কলকাতা: পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় নন্দীগ্রাম। ওই অঞ্চল থেকেই তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক উত্থান।
কিন্তু, এরপর বিগত সাড়ে নয় বছরে পশ্চিমবঙ্গে যতবার ভোট হয়েছে মমতা কোনো কালেই নন্দীগ্রাম থেকে প্রার্থী হননি। সেই নন্দীগ্রামের মাটিতেই পাঁচ বছর পর পা দিয়ে সোমবার (১৮ জানুয়ারি) নন্দীগ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে বলেন, আমি যদি এখান থেকে প্রার্থী হই কেমন লাগবে আপনাদের? ভাবছিলাম এখনই বলবো না। তবে বলেই ফেললাম। আমি ঘোষণা করছি এবার নন্দীগ্রাম থেকে প্রার্থী হব।
তবে মমতা চিরকাল যেখান থেকে প্রার্থী হয়ে এসেছেন, সেই ভবানীপুরের উদ্দেশ্যে মমতা বলেন, আমি ভবানীপুরকেও ভালোবাসি। ওখানেও ভালো প্রার্থী দেব। পারলে দুই জায়গাতেই প্রার্থী হবো। কিন্তু, জানবেন নন্দীগ্রামে এবারে প্রার্থী হচ্ছিই।
যদিও পশ্চিমবঙ্গে এখনও বিধানসভা ভোটের তফসিল ঘোষণা হয়নি। কিন্তু তার আগেই তৃণমূল সুপ্রিমো তথা মুখ্যমন্ত্রী নিজেই নিজের প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা করা পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতিতে এখন তুমুল আলোচিত বিষয়।
কিন্তু কেনো মমতা এরকম পদক্ষেপ নিলেন? ২০০৭ সালের মাঝামাঝি নন্দীগ্রামে হয়ে যাওয়া প্রতিটা সভায় মমতার পাশে ছিলেন ওই অঞ্চলের অধিকারী পরিবারের সদস্যরা। বলা হতো, মমতার রাজনৈতিক ডান হাত ছিল এই অধিকারী পরিবার। মমতা ভরসা রেখেছিলেন শুভেন্দু অধিকারীর এবং শিশির অধিকারীর উপর।
তবে বর্তমানে নিজের দলের প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণা করে সাবেক পরিবহনমন্ত্রী শুভেন্দু ও তার ভাই বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। অপরদিকে, তাদের বাবা শিশির অধিকারী দলের জেলা চেয়ারম্যান থাকলেও ছেলেরা কেন দল ছাড়লো, মমতার সেই রোষের কারণে এখন দল থেকে তিনি ব্রাত্য। এমনকী অধিকারী পরিবারের ঘনিষ্ঠদের তৃণমূল দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন মমতা।
এই পরিস্থিতে ২০২১ সালে রাজ্যে বিধানসভা ভোটের আগে সোমবার নন্দীগ্রামের মমতার সভার রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সকল রাজনৈতিক দলের চোখ ছিল নন্দীগ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি বলেন?
মমতা বক্তব্যের শুরুতে অতীতের ঘটনা তুলে ধরে বলেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে সেদিন নন্দীগ্রামে ঢুকতে আমাকে বাধা দেওয়া হয়েছিল। আমাদের ফিরে যেতে বলা হয়েছিল। বলেছিল আমাকে পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেবে। সেই সময় রাজ্যপাল আমাকে ফোন করে ফিরে আসতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি ফিরে যাইনি। বাইকে চেপে নন্দীগ্রামে ঢুকেছিলাম।
যেখানে আমি সভা করছি এই জায়গার নাম তৈখালি। ১৪ মার্চ এখানেই গুলি চলেছিল। ওই গুলি আমার গাড়িতেও লেগেছিল। আমি অনশন করেছিলাম। জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আমার অনশনের ফলে তৎকালীন ভারত সরকার আইন বদলেছিল।
ওই সময় মমতা ২৬ দিন কলকাতার এসপ্ল্যান্ডে অনশন করেছিলেন।
এরপর অধিকারী পরিবারের উদ্দেশ্যে মমতা বলেন, নন্দীগ্রামে কারা আন্দোলন করেছে, তা নিয়ে আমি কারও (শুভেন্দু অধিকারী) কাছ থেকে জ্ঞান নেবো না। সেইসব দিন আমরা দেখেছি। কীভাবে জ্যান্ত মানুষগুলোকে হত্যা করেছে সিপিআইএম সরকার। তাই নন্দীগ্রামের সাথে আমার আত্মিক টান আছে, ছিল এবং থাকবে।
এরপর নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় তার তৈরি পুরানো স্লোগান সবাইকে মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ভুলতে পারি নিজের নাম। ভুলবো না কখনও নন্দীগ্রাম। ’
এরপর মমতা বলেন, নন্দীগ্রাম অনেক উন্নত হয়েছে। আমি বেঁচে থাকতে এই বাংলাকে বিজেপির কাছে বিক্রি হতে দেবো না।
