি পোস্টাল ব্যালট যখন গোনা হচ্ছিলো তখন বিজেপি জোটই নাকি প্রাথমিকভাবে এগিয়ে ছিলো। সেই প্রবণতা ধরে নিয়েই চ্যানেলগুলো সম্প্র্রচার শুরু করে। কিন্তু ইলেক্ট্রিক ভোটিং মেশিনে গণনা শুরু হতেই ছবিটা পাল্টে যায়।
আরেকটি সূত্রে খবর, প্রায় সবগুলো মূল ধারার ভারতীয় চ্যানেলই নাকি একটি সংস্থার সরবরাহ করা তথ্যের ভিত্তিতে ফলাফল প্রকাশ করেছিলো। তাদের ভুলেই নাকি এই গড়মিল। ‘
যাই হোক, দিন শেষে মেলেনি টুডেজ চাণক্য, এনডিটিভি, ইন্ডিয়া টুডে সহ কারও ট্রেন্ডই। আসন সংখ্যা তো দূরের কথা। এমনকি মেলেনি হাড্ডহাড্ডি লড়াইয়ের পূর্বাভাসও।
ফলে শেষ পর্যন্ত মুখ রক্ষার জন্য দুঃখপ্রকাশ করতে বাধ্য হলেন প্রণয় রায়। দুঃখ প্রকাশ করলো টুডেজ চাণক্যও।
রোববারের গড়মিলকে গত ৩২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভুল অভিহিত করে এনডিটির প্রণয় রায় বললেন, ‘ আমরা কখনও ভুল, কখনও ঠিক করেছি। কিন্তু এত বড় ভুল গত ৩২ বছরেও হয়নি।
যে এজেন্সি থেকে আমরা প্রথম দিকের পরিসংখ্যা পাচ্ছিলাম ভুল তাদেরই। কিন্তু আমরা দায়িত্ব এড়াতে পারি না। সেই সংস্থার কাছে জবাব চাওয়া হয়েছে। এক্সিট পোলের নমুনা সংগ্রহে কেন ভুল হয়েছে, জানতে চাওয়া হয়েছে তাও। ’
প্রণয় রায়ের এই বিবৃতি অবশ্য পাঠকমহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে। এনডিটিভির খানিকটা মুখরক্ষা হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।
কিন্তু বিহারের ভোটে ভারতীয় মিডিয়াগুলোর এক্সিট পোলের পূর্বাভাস যেভাবে মুখ থবড়ে পড়লো, তাতে স্বাভাবিকভাবে পুরো প্রক্রিয়াটিই যে বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্কটে পড়ে গেল সে কথা বলাই বাহুল্য।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৯, ২০১৫
আরআই