ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

স্কুল যাত্রার 'পুল কার'

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪২১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০১৬
স্কুল যাত্রার 'পুল কার' ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কলকাতা: কলকাতার বিদ্যালয়গুলোর ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিদিনের যাওয়া-আসার মাধ্যম হিসেবে বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে উঠেছে ‘পুল কার।
 
প্রতিদিন সকালে গরম চায়ের পরেই যে চারটি বিষয়ে কলকাতার সাধারণ মানুষ অপেক্ষা করেন, তার মধ্যে প্রথমটি খবরের কাগজ, দ্বিতীয়টি সকাল বেলায় বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া দুধের প্যাকেট, তৃতীয়টি কলকাতা পুরসভার ময়লা সংগ্রহ করতে আসা গাড়ির সাইরেন আর শেষটি পুল কারের হর্ন।



ছাত্র-ছাত্রীদের বিদ্যালয় যাওয়া এবং সেখান থেকে ফেরার বিষয়টি অনেক সহজ এবং ঝামেলাহীন করে দিয়েছে এই পুল কার।

তবে 'পুল কার' কলকাতায় বেশি দিনের সংযোজন নয়।  

নব্বইয়ের দশকেও পুল কারের কোনো অস্তিত্ব ছিল না কলকাতায়। ২০০৫ সাল নাগাদ কলকাতায় এই নতুন ধরনের পরিবহনের চল শুরু হয়। এর আগে আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বিদ্যালয়গুলো নিজস্ব স্কুল বাসের চল ছিল।

মূলত যেসব পরিবারে তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পৌঁছে দেওয়ার মতো লোকের অভাব ছিল বা যেসব পরিবারে বাবা এবং মা দুজনেই পেশাগত কারণে সন্তানকে পৌঁছে  দিতে সক্ষম ছিলেন না তারাই এই স্কুল বাসগুলোতে তাদের সন্তানদের যাওয়া-আসার ব্যবস্থা করতেন।

স্কুল বাসের চল অবশ্য এখনও আছে।

তখন প্রায় প্রতিটি বিদ্যালয়ের একটি, দু’টি বা তিনটি বাস থাকতো। সেগুলো শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের বিদ্যালয়ে নিয়ে আসতো। যেসব ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুল বাসে যাতায়াত করতো না তাদের বেশিরভাগ অভিভাবকরা দিয়ে আসতেন আবার নিয়ে আসতেন। একটু উঁচু শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীরা একাই সাধারণ পরিবহনে যাতায়াত করতো।  

২০০৫ সাল নাগাদ ধীরে ধীরে কলকাতায় জনপ্রিয় হতে শুরু করে 'পুল কার'। স্কুল বাসগুলোর কিছু সমস্যা ছিল। এ সমস্যাগুলোর জন্যই পুল কার খুব দ্রুত তার জায়গা 
করে নেয়।

স্কুল বাসগুলোর প্রথম সমস্যা ছিল সেগুলোর সংখ্যা ছিল অনেক কম। এর ফলে শহরের একটি অঞ্চলের মধ্যেই তাদের পরিষেবা সীমাবদ্ধ রাখতে হতো। এ কারণে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা কোনো একটি বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের এ পরিষেবা প্রদান করা সম্ভব ছিল না।

দ্বিতীয়ত একটি স্কুল বাসে অন্তত ৪০ থেকে ৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী যাওয়া-আসা করে। ফলে সকলকে বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দিতে অনেক সময় লাগতো। এর ফলে  ছাত্র-ছাত্রীদের বিদ্যালয় ছুটির বেশ কিছুক্ষণ পরে অনেক রাস্তা ঘুরে তবেই বাড়ি ফেরার সুযোগ হতো। এর ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা ক্লান্ত হয়ে পড়তো। এছাড়াও কোনো কারণে স্কুল বাস খারাপ হয়ে গেলে এতোগুলো ছাত্র-ছাত্রীর বিকল্প ব্যবস্থা করা দ্রুত করা প্রায় অসম্ভব।

এ সমস্ত সমস্যার সমাধান নিয়ে হাজির হয় পুল কার। কলকাতার যেসব পরিবারের সন্তানকে বিদ্যালয়ে দিয়ে আসার সুযোগ বাবা-মায়েদের নেই তাদের জন্য এটি একটি বড় সমস্যার সমাধান নিয়ে হাজির হয়েছে। শুধু কর্মরত বাবা-মা কেন, যেসব মায়েরা বাড়িতে থাকেন তাদের ক্ষেত্রেও অনেকটা সময় বাঁচিয়ে দিয়েছে এই পুল কার।

