ঢাকা: প্রতি বছর ঈদের আগে এই সময়টাতে ক্রেতাদের ভিড়ে মুখর হয়ে থাকতো বঙ্গবাজার। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বেচা-কেনার এতই চাপ থাকতো যে, দম ফেলানোর সময় পেতেন না ব্যবসায়ীরা।
গত ৪ এপ্রিল ভয়াবহ আগুন লাগার ঘটে বঙ্গবাজারে। আগুন নেভাতে ঝাপিয়ে পড়ে ফায়ার সার্ভিসের ঢাকার সবগুলো ইউনিট। যোগ দেয় বিমান, নৌ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরাও। প্রায় ৬ ঘণ্টা পর আগুনের লেলিহান শিখা নিয়ন্ত্রণে আনলেও, পুরোপুরি নির্বাপন করতে সময় লেগে যায় ৭৫ ঘণ্টা। এই ঘটনায় বঙ্গবাজারের চারটি র্মাকেট পুরোপুরি ও তিনটি মার্কেট অংশিক পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির হিসাবে অগ্নিকাণ্ডে ৩ হাজার ৮৪৫ জন ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এসব ব্যবসায়ীরা যাতে ঈদের আগে কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারেন বা অন্তত থাকা খাওয়ার খরচ জোগার করতে পারেন এজন্য তাদের অস্থায়ীভাবে দোকান পরিচালনার সুযোগ করে দেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। কিন্তু ক্ষতি পোষানোর পরিবর্তে উল্টো গরমে কষ্টই করতে হচ্ছে তাদের।
বঙ্গবাজার এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের ১.৭৯ একর খোলা জায়গায় অস্থায়ীভাবে চৌকি বসিয়ে বিভিন্ন ধরনের পোশাক বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। মাথার ওপর ছাতা থাকলেও তীব্র গরমে সেটি খুব একটা কাজে আসছে না। খুব একটা ক্রেতা না থাকায় গরমে ঘেমে-নেয়ে অলস সময় পার করছেন তারা।
ক্রেতা না থাকার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত পণ্য না থাকা, তীব্র গরম ও মানুষ না জানার কারণে ক্রেতারা বঙ্গবাজার আসছে না। টুকটাক যা আসছে তারাও পণ্যের দাম ঠিকমতো দিতে চাচ্ছে না।
মূলত দোকানের জায়গা যাতে অন্য কেউ দখল করে না নেয় এবং আপাতত থাকা-খাওয়ার খরচ যাতে ওঠে, সেজন্যই এই তীব্র গরমের মধ্যে খোলা আকাশের নিচে বসেছেন এসব হতভাগ্য ব্যবসায়ীরা।
বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে অভিযাত্রিক নামের ২২৩৩ নম্বর দোকান ছিল মো. মিজানের। আগুনে ২৫-৩০ লাখ টাকার মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও একটি সুতাও দোকান থেকে বের করতে পারেননি তিনি। পুঁজি হারিয়ে এখন ধার-দেনা করে কিছু লুঙ্গি নিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসেছেন তিনি।
মো. মিজান বলেন, ব্যাংকে কিছু টাকা জমানো ছিল, সেখান থেকে ৭ হাজার টাকা দিয়ে এবং বাকিতে আরো ২২ হাজার টাকা দিয়ে মালামাল কিনে খোলা আকাশের নিচে বসেছি। গরমে প্রতিদিন কষ্ট করছি। কিন্তু ক্রেতা একেবারে নেই। ঈদের আগে যেখানে আমরা প্রতিদিন ৭০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতাম, এখন সেখানে ১০ হাজার টাকাও বিক্রি করতে পারছি না।
তিনি আরো বলেন, বাড়িতে বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান আছে। সামনে ঈদ তাই কষ্ট করে হলেও গরমের মধ্যে বসে আছি। কিন্তু ক্রেতা না থাকায় কোনো কোনো দিন তো খরচের টাকাটাও উঠছে না। ছেলে-মেয়েকে এবার ঈদে কিছু কিনে দেওয়ার সামর্থ্যটুকুও পর্যন্ত নেই।
বঙ্গবাজারের খোলা স্থানে চৌকি বিছিয়ে মেয়েদের থ্রি-পিস বিক্রি করছেন মো. হাতেম। অগ্নিকাণ্ডের আগে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে তিনটি দোকান থাকলেও এখন সম্বল বলতে একটি চৌকি-ছাতা ও গুটি কয়েক থ্রি-পিস। জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগুনে ৭৫ লাখ টাকার থ্রি-পিস পুড়ে গেছে। দুই বস্তায় লাখ খানিক টাকার মালামাল বাসায় ছিল। সেগুলো নিয়েই এখন বসেছি। কিন্তু প্রচন্ড রোদের কারণে ক্রেতারা আসে না। সকাল থেকে বসে এক টাকাও বিক্রি করতে পারিনি। নিচের দৈনিক খরচের টাকাটাও উঠছে না। তাও বসে আছি, এই যেন সান্তনা।
