ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ আশ্বিন ১৪৩১, ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ২৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

মহাকালের সাক্ষী আগ্রা দুর্গে বাজে বিরহের সুর

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ৮, ২০১৯
মহাকালের সাক্ষী আগ্রা দুর্গে বাজে বিরহের সুর

আগ্রা দুর্গ (আগ্রা, উত্তর প্রদেশ) ঘুরে: প্রিয়তমার প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে তাজমহল বানালেও একটিবারের জন্যও সম্রাট শাজহাজান এটিকে ছুঁয়ে দেখতে পারেননি, এমনকি মহলের প্রাঙ্গণে পা পর্যন্ত রাখতে পারেননি। এটি নির্মাণের একেবারে শেষ পর্যায়ে শাহজাহানকে বন্দি করে ফেলেন তার ‘ক্ষমতালিপ্সু’ পুত্র আওরঙ্গজেব। শাহজাহানকে রাখা হয় তাজমহলের আড়াই কিলোমিটার দূরে আগ্রা দুর্গে। গাইডের মুখে ইতিহাসের এই শ্রুতি শোনার পর কারও কারও মুখে যেন বিষাদের ছায়া পড়ে যায়। 

পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম এবং ভারতের সবচেয়ে বড় পর্যটন কেন্দ্র তাজমহল পরিদর্শন শেষে মধ্যাহ্নভোজ সেরে বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশন টু ইন্ডিয়ার শতজন চেপে বসলো সেই আগ্রা দুর্গ অভিমুখী গাড়িতে। স্বল্পসময়েই গাড়ি পৌঁছে যায় দুর্গের ফটকের পাশে।



মজবুত ও নান্দনিক শৈলীতে মুঘল স্থাপত্য সবসময়ই বিস্মিত করে। তবে আগ্রার লালরঙা দুর্গে চোখ পড়লে সে বিস্ময় যেন ঘোরে পরিণত হয়। উঁচু প্রাচীরবেষ্টিত দুর্গ। প্রাচীরের গায়ে ছোট ছোট ছিদ্র। বলা হয়ে থাকে, নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হলে এসব ছিত্র দিয়ে গরম তেল ঢেলে দেওয়া হতো। প্রাচীরের বাইরে প্রায় সবদিকেই গভীর খাদ। নিরাপত্তার প্রশ্নে যেন এক অজেয় দুর্গ হিসেবে গড়ে তোলা হয় এটিকে।
আগ্রা দুর্গের গঠনশৈলী।  ছবি: বাংলানিউজ
অমর সিং ফটক দিয়ে লাল ইট বিছানো পথ বেয়ে ডেলিগেশন টিম পা বাড়ায় দুর্গের ভেতরে। গাইড দেখিয়ে চলেন দুর্গের এপাশ-ওপাশ। মুঘলদের বাগানবিলাস ছিল। আগ্রা দুর্গেও দেখা গেলো সেই সুদৃশ্য বাগানবিলাসের নিদর্শন। একটি প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে দুর্গের নির্মাণ-ইতিহাস সম্পর্কে বাংলাদেশি ডেলিগেটদের প্রাথমিক ধারণা দেন নিবন্ধিত গাইড।

ইতিহাসের তথ্য, এই আগ্রার গোড়াপত্তন হয় ১৫০৪ সালে দিল্লির সুলতান সিকান্দার লোদীর হাতে। ১৫২৬ সালে লোদীদের সঙ্গে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার পর বাবর এই দুর্গে ওঠেন এবং মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে নিজেকে প্রথম সম্রাট ঘোষণা করেন। এরপর তার ছেলে হুমায়ুন ১৫৩০ সালে সম্রাট হিসেবে এখানেই অভিষিক্ত হন। আগ্রার অবস্থানগত গুরুত্ব বুঝে হুমায়ুনের ছেলে সম্রাট আকবর ১৫৫৮ সালে এটিকে রাজধানী ঘোষণা করেন এবং এই দুর্গ থেকে সাম্রাজ্য চালাতে থাকেন।