এরপর আবার অধিকারীর পরিবারের উদ্দেশ্যে মমতা বলেন, তৃণমূল কংগ্রেসের জন্মদিনেও তোমরা ছিলে না। তাই তোমরা যেতেই পার। এটা তোমাদের ব্যাপার। কারণ রাজনীতিতে তিন ধরণের মানুষ থাকে। লোভী, ভোগী আর ত্যাগী। যারা ত্যাগী তারা কোথাও যায় না।
এরপরই মমতা বলেন, আমি নন্দীগ্রামকে ভালোবাসি। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামকে কাউকে ভুলতে পারি না। আমি বারবার এখানে আসব। নন্দীগ্রাম আমার জন্য লাকি। ২০১৬ সালে আমি নন্দীগ্রাম থেকেই প্রচার শুরিু করেছিলাম। ২০২১ সালেও এখান থেকেই প্রচার শুরু করলাম। আমি ভেবেছিলাম, এখনই বলব না। তবে বলেই ফেলি। আমি ঘোষণা করছি এবার নন্দীগ্রাম থেকে প্রার্থী হব।
মমতার এহেন ঘোষণায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মতে বড় ধরনের মাস্টারস্ট্রোক খেলেছেন মমতা। কারণ, তিনি নিজে নন্দীগ্রামে প্রার্থী হওয়ার অর্থ, শুভেন্দু অধিকারীকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানানো। সম্ভবত শুভেন্দু এখান থেকেই বিজেপির হয়ে প্রার্থী হবেন। ফলে নিজের জেলাতেই শুভেন্দুকে কোনঠাসা করার কৌশলী চেষ্টা মমতার।
হাফ লাখ ভোটে হারাবো: শুভেন্দু
তবে মমতা যখন নন্দীগ্রামে, তখন মমতার ডেরায় অর্থাৎ দক্ষিণ কলকাতার টলিগঞ্জ থেকে রাসবিহারী পর্যন্ত মিছিল করলেন শুভেন্দু অধিকারী।
মমতার প্রার্থী হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে শুভেন্দু অধিকারী বলেন, রাজ্যের ২৯৪টি আসনে যেখান থেকে খুশি তিনি প্রার্থী হতে পারেন। ২১ বছর ওই দলটা করেছি। মাননীয়া (মমতা) ভোট এলেই নন্দীগ্রামে যান। ২০১৫ সালের ২১ ডিসেম্বর শেষবার নন্দীগ্রামে গিয়েছিলেন। আবার ঠিক ৫ বছর পর নন্দীগ্রামের কথা মনে পড়েছে। তারপরে আর নন্দীগ্রামের কথা মনে পড়ে না।
যদি জিজ্ঞাসা করি নন্দীগ্রামের জন্য কী কী করেছেন উত্তর দিতে পারবেন? আজ সিঙ্গুরের কি অবস্থা। সিঙ্গুর থেকে শিল্প তাড়িয়ে রাজ্যের সর্বনাশ করেছে। এরপরও সিঙ্গুরের কথা তিনি (মমতা) অষ্টম শ্রেণির পাঠ্য পুস্তকে রেখেছে। কিন্তু, নন্দীগ্রামের নাম কোথাও এক লাইনও লেখা নেই।
যেসব পুলিশরা নন্দীগ্রামে গুলি চালানোর জন্য অভিযুক্ত সেইসব পুলিশ কর্তাদের শিক্ষামন্ত্রী দলে ঠাঁই দিয়েছেন। এর জবাব নন্দীগ্রাম দেবেই দেবে। বিজেপি আমাকে নন্দীগ্রামে প্রার্থী করুক বা অন্য কাউকে, বলে রাখছি হাফ লাখ ভোটে মাননীয়াকে (মমতা) হারাতে না পারলে রাজনীতি ছেড়ে দেব।
নন্দীগ্রাম থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রার্থী হওয়া প্রসঙ্গে বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্য বলেন, কত জায়গা থেকে দাঁড়াবেন উনি আগে তা ঠিক করুক। তৃণমূল দলটাই তো ভেঙে যাচ্ছে। প্রতিদিনই তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন কর্মীরা। এভাবে তো দলটাই রাখতে পারবে না মমতা। জেতা তো দূরের কথা।
মমতার এহেন সিদ্ধান্তে কটাক্ষ করেছেন বামেরাও। তৃণমূল নেত্রীর এই ঘোষণা আসলে তাঁর ভীরু মানসিকতার লক্ষণ বলেই মনে করছেন বামেরা।
এ প্রসঙ্গে বাম পরিষদীয় দলনেতা তথা সিপিআইএম বিধায়ক সুজন চক্রবর্তী বলেন, এতবছর তো তাদেরই সরকার ক্ষমতায়। নন্দীগ্রামে অন্যায় হয়েছে বলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিল তিনি। তারাই আবার ক্লিনচিট দিয়েছেন বুদ্ধবাবুর সরকারকে। এতই যখন অত্যাচার করেছে বাম তাহলে একজন নেতা-মন্ত্রীকে দোষী সাব্যস্ত করে জেলে পুরতে পারলেন না কেনো? আসলে তিনি (মমতা) ভয় পেয়েছেন। ভবানীপুরে জিতবেন না বুঝতে পেরেই পালিয়ে গেলেন তিনি নন্দীগ্রামে।
ভোটের তফসিল ঘোষণায় এখনও দেরি আছে। তার আগে মাঘ মাসের শীতে ভোটের উত্তাপ যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেলো পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতিতে।
বাংলাদেশ সময়: ০৩৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০২১
ভিএস/এইচএডি