ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় জীবনযাত্রায় ব্যয় বৃদ্ধি

ধার-বাকির জীবনে নাভিশ্বাস শ্রমিকের

জাফর আহমদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২৩
ধার-বাকির জীবনে নাভিশ্বাস শ্রমিকের

ঢাকা: এক বছর আগে মিরপুরের গার্মেন্টস শ্রমিকরা মজুরি বাড়ার জন্য বিক্ষোভ করে। সেই বিক্ষোভের পর শ্রমিকদের ধরপাকড় চাকরিচ্যুতির ঘটনা ঘটে।

এরপর কার্যত শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর কোনো কর্মসূচি নেই।

শ্রমিকরা বলছেন, জীবন নির্বাহের খরচ মজুরি বাড়ানোর তাগিদ থাকলেও চাকরি হারানো ও গ্রেফতারের ভয়ে কোনো কর্মসূচি নেই; মজুরি বাড়ছে না। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে প্রাপ্ত মজুরিতে চলছে না, ধার-বাকি করে মাস সামাল দিতে হয়। বেতন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব টাকা পরিশোধ করতে চলে যায়।

শ্রমিক নেতারা বলছেন, মূল্যস্ফীতির কারণে শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি কমে যাওয়া ও মজুরি ঘোষণা পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও মজুরি বোর্ড গঠনের লক্ষন দেখা যাচ্ছে না।

মিরপুর-১০ নম্বরে গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিকরা বেতন বাড়ার দাবিতে বিক্ষোভ করলে মজুরি বোর্ড গঠনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, দেওয়া হয়েছিল স্বল্পমূল্যে নিত্যপণ্যের প্রতিশ্রুতি। ধরপাকড় ও চাকরিচ্যুত করে শ্রমিকদের থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল, এরপর আর মজুরি বাড়ার তাগিদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

বর্তমান মজুরি বোর্ড মজুরি ঘোষণা করে ২০১৮ সালে। এ বোর্ডের ঘোষণা করা মজুরি ২০১৯ সাল থেকে কার্যকর হয়। সেসময় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয় ৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ কোনো শ্রমিক কারখানায় প্রবেশ করলেই তিনি ৮ হাজার টাকা মজুরি পাবেন। সেসঙ্গে প্রতিবছর মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে ৫ শতাংশ করে মজুরি বাড়বে। আর পাঁচ বছর মধ্যে মজুরি বোর্ড পুনর্গঠন করে মজুরি ঘোষণা করতে হবে। পরিস্থিতির বিবেচনা করে তা আগেও হতে পারে।

কারখানার শ্রমিকরা বলছেন, নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। পাঁচ বছর পরিবারের খরচ চালাতে যে টাকা লাগতো এখন তার প্রায় দ্বিগুণ লাগে। চাল, ডাল, সবজি, মাছ, মাংস, দুধ ডিমসহ সব পণ্যের দাম দেড়গুণ থেকে দুই গুণ হয়েছে। বেড়েছে যাতায়াত খরচ।

গত বছর সবচেয়ে বেশি বেড়েছিল, এমনটা জানান মিরপুরের কাজীপাড়ার একটি কারখানার শ্রমিক আমেনা খাতুন। তিনি কাজীপাড়ার একটি গার্মেন্টস কারখানায় অপারেটর হিসেবে চাকরি করেন।

আমেনা বলেন, পাঁচ বছর আগে যখন মজুরি বাড়ে তখন সংসার ভালোই চলতো। সংসার চালানোর পর গ্রামে বাড়িতেও কিছুটা টাকা পাঠানো যেতো। এখন বাজার খরচ এতো বেড়েছে যে আর সংসার চলে না। ধার দেনা করে চলতে হয়, বেতন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধার-দেনা শোধ করতে টাকা শেষ হয়ে যায়। নতুন করে আবার ধার-বাকির শুরু হয়ে যায়।

প্রাপ্ত বেতনে চলছে না আশুলিয়ার আজর আলীও। আগে চললেও, এখন আর চলে না।

আজর আলী বলেন, রপ্তানি আয় বাড়ছে, আমাদের খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে বেতন কমে গেছে, এটা কেউ দেখার নেই। বেতন বাড়ানোর কথা বলতে গেলেই মার্ক করে রাখে, পরে কারখানা থেকে বের করে দেয়।