পুল কার সাধারণত চার চাকার ভাড়ার গাড়ি। এ গাড়িগুলোতে থাকেন একজন চালক এবং একজন সহযোগী। প্রতিটি পুল কারে গাড়িরই মাপ অনুযায়ী ৩ থেকে ৮ জন করে ছাত্র-ছাত্রী যাতায়াত করে থাকে। একটি নির্দিষ্ট সময় বাড়ির সামনে এই গাড়িটি চলে আসে এবং ছাত্র-ছাত্রীদেরকে গাড়িতে তুলে বিদ্যালয়ে পৌঁছে দেয়। ছুটির পরে আবার নিয়ে আসে বাড়িতে।

মাসে একটি নিদিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে এই পরিষেবা দিয়ে থাকেন পুল কার মালিকরা। এর ফলে যেমন বাবা-মায়েদের সময় বাঁচে, তারা চাকরি কিংবা অনান্য কাজ করতে পারেন, ঠিক তেমনই আর্থিক সাশ্রয় হয়।

পুল কারে নিজের সন্তানকে পাঠানোর বিষয়ে কলকাতার অভিভাবক দেবযানী মুখার্জি বাংলানিউজকে জানান, পুল কারের পরিষেবার ফলে তিনি নিজের চাকরি জীবন বজায় রাখতে পেরেছেন।

অশোক চক্রবর্তী জানান, পুল কারে সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠানোর সিদ্ধান্তের পেছনে দু’টি বিষয় কাজ করেছে। একদিকে সময়ের সাশ্রয়, অন্যদিকে সন্তানের  বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার কষ্ট লাঘব করা। কারণ, পুল কার মাত্র ৪-৫ জন ছাত্র-ছাত্রীকে নিয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করে। ফলে স্কুল বাসের মতো দীর্ঘক্ষণ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে তাদের বাড়ি ফিরতে হয় না। অন্যদিকে সাধারণ পরিবহনে শিশুরা একা বাড়ি ফিরতে পারে না। ফলে পরিবারের কাউকে সেক্ষেত্রে তাকে আনতে যেতে হয়। 'পুল কার' এসব সমস্যার সমাধান করেছে।

পুল কার মালিক সাগর সাহা জানিয়েছেন, সকালে ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে আসার পর দিবা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি বিদ্যালয়য়ে পৌঁছে দেন। ফিরতি পথে সকালের ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়িতে পৌঁছে দেন। আবার দিবা বিভাগের ছুটি হলে সেই ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি বাড়ি পৌঁছে দেন। বাকি সময় তিনি তার গাড়ি অন্য কাজে ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়া বিদ্যালয়ের ছুটির দিনগুলোতে ছুটি পান পুল কার মালিক বা চালকরা। সেসব দিনেও অন্য কাজে গাড়ি ব্যবহার করা যায়।

পুল কারকে আরও বেশি নিরাপদ এবং নিয়মের মধ্যে বেঁধে ফেলার জন্য বেশ কিছু নিয়ম তৈরি করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এর মধ্যে প্রশাসনের কাছে পুল কারের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিধি আরোপ করা হয়েছে পুল কারের নিরাপত্তার বিষয়েও। ছাত্র-ছাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে কড়া নজর দিয়ে সরকার আরও বেশ কিছু বিধি-নিষেধও জারি করেছে।

কিছু অভিযোগ যে নেই তা নয়। অনেক সময় ছোট ছোট অভিযোগ আসে। কিন্তু এ সমস্যাগুলোর সমাধান করে পুল কার কলকাতার নাগরিক জীবনে একটা বিশেষ জায়গা দখল করে পেরেছে তার উপযোগিতার দিকে।

শুধু তাই নয় 'পুল কার' ব্যবসা অনেক বেকার যুবককে উপার্জনের পথ দেখিয়েছে। ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে 'পুল কার। আর সন্তানদের বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার দায়িত্ব পুল কারকে দিয়ে সেই সময় পরিবার বা পেশাকে বেশি সময় দিতে পারছেন অভিভাবকরা।

বাংলাদেশ সময়: ০৪২২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০১৬
ভিএস/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।