পরিস্থিতি বুঝে এটিকে আরও অজেয় বানিয়ে ফেলেন আকবর। ভেতরে পোক্ত ইট গেঁথে রাজস্থানের লালবেলে পাথরের আস্তরণে বিশাল পরিসরে গড়ে তোলেন আগ্রা দুর্গকে। প্রতিদিন ৪ হাজার কারিগর নিয়মিতভাবে কাজ করে আট বছরের মাথায় ১৫৭৩ সালে এই দুর্গের কাজ শেষ করে। তবে প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার বর্গমিটারের ওপর দুর্গটি বর্তমান যে নান্দনিক ও স্থাপত্যশৈলীর আকারে আছে, এই রূপ দেন আকবরের নাতি সম্রাট শাহজাহান। নানা যুদ্ধ-বিগ্রহের পর ১৬৩৮ সালে আগ্রা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরের আগ পর্যন্ত এটাই ছিল মুঘল সম্রাটদের প্রাসাদ। যদিও পরে ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের শাসনের সময় এই দুর্গের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। কালের গর্ভে হারিয়ে যায় অনেক ভবন। এমনকি কোথাও কোথাও ক্ষয়ে যায় এর নির্মাণকালীন নকশা-ইট-পাথর-সুরকিও।
আগ্রা দুর্গের গঠনশৈলী।  ছবি: বাংলানিউজ
দুর্গের ভেতরে আছে জাহাঙ্গীরের হৌজ, শাহজাহানি মহল, খাস মহল, বাবরের বাওলি, নাগিনা মসজিদ, দিওয়ান-ই-আম, গজনীন গেট, বাংলা মহল, আকবর মহল, মুতাম্মান বুর্জ ইত্যাদি। এরমধ্যে জাহাঙ্গীরের হৌজ হলো একটি ট্যাংক, সেটি সম্রাট জাহাঙ্গীরই বানিয়েছিলেন গোসলের জন্য। শাহজাহানি মহলকে মনে করা হয় সাদা মার্বেলে গোটা দুর্গ গড়ে তুলতে সম্রাট শাহজাহানের প্রথম পদক্ষেপের ফল। খাস মহল শাহজাহানের দুই কন্যা রওশনারা ও জাহানারার জন্য বানানো বিশেষ মহল।  

বাবরের বাওলি হলো পানির কূপ। নাগিনা মসজিদ হলো সাদা মার্বেলে তৈরি বিশেষ নামাজ ঘর, যা তৈরি করেছিলেন শাহজাহান। দিওয়ান-ই-আম হলো জনতার দরবার, এটিও তৈরি করেছিলেন শাহজাহান। বাংলা মহল সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, এটির নিচে দুর্গের অনেক গোপনীয়তা রক্ষিত থাকতো। আকবর বানালেও পরে এটিকে সংস্কার করেন শাহজাহান। আর লাল বেলেপাথরে বানানো আকবর মহলে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছিলেন সম্রাট আকবর।