এ বিষয়ে গার্মেন্টস ও সোয়েটার শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের (জিডব্লিউটিইউসি) সভাপতি ইদ্রিস আলী বাংলানিউজকে বলেন, নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এই বেতনে শ্রমিকের আর চলছে না। চাল, ডালসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। বেড়েছে বাড়ি ভাড়া, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ও যাতায়াত খরচও। এ অবস্থা সামাল দিতে শ্রমিককে আধা পেটা খেয়ে জীবন অতিবাহিত করা লাগছে। ধার দেনার আশ্রয় নিতে হচ্ছে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে মজুরি বোর্ডের পুনর্গঠনের বিকল্প নেই। কিন্তু তার আগে মহার্ঘ ভাতা চালু করে শ্রমিকের এখনকার সংকট দূর করার ব্যবস্থা নিতে হবে। জীবন নির্বাহের খরচ সামাল দিতে আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা না করলে উৎপাদনশীলনতারই  ক্ষতি হবে। তার আগে শ্রমিকদের আয় বৃদ্ধির প্রয়োজন, বলেন ওই শ্রমিক নেতা।

কারখানার শ্রমিকদের বিক্ষোভের পর সরকার ২০০৬ সালে মজুরি বোর্ড পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়। সেসময় গাজীপুরের শ্রীপুরের এসকিউ কারখানা থেকে বিক্ষোভ শুরু হয়ে আশুলিয়া হয়ে সাভার ও গাজীপুরের শ্রমিক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এরপর সরকার মজুরি বোর্ড পুনর্গঠন করে। নতুন মজুরি ঘোষণা করাসহ নতুন শ্রম আইন-২০০৬ পাস করা হয়। সেসময় ৯৩০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ১ হাজার ৬৬২ টাকা ৫০ পয়সা বেতন নির্ধারণ হয়। ১০১০ সালের মজুরি বোর্ড পুনর্গঠন করে ৩ হাজার টাকা মজুরি ঘোষণা করে। সেবার সরকারের পক্ষ থেকেও মজুরি বৃদ্ধির তাগিদ দেখানো হয়। এরপর ১০১২ সালে আরেকবার বোর্ড পুনর্গঠন করে নতুন মজুরি ঘোষণা করা হয় ৫ হাজার ৩০০ টাকা। যেটি ২০১৩ সালের ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়।

সর্বশেষ ২০১৮ সালে বোর্ড পুনর্গঠনের মাধ্যমে নতুন ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয় ৮ হাজার টাকা। ২০১৭ সালে আশুলিয়া, মিরপুর, সাভার ও গাজীপুরে বিক্ষোভের পর এ মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়। ওই বোর্ডের শ্রমিক প্রতিনিধি ছিলেন সামসুন্নাহার ভূইয়া। তিনি বর্তমান সরকার দলীয় সংসদ সদস্য।

২০১৩ সালের মজুরি বোর্ডের শ্রমিক প্রতিনিধি ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ও কর্মচারী লীগের সভাপতি মো. সিরাজুল ইসলাম রনি।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। পাঁচ বছরের মধ্যে মজুরি বোর্ড গঠন করে নতুন বেতন ঘোষণার বাধ্যবাধকতা আছে। চলতি বছরের নভেম্বর মাসের মধ্যেই মজুরি বোর্ডকে নতুন মজুরি ঘোষণা করতে হবে। সেলক্ষ্যকে সামনে রেখে আশা করছি দ্রুত বোর্ড পুনর্গঠন করা হবে।

জীবন যাত্রার ব্যয় বেড়েছে। বাজারদরের সঙ্গে সংগতি রেখে বোর্ড গঠন করে শ্রমিকদের বেতন পুননির্ধারণ হবে। ইতোমধ্যে আমরা শ্রমিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে একক এবং মোর্চার মাধ্যমে বোর্ড গঠনের দাবি জানিয়েছি। বোর্ড গঠিত হলে আমরা সেখানে শ্রমিকের জীবন নির্বাহের ব্যয় বিবেচনা করে দাবি তুলবো, বলেন সিরাজুল ইসলাম।

বর্তমান মজুরি কাঠামো শ্রমিকের পক্ষে নয় উল্লেখ করে সিরাজুল বলেন, এ মজুরিতে বেসিকের পরিমাণ অপ্রতুল। মজুরি বাড়লেও শ্রমিকরা বেতন কম পাচ্ছেন। বর্তমান বোর্ড যেটা করেছে মোট মজুরি বাড়লেও বেসিক কম করেছে। আগামী মজুরি বোর্ডে যাতে এমন না হয় আমরা সতর্ক হবো। সেভাবেই বোর্ডে দাবি তুলবো।

এ বছরে মজুরি বোর্ড গঠনের ব্যাপারে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) ইতিবাচক।

এ বিষয়ে বিজিএমইএর সহ-সভাপতি মো. শহিদুল্লাহ আজিম বাংলানিউজকে বলেন, পাঁচ বছর পর মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়, সে হিসাবে এবারও হবে। বোর্ড আলোচনা করে তৈরি পোশাক শিল্পের সক্ষমতা ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে যেটা ভালো হয়, সেটা করবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২৩
জেডএ/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।