ঢাকা: আগামী ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের জন্য ৭ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকার বাজেট প্রাক্কলন অনুমোদন করেছে সরকারের আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রাবিনিময় হার-সংক্রান্ত কোঅর্ডিনেশন কাউন্সিল। এতে প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ।
আগামী অর্থবছর সরকার এনবিআর, এনবিআর-বহির্ভূত এবং কর-বহির্ভূত রাজস্ব থেকে মোট ৫ লাখ কোটি টাকা আয় করতে চায়। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হচ্ছে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।
সরকার যখন এ বাজেট প্রাক্কলন অনুমোদন করেছে তখন দেশের মূল্যস্ফীতি উঠেছে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। রাজস্ব আদায়ে রয়েছে বড় ধরনের ঘাটতি। ডলার সংকট দূর করতে ব্যয় সংকোচনের পথ অনুসরণ করছে। এ অবস্থায় এ বাজেট প্রাক্কলনে আয়ের সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা ছাড়া ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমাতে যৌক্তিক কর্মপন্থা না থাকা প্রাক্কলনকে উদ্যোগহীন বৈতরণীর সঙ্গে তুলনা করেছেন বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।
সরকারের আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রাবিনিময় হার-সংক্রান্ত কোঅর্ডিনেশন কাউন্সিলের ৫ এপ্রিলের বৈঠকে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বাজেটের প্রাক্কলন অনুমোদনের পর বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এ প্রাক্কলন দেখে মনে হচ্ছে গতানুগতি ধারার বাজেট। সব সময় আমরা দেখি আয়ের ক্ষেত্রে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য ঠিক করা হয়, ব্যয়ের ক্ষেত্রেও একই দেখা যায়। বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে জিডিপির ৫.৩ শতাংশ। তার মানে আমরা আবারও একটি সম্প্রসারণমুখী বাজেট দেখতে পাবো। তাতে এবার সামষ্টিক অর্থনীতিতে যে সমস্যাগুলো আছে, বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং ডলার সংকট নিরসন করা—বাজেটে সমস্যা নিরসনে বিশেষ কোনো পদক্ষেপ থাকবে, এমন কিছু আমি দেখছি না।
তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনবে, সেটা কীভাবে অর্জিত হবে এবং বাজেটে তো একটি অবদান থাকতে হবে। একবার বললাম আমার মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ পেরিয়ে যাবে, ২০২৪ এর জুনের মধ্যে এটা ৬ শতাংশে নেমে আসবে—এটা আমরা লক্ষ্য ঠিক করলাম। কিন্তু নামবে কীভাবে, সেটা নামানোর জন্য ফিসকেল পলিসির কী অবদান থাকবে, সে ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা নেই।
ফিসকেল পলিসিতে অবদান থাকতে পারে, সেরকম দুটি দিক উল্লেখ করে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, প্রথমত, সার্বিক চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করা অথবা চাহিদা প্রবৃদ্ধিকে কমিয়ে আনা। সেখানে বাজেটে ঘাটতি আগের তুলনায় কম লক্ষ্য রাখা যৌক্তিক হবে। যদি লক্ষ্য হয় যে, সাময়িক চাহিদাটা কমানো বা ইনজেকশন কমানো।
