ঢাকা: ডলার সাশ্রয়ে অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্ককর ও ট্যারিফ মূল্য বাড়ানোর মাধ্যমে ৩৩০ ধরনের পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)। আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনতে ট্যারিফ কমিশন এসব পণ্যের শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) ও ট্যারিফ মূল্য বাড়ানোর বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে।
গত আগস্টে ট্যারিফ কমিশন তালিকা দিলেও, পাঁচ মাসেও তা কার্যকর হয়নি। এই সুপারিশ কার্যকর হলে অন্তত ১০০ কোটি ডলার সাশ্রয় হতে পারতো বলে মনে করছেন বিটিটিসির কর্মকর্তারা।
ডলার সংকটে চাহিদামতো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে না পেরে বিপাকে পড়ছেন দেশের শিল্পোদোক্তারা। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। এতে রিজার্ভে চাপ পড়ার পাশাপাশি ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নও করতে হচ্ছে। এর ফলে আবার নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সরকার বিলাস দ্রব্যের আমদানি সীমিত করার উদ্যোগ নিয়েছে।
পাশাপাশি কৃচ্ছ্রতা সাধনে সরকারি চাকরিজীবীদের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞাসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ডলারের মজুদ ধরে রাখতে বিলাসী পণ্য আমদানি নিরুৎসাহী করার কথাও বলে আসছেন অর্থনীতিবিদরা।
আমদানি ব্যয়ের চাপ কমাতে বাজেটের আগে গত ২৪ মে বিভিন্ন খাতের ১৩৫ পণ্যের ওপর নতুন করে শুল্ক বসানো হয়। এসব পণ্যের ওপর সর্বনিম্ন তিন শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ হারে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বা রেগুলেটরি ডিউটি (আরডি) আরোপ করা হয়েছে।
কেন শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব
বিটিটিসি বলেছে, যে সব পণ্যের আমদানি শুল্ক বাড়ালে শিল্পোৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই, সেসব পণ্যের আমদানি সাময়িকভাবে বাড়তি শুল্কারোপের মাধ্যমে নিরুৎসাহিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া যেসব ভোগ্যপণ্য সমাজের উচ্চ ক্রয়ক্ষমতাসম্পন্ন শ্রেণি ভোগ করে থাকে, সেসব পণ্যের শুল্কহার বাড়ানোর পাশাপাশি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে শুল্কায়নযোগ্য মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
ট্যারিফ কমিশনের তালিকায় আছে- বিদেশি ফল, স্বর্ণ, মদ-বিয়ার, স্মার্টফোন, গাড়ি, মসলাজাতীয়সহ ৩৩০ পণ্য। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সাশ্রয় ও আমদানি ব্যয়ে লাগাম টানতে এ পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন গত বছরের আগস্টে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। এসব পণ্যের শুল্ককর ও ট্যারিফ মূল্য বাড়ানোর মাধ্যমে আমদানি নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। এসংক্রান্ত প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সাশ্রয় ও আমদানি ব্যয়ে লাগাম টানতে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এর আগে অত্যাবশ্যকীয় নয়- এমন পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ কিংবা বন্ধ করার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে আমদানি ব্যয় কমিয়ে অত্যাবশ্যকীয় নয় এমন পণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে গত ২০ জুলাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিটিটিসিকে নির্দেশ দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ট্যারিফ কমিশন তিন সদস্যের কমিটি যাচাই-বাছাই শেষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠায়।
ট্যারিফ কমিশনের সদস্য আবু রায়হান আল বেরুনি বলেন, ‘আমদানির চাপ কমাতে ৩৩০টি পণ্যের শুল্ক, ট্যারিফ ভ্যালু বাড়ানোর সুপারিশ করেছে ট্যারিফ কমিশন। এই তালিকা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সেটি যাচাই-বাছাই করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে পাঠানো হয়েছে বলে আমি জানি। মার্কেট ইকনোমিতে ভারসাম্য আনতে সরকার এই পদক্ষেপ নিয়েছে। ’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, ‘আগস্টে ট্যারিফ কমিশন তালিকা পাঠিয়েছিল, সেটা এনবিআরে পাঠানো হয়েছে। এখন এনবিআর এটি বাস্তবায়ন করবে। ’
এনবিআরের শুল্ক বিভাগ সূত্র জানায়, আমদানি কমলে রাজস্বের ওপর কি প্রভাব পড়বে, তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। শিগগিরই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, ‘পণ্যে শুল্ক হার বাড়ানো-কমানোর প্রস্তাব যখন অন্য কোনো মন্ত্রণালয় থেকে আসে, তখন তারা তাদের দৃষ্টিকোন থেকে বিষয়টি বিবেচনা করে। এনবিআর যখন শুল্ক হার কমানো বাড়ানোর চিন্তা করে সেটা স্বাভাবিক প্রাক্ষাপট বিবেচনা করে। শুল্ক হার কমানোর সাথে-সাথে স্থানীয় উৎপাদন বাঁধাগ্রস্ত হয় কিনা সেটাও বিবেচনা করা হয়। সেজন্য আমরা এ বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে যেগুলোর শুল্ক হার বাড়ানো দরকার সেগুলো আমরা বাড়িয়ে থাকি, বাড়িয়েছি এবং প্রয়োজনে আরও বাড়াবো। ’
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার সম্প্রতি বলেছেন, ‘আমাদের অপ্রয়োজনীয় অনেক এলসি হয়েছে। এ ছাড়া আমদানির মাধ্যমে অনেক ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং হয়েছে। এখন আমরা সব আমদানিতে খুব নজরদারি করছি, এতে ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং অনেকটাই কমেছে। ’
রোজা-ঈদে আরও বাড়বে আমদানি
চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই আমদানি দায় কমানোর নানা পদক্ষেপ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার শর্তও কঠোর করা হয়েছিল। এতে গত অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) তুলনায় চলতি অর্থবছরে আমদানির নতুন এলসি ২২ দশমিক ৫২ শতাংশ কমেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধে নতুন এলসির পরিমাণ ছিল ৪৪ বিলিয়ন ডলার। আর চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে ৩৪ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। এ হিসাবে নতুন এলসির পরিমাণ ৯ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার কমেছে।
তবে অর্থবছরের প্রথমার্ধ শেষে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশের আমদানি নিষ্পত্তি ৭ দশমিক ৭১ শতাংশ বেড়েছে। আর্থিক মূল্যে এই নিষ্পত্তি বাড়ার পরিমাণ প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার। ডিসেম্বরে আসন্ন রমজান উপলক্ষে পণ্য আমদানির এলসি খোলা বেড়েছে, যা ৭০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে তিন হাজার ২২০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। রোজানির্ভর পণ্য আমদানি করতে লাগবে ২২০ কোটি ডলার।
এ ছাড়া রোজার সঙ্গে ঈদ ও অন্যান্য পণ্য আমদানি করতে জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাসে এক হাজার ৪২৭ কোটি ডলারের প্রয়োজন হবে।
বাংলাদেশ সময়: ২২১৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০২৩
এনএস