৬৫ হাজার টাকা ধার করে শিশুদের পোশাক নিয়ে অস্থায়ী চৌকি পেতে বসেছেন মো. ফয়েজ। তিনি বলেন, আগে আমরা শুধু পাইকারি বিক্রি করতাম। এখন আর পাইকারি দেওয়ার মতো অবস্থা নেই দেখে খুচরা বিক্রি করছি। তারপরও ক্রেতারা কিনতে আসছে না। যে কয়জন আসে, তারাও ১০০ টাকার জামা ৫০ টাকা বলে। তারপরও টুকটাক বেচার চেষ্টা করছি।
শুধু বঙ্গবাজারের খোলা জায়গায় নয়, বেচা-বিক্রি নেই আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত বঙ্গ হোমিও মার্কেট, বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেট ও এনেক্সকো টাওয়ারেও। সেখানকার বিক্রেতাদের দাবি, এসব মার্কেটে বেশিরভাগই পাইকারি দোকান। তাই যে সময় তাদের বেচা-বিক্রি হওয়ার কথা ছিল, তখন আগুনের কারণে তারা বসতেই পারেননি। এখন যখন বসার সুযোগ পেয়েছেন, তখন ক্রেতা নেই। তাই খরচ ওঠাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদেরও।
বঙ্গ হোমিও মার্কেটের শিবলু গার্মেন্টসের কর্মচারী মো. রুবেল বলেন, আগুনে আমাদের দোকান পুড়েনি। কিন্তু পানির কারণে অনেক টাকার পোশাক নষ্ট হয়েছে। যেগুলো বাঁচাতে পেরেছি, সেগুলো নিয়ে বসেছি। কিন্তু ক্রেতা নেই। কারণ আমারা পাইকারি বিক্রি করি। তাই আমাদের বেচা-বিক্রি হয় ২০ রোজার আগে। কিন্তু সে সময় আগুন, দোকান মেরামত ও পরিষ্কার করার কারণে আমরা বসতেই পারিনি। এছাড়া অনেকেই এখনো জানে না, অগ্নিকাণ্ডের পর এখানে বেচা-বিক্রি শুরু হয়েছে। তাই আমাদের যেসব ক্রেতা তারা আসছে না।
আগে কেমন বেচা-বিক্রি হতো, আর এখন কেমন বেচা-বিক্রি হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে আমরা প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করতাম। এখন ২০-২৫ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
আয়েশা গার্মেন্টসের কর্মচারী মাহবুব বলেন, প্রতিদিন দোকানে অন্তত ১০ হাজার টাকার খরচ আছে। অথচ সেই তুলনায় বিক্রি নেই।
এদিকে এখনো কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তা পাননি বলে জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। ঈদের আগে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তা তহবিল থেকে কোনো আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির সভাপতি নাজমুল হুদা বাংলানিউজকে বলেন, আমরা ব্যবসায়ীদের এমন একটি অনুদান দিতে চাই, যাতে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারেন। এখন তাদের যদি আমরা ১৫-২০ হাজার টাকা দেই, এই টাকা তারা কোনো কাজে লাগাতে পারবেন না। আবার অনেক ব্যবসায়ী বাড়ি চলে গেছেন। তাই ঈদের আগে অনুদানের টাকা সম্পূর্ণ ক্যাশ করে তাদের হাতে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই আমরা ঈদের পর তাদের সহায়তার টাকাটা দেব। যাতে তারা সবাই উপকৃত হন।
এখন পর্যন্ত কত টাকা অনুদান এসেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা প্রায় আট কোটি টাকার মতো অনুদান পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়েছি। অনেকে চেকও দিয়েছেন। কিন্তু সেটা এখনো ব্যাংকের মাধ্যমে ক্লিয়ারেন্স হয়নি। এখন পর্যন্ত এক কোটি ৬৪ লাখ টাকা ব্যাংকে ক্যাশ হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনও তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দুই কোটি টাকা দিয়েছে। কিন্তু সেটা এখনো ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়নি। আশা করছি, প্রতিশ্রুতির সব টাকা আমরা পেয়ে যাব। আশা করি আমাদের ব্যবসায়ীরাও এই কষ্টের সময় কাটিয়ে উঠবেন।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪১ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৮, ২০২৩
এসসি/এসআইএস