ঢাকা, রবিবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

তদন্তেই ক্ষত-বিক্ষত ডেসটিনি

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২২ ঘণ্টা, এপ্রিল ৪, ২০১২
তদন্তেই ক্ষত-বিক্ষত ডেসটিনি

ঢাকা : হায় হায় কোম্পানি ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেডের শীর্ষ কর্মকর্তা ও কর্ণধারদের ওপর নজরদারিসহ দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারির সুপারিশ করেছে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি গোয়েন্দা সংস্থা।

কোম্পানিটির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অর্থ পাচার, প্রতারণা ও জালিয়াতিসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এ সুপারিশ করা হয়।

একই সঙ্গে এসব অভিযোগের ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত কোম্পানির সব ধরনের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ও প্রশাসনিক কার্যক্রম সরকারের তত্ত্বাবধানে নেওয়ারও সুপারিশ করা হয়েছে।

এছাড়া ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চেয়ারম্যানসহ সাত পরিচালকের ব্যাংক লেনদেনের হিসাব বিবরণী তলব করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কোম্পানিটির প্রতারণা ও জালিয়াতির খবর প্রকাশের পর এর কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছে। রাজধানীর পল্টন, মতিঝিল, কাকরাইল এলাকার বিভিন্ন অফিসে গত কয়েকদিন ধরে ডেসটিনির কর্মীদের আনাগোনা কমে গেছে। দেশের বিভিন্ন জেলার অফিসগুলোতেও একই চিত্র। কোম্পানির প্রতারক কর্মীদের এখন অনেকটা ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা।

কথিত মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানিটির অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের (এলজিআরডি) নির্দেশে সমবায় অধিদফতর থেকে পাঁচ সদস্যের কমিটি এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দুই সদস্যের অপর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। মঙ্গলবার পৃথকভাবে এসব কমিটি গঠন করা হয়।

সমবায় অধিদফতরের অতিরিক্ত নিবন্ধক (প্রশাসন) অমিয় কুমার চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন— ঢাকা জেলা সমবায় অফিসার গালিব খান, যুগ্ম-সমবায় নিবন্ধক খন্দকার সিরাজুল ইসলাম, উপ-নিবন্ধক ভবেশ মিত্র ও মেট্রোপলিটন সমবায় অফিসার মোঃ শহিদুজ্জামান।
 
সমবায় অধিদফতরের কমিটিকে সব অভিযোগ ও অনিয়মের বিষয়ে বিস্তারিত তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

অপরদিকে, দুদক গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা হলেন— দুদক উপপরিচালক মোজাহার আলী সরদার ও সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ তৌফিক।

মঙ্গলবার দুদক কমিশনার এম বদিউজ্জামান সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ডেসটিনির অর্থ পাচারসহ অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্তের জন্য গঠিত কমিটিকে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। আগামী ১৫ কার্য দিবসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। পরে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জানা যায়, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পেলেই সমবায় অধিদফতর, অর্থ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ডেসটিনির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

মঙ্গলবার একটি গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থা ডেসটিনি গ্রুপের মোট ৩৭টি প্রতিষ্ঠানের ৮টি বিষয় নিয়ে সরকারের কাছে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছে বলে একটি সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করেছে।

সংস্থাটির ওই প্রতিবেদনে ডেসটিনির সঙ্গে জড়িত প্রায় সব কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করা হয়। কর্মকর্তারা হলেন ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেডের চ্যোরম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমিন, সভাপতি লে. জেনারেল (অব.) হারুন-অর-রশিদ, উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ গোফরানুল হক, পরিচালক (অর্থ) মোহাম্মদ সাঈদ উর রহমান, পরিচালক (ক্রয়) মেজবাহ উদ্দিন স্বপন, পরিচালক (প্রশাসন) সাকিবুজ্জামন। গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে যে ৮টি বিষয়ের ওপর তদন্ত করা হয়েছে সে সম্পর্কে বেশ কিছু বর্ণনা রয়েছে। এর মধ্যে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই আমানত সংগ্রহ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি লাখ লাখ গ্রাহককে মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে ১০ হাজার টাকা করে আমানত নিয়ে ১২ বছর পর ৩০ হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়, যা ব্যাংকিং কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্ব অনুমতি ছাড়া এ ধরনের আমানত সংগ্রহ করা বেআইনি।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত না থেকেও শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে সদস্যদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করেছে, যা নিয়মবহির্ভূত ও অন্যায়। সমবায় অধিদফতরে নিবন্ধিত হওয়ার কারণে সমবায় অধিদফতরের আইন অনুযায়ী সদস্যদের মাধ্যমে শেয়ার ছেড়ে অর্থ তুলে ব্যবসা করা যায় বলা হলেও প্রকৃত অর্থে তারা অর্থ তুলেছে সদস্যদের মাধ্যমে সমবায় অধিদফতরের আইন দেখিয়ে। কিন্তু সমবায় অধিদফতরের আইন অনুযায়ী ওই অর্থ যে ব্যবসায় লগ্নিকৃত হবে সেখানকার প্রশাসনিক ও তদারকিতে সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত না করে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা নিজেদের খেয়ালখুশি মতো পরিচালনা ও তদারকি করে অর্থ আত্মসাৎ করেছে।