খাস মহলের সামনের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে গাইড ডেলিগেটদের আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দেন শাহজাহানকে বন্দি রাখার সেই ভবন। খাস মহলের পূর্ব দিকে ভবনটির দিকে পা বাড়ায় সবাই। যমুনার একেবারে পাড়-লাগোয়া পূর্বমুখী এই প্রাসাদ অলঙ্কৃত শ্বেত মার্বেল দিয়ে তৈরি। সামনে থাকা পরিচিতিতে লেখা ‘মুতাম্মান বুর্জ’। পাঁচ দিক থেকে খোলা এই প্রাসাদে এমন ব্যালকনি রয়েছে, যা দিয়ে আড়াই কিলোমিটার দূরের ঝলমলে তাজমহল দেখা যায়।
আগ্রা দুর্গ থেকে তাজমহল।  ছবি: বাংলানিউজ
১৬৫৮ সালে সম্রাটের সিংহাসনে বসার লোভে শাহজাহানকে তার সন্তান আওরঙ্গজেব বন্দি করে এই ঘরেই নিক্ষেপ করে। এরপর যে আট বছর বেঁচেছিলেন, এই ‘মুতাম্মান বুর্জে’ই কন্যা জাহানারার সঙ্গে বন্দি হিসেবে কাটিয়েছেন শাহজাহান। বেড়াতে আসা দর্শনার্থীদের কাউকে কাউকে তখন মুতাম্মান বুর্জের ফাঁক গলে তাজমহল দেখার চেষ্টা করতে দেখা যায়। হয়তো হিসেব মেলাতে চাইছিলেন, ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের। প্রিয়তমা স্ত্রী আরজুমান বানু বেগম ওরফে মমতাজ মহলের বিয়োগে শোকাহত শাহজাহান তার স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে তাজমহলের মতো পৃথিবীর অন্যতম সেরা স্থাপনা বানিয়ে প্রায় শেষ করে ফেললেও তা একবার ছুঁয়েও দেখতে পারলেন না। আরজুমানের সমাধি ঘিরে বানানো তাজমহলকে টানা আট বছর তার দেখতে হলো এতো দূর থেকে এই ফাঁক গলে! 

মসনদ কি এতোটাই ক্ষমতাধর, ‘ভালোবাসাকে’ এভাবে বছরের পর বছর দূরে সরিয়ে রাখতে পারে? মসনদে ওঠার পথ সুগম করতে নিজের অন্ধ ভাই খসরু মির্জাকে খুন করা শাহজাহান নিজেও কি এই আত্মজিজ্ঞাসায় শেষ দিনগুলো কাটিয়েছিলেন? ইতিহাস-মহাকালের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে রইলেও এমন প্রশ্নে আগ্রা দুর্গে যেন বেজে চলেছে নৈঃশব্দ্যের করুণ সুর!

আরও পড়ুন
** যমুনাপাড়ের বিস্ময় ‘ঐশ্বরিক নিবাস’
** রামোজি ফিল্ম সিটি: এক পাড়াতেই দেশ-বিদেশ
** সালার জং জাদুঘর যেন এক দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহশালা

** সান্ধ্যকালীন সাউন্ড-লাইট শো নিয়ে গেলো গোলকোন্ডা যুগে
** উত্তম-সুচিত্রা-শাহরুখ-ঐশ্বরিয়াদের সঙ্গে লাঞ্চ!
** থিয়েটারে ঢুকেই নায়িকা কানেতা, ‘ফিল্ম’ তৈরি ১৫ মিনিটে!
** উষ্ণ অভ্যর্থনা-বর্ণিল আয়োজনে শতযুবাকে আপন করলো জেএনটিইউ
** কেক কেটে জাহানারার জন্মদিন উদযাপন করলো শতযুবা
** নাম লেখা হয়ে গেলো বিল ক্লিনটনের সঙ্গে
** মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ৩৮৪৩ ভারতীয় সেনার স্মৃতিরমিনারে
** মোহনীয় সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীর জয়গান
** ২৫শ বছরের ইতিহাসের জাদুঘরে বাজছে 'কারার ওই লৌহ কপাট'
** ভারতের সংসদে বাংলাদেশের শতযুবা
** মেঘের রাজ্যে মাথা উঁচিয়ে হঠাৎ হিমালয়
** নয়াদিল্লি পৌঁছেছে বাংলাদেশের শতযুবা
** ভারতের পথে ১০০ ‘বাংলাদেশি-বন্ধু’ 
** ১০০ ‘বাংলাদেশি-বন্ধু’ ভারত যাচ্ছে বৃহস্পতিবার
** ভারত যাচ্ছে আরও ‘১০০ বাংলাদেশি-বন্ধু


বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৮, ২০১৯
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।