মূল্যস্ফীতি কমানোর কথা বলছি কিন্তু ফিসকেল পলিসিতে কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। ব্যয় উচ্চভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে, আয়ও উচ্চভিলাষী ধরা হচ্ছে, বাজেট ঘাটতিও বাড়ছে। বাজেট অর্থায়নে যেটা নন-ইনফ্লেশনারি অর্থায়ন হতে পারতো, সেটা বৈদেশিক সহায়তা অংশটা বাড়ানো যেতো। এতে ডলার আসবে, অন্যদিকে সরকারের বিনিয়োগও এগিয়ে যেতে পারবে কিন্তু সামষ্টিক চাহিদার ওপরে চাপ সৃষ্টি হবে না বা ডলারের ওপরে চাপ সৃষ্টি হবে না—এ ধরনের কোনো পরিবর্তন এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।
আর দ্বিতীয় যেটা হলো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যেটা করতে পারতো, সেটা হচ্ছে এটা সহনীয় পর্যায়ে রাখা। মূল্যস্ফীতির জন্য বেশি সমস্যায় পড়ে কম আয়ের মানুষ, নিম্নআয়ের মানুষ। তাদের কর্মসংস্থান বাড়ানো, আয় বাড়ানো বা সামাজিক সহায়তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো, ভাতা বাড়ানোর উদ্যোগ থাকতে পারতো। কিন্তু এ পর্যন্ত যা দেখেছি, বিধবাদের জন্য কর্মসূচি আছে বা ওল্ডএইজ (বৃদ্ধভাতা) কর্মসূচি আছে। তাদের ৫০০ টাকা করে দেওয়া হয়, সেটা ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৬০০ টাকা করা হচ্ছ। বিধবাদের সহায়তা কর্মসূচি ৫০ টাকা বাড়ানো হবে। এগুলো তো খুবই সামান্য। এগুলো তো আর মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য ভূমিকা রাখতে পারবে না; সেই ধরনের কোনো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নেই, যা মূল্যস্ফীতি মোকাবিলার জন্য নতুন কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে। আগামী বছরের বাজেটে এমন কোনো উদ্যোগের কথা আমরা শুনিনি, বলেন এই অর্থনীতিবিদ।
মূল্যস্ফীতি কমানোর কথা বলা হচ্ছে, আবার যে কারণে মূলস্ফীতি হয়, যেমন বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি—এগুলো অব্যাহতভাবে বাড়ছে। আগামীতে কমার চেয়ে বরং বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। তাহলে মূল্যস্ফীতির কমানোর লক্ষ্য কতটা অর্জিত হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে ড. জাহিদ বলেন, মূল্যস্ফীতি কমানো হলে শুধু ডিমান্ড সাইড থেকে কাজ করলে হবে না, যোগানের দিক থেকেও কাজ করতে হবে। মানে কস্ট সাইডের দিকে থেকেও কাজ করতে হবে। কস্টবেজ একটি বড় সোর্স আমাদের জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। জ্বালানির মূল্য তো আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে। এ সংস্কারটা করার কথা বিশেষ করে আইএমএফ-এর ঋণ চুক্তির অধীনে বিশেষ করে এই বছরের মধ্যে পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্ট, বিপিসির প্রোডক্টগুলো, এগুলো একটি ফর্মুলার মধ্যে চলে যাক। ফর্মুলাটি সরকার নির্ধারণ করে ঘোষণা করে দেবে যে, আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে অভ্যন্তরীণ বাজারের তেলের মূল্য কীভাবে সমন্বয় হবে। সেটার একটি ক্যালেন্ডার থাকবে। প্রতি মাসে ফর্মুলাটা অ্যাপ্লাই করে মূল্য কত হওয়া উচিত সেটা নিধারণ করবে। কিন্ত সেই পলিসি তো আমরা এখনো দেখতে পাচ্ছি না। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী সেটা হয়তো বলবেন, যোগ করেন এই অর্থনীতিবিদ।