এতে আরও বলা হয়েছে, ডেসটিনি গ্রুপের সব জামানত ও পুঁজি ৪০ লাখ সদস্যের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে। অথচ সদস্যদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ দিয়ে কোম্পানির সব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি জমিজমা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ও হাতেগোনা কয়েকজনের নামে ক্রয় করা হয়েছে। এটা সদস্যদের সঙ্গে বড় ধরনের প্রতারণা বলে অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে।

ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশন সম্পর্কে বলা হয়েছে, ৫ হাজার টাকা করে একটি গাছ ক্রয় করে ১২ বছর পর গাছের পরিবর্তে ৩০ হাজার টাকা প্রদান করা হবে বলে প্রতিষ্ঠানটি সদস্যদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে। মূলত তারা যতজন ব্যক্তির কাছ থেকে গাছ লাগানোর জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছে সেই পরিমাণ গাছ তারা লাগায়নি। বনায়নও করেনি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সরকার থেকে অন্য ব্যক্তির নামে লিজকৃত জমিতে লাগানো কিছু গাছ তারা তাদের বলে প্রচার করে জনসাধারণকে ধোঁকা দিয়েছে। অন্যদিকে বিভিন্ন জেলায় গাছ লাগানোর নামে জমি ক্রয় করে তারা তাদের ডেসটিনি ডেভেলপার কোম্পানির কাজে লাগাচ্ছে। গাছ লাগানোর কথা বলে মূলত তারা আমানত সংগ্রহ করেছে।

সাধারণভাবে জনগণের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহের পদ্ধতিগত আইন এড়ানোর জন্য এটি ছিল তাদের এক ধরনের কৌশল। গাছ বা গাছের শিকড় আমদানির নামেও চরম ধোঁকাবাজি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তারা সদস্যদের বিভিন্ন ভুল তথ্য প্রদান করে প্রতারিত করেছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তারা জাপান ও চীন থেকে আমদানিকৃত ‘পাওলিনিয়া’ গাছের শিকড় আমদানি করে সদস্যদের মধ্যে বিক্রয় করে। ওই শিকড় ক্রেতাকে বলা হয়, প্রতিদিন গাছটি এক ইঞ্চি করে বাড়বে। ৬ বছরে একটি গাছ প্রায় ১৮৩ থেকে ১৮৫ ফুট লম্বা হবে। বিক্রি করে তিনি পাবেন দেড় লাখ টাকারও বেশি। এ গাছ আগুনে পোড়ে না এমনকি ঘুণেও ধরে না। এটি তাদের প্রতারণার আরেকটি কৌশল। প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ মানুষকে সদস্য হওয়ার শর্তে ফেলে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিকৃত অত্যন্ত নিম্নমানের দ্রব্যাদি অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে বিক্রয় করছে। অস্বাভাবিকভাবে বর্ধিত ওই মূল্য থেকে আবার কমিশন বের করছে। এভাবে শুভংকরের ফাঁকির মাধ্যমে জনসাধারণকে আয়ের পথে এনে বেকার সমস্যা দূর করেছে বললেও প্রকৃত অর্থে তারা সদস্যদের নিয়মের জালে ফেলে নিম্নমানের দ্রব্য কিনতে বাধ্য করেছে।

অন্যদিকে একজনের কাছ থেকে দ্রব্যের বিনিময়ে অর্থ অকারণে বর্ধিতহারে গ্রহণ করে অন্যজনকে দিয়ে বেকার সমস্যা দূর করার কথা বলে তাদের মুনাফা তুলে নিচ্ছে।

প্রতিবেদনের শেষভাগে মতামত অংশে বলা হয়েছে, ডেসটিনির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৭০ লাখ ব্যক্তি ও তাদের আমানতের ভাগ্য জড়িত থাকায় তাদের বিষয়ে এখনই ভাবতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, সমাজসেবা মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, পুঁজিবাজার কর্তৃপক্ষ, বাণিজ্যিক ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশন, প্রতিষ্ঠিত ও নির্ভরযোগ্য একাধিক চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট ফার্ম, দুদক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করে ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেডের কার্যক্রম তাদের সংগৃহীত আমানত ও স্থাবর সম্পত্তির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। তার আগ পর্যন্ত ডেসটিনি ও তার সব অঙ্গ সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধ করা প্রয়োজন।

অন্যদিকে ডেসটিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চেয়ারম্যানসহ সাত পরিচালকের ব্যাংক লেনদেনের হিসাব বিবরণী তলব করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। একই সঙ্গে সহযোগী ১০ প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবও তলব করা হয়েছে। মঙ্গলবার এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) থেকে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডির কাছে পাঠানো আলাদা চিঠিতে সন্দেহভাজন পরিচালকদের ব্যাংক হিসাবের যাবতীয় তথ্য আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে এনবিআরে পাঠাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

একই সঙ্গে ডেসটিনি গ্রুপের আয়-ব্যয়ের যাবতীয় তথ্য খতিয়ে দেখতে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করেছে রাজস্ব বোর্ড। এরই মধ্যে ডেসটিনি গ্রুপের আয়কর ফাইল তলব করা হয়েছে। সমবায় সমিতির আইনে ডেসটিনি গ্রুপের বেআইনি কর সুবিধার বিষয়টিও তদন্ত করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময় : ২১১৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৪, ২০১২

প্রতিবেদন: নজরুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।