চলতি বছরে বড় ধরনের রাজস্ব ঘাটতি আছে। এর মধ্যেই ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে পরবর্তী বছরের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। এটা কীভাবে সম্ভব হবে, বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিশ্বব্যাংকের এই সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, রাজস্বের ক্ষেত্রে ৫ লাখ কোটি টাকার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। এখানে ট্যাক্স রেভিনিউয়ের অবদানটাই বেশি। কী ধরনের সংস্কার করে এ লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছানো সম্ভব হবে? সেগুলোর ক্ষেত্রে এনবিআর থেকে আমরা যেটা শুনেছি যে, আইনজীবীদের কাছে থেকে, ডাক্তারদের কাছে থেকে বা পেশাজীবীদের যারা আছেন, তাদের ট্যাক্সের আওতায় আনা হবে। এ ধরনের কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এগুলো দিয়ে তো বড় ধরনের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। বড় লক্ষ্য অর্জন করতে হলে জিরো পয়েন্ট ৫ শতাংশ জিডিপি বাড়াতে হবে। মানে ট্যাক্স জিডিপি অনুপাত বাড়াতে হবে। এ ধরনের ছোট ছোট উদ্যোগে এটা হবে না।
জাহিদ হোসেন বলেন, এ জন্য নীতির ব্যাপক পরিবর্তন দরকার; প্রশাসনিক সংস্কার বিশেষ করে অটোমেশন দরকার, মানে করদাতা ও কর আদায়কারীর মধ্যে যাতে দেখাদেখি না হয়। সেই ধরনের অবস্থানে পৌঁছাতে হলে আমাদের ট্যাক্স অটোমেশনের অনেক কাজ বাকি। মূল্য সংযোজন করের ক্ষেত্রে, আয়করের ক্ষেত্রে বা শুল্কের ক্ষেত্রে কোথায় কী ধরনের অটোমেশনের দরকার হবে, পলিসির সংস্কার হবে– এ পর্যন্ত তেমন কিছু শুনিনি। যার ভিত্তিতে দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধিটা অর্জন করতে পারবো বা কাছাকাছি যেতে পারবো।
শর্তসাপেক্ষে বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। ঋণের প্রথম কিস্তি ইতোমধ্যে ছাড় করেছে আইএমইফ। শর্ত অনুযায়ী আগামী অর্থ বছরে এনবিআরের কর-জিডিপির অনুপাত শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ পয়েন্ট বাড়াতে হবে।
বাজেট প্রাক্কলনে এক্সপেন্ডিচারের যৌক্তিকীকরণের বিষয়ে তিনি বলেন, এক্সপেন্ডিচারের যৌক্তিকীকরণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সাবসিডি দিয়ে যা দেখতে পাচ্ছি বা শুনতে পাচ্ছি, সেটা দিয়ে তো মনে হচ্ছে না মোটাদাগের যৌক্তিকীরণের কিছু করা হবে বা ওই ধরনের কোনো উদ্যোগ আছে।
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, বাজেট শুধু আয়-ব্যয় বা ঘাটতির অর্থায়নের বিষয নয়, বাজেট হলো অর্থনৈতিক নীতির পরের বছর কী হবে, মধ্য মেয়াদে কী হবে, তার পরিষ্কার ধারণা দেওয়া। মানে কাঠামোগত সংস্কারের ক্ষেত্রে বিশেষ করে ফাইনান্সিয়াল সেক্টর, এনার্জি সেক্টর, অবকাঠামো, পাবলিক ফাইনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট—এগুলোর জন্য বাজেট বক্তৃতায় একেকটা চ্যাপ্টার থাকবে। এক্ষেত্রে প্যাসিফিক সংস্কারগুলো কী? যেমন ধরুন, ন্যাশনাল ট্যারিফ পলিসি নিয়ে কাজ চলছে। এই ন্যাশনাল পলিসি কি বাজেটের আগে চূড়ান্ত হবে, আর হলে সেটা আগামী বাজেটের মাধ্যমে এই পলিসি কতটা বাস্তবায়ন হবে। এগুলো নিয়ে তো অনেক কিছু করার কথা।
তিনি বলেন, সাধারণত যেটা দেখা যায়, আয়-ব্যয় আর ঘাটতির মধ্যেই সীমিত থাকি। কাঠামোগত সংস্কার নিয়ে অনেক প্রমিসেস থাকে, অনেক অঙ্গীকার থাকে, এই অর্থ বছরে এই কাজগুলো করবো। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে কী কী সংস্কার কার্যক্রম হবে, আর্থিক খাতে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, অবকাঠামো খাতে, জ্বালানি খাতে বা অন্যান্য যেসব বড় বড় খাতে প্রয়োজন আছে, সেগুলো নিয়ে এখনো কিছু শোনা যায়নি।
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০২৩
জেডএ/এমজেএফ