ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণে ‘হংকং কনভেনশন’ অনুমোদন করা হবে: শিল্পমন্ত্রী

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০১ ঘণ্টা, মে ১০, ২০২৩
জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণে ‘হংকং কনভেনশন’ অনুমোদন করা হবে: শিল্পমন্ত্রী

ঢাকা: বাংলাদেশ ২০২৩ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক সমুদ্র সংস্থা প্রবর্তিত দি হংকং ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দি সেফ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টালি সাউন্ড রিসাইক্লিং অব শিপস, ২০০৯ (দি হংকং কনভেনশন) অনুমোদন করবে বলে জানিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন।

বুধবার (১০ মে) শিল্প মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে নরওয়ের জলবায়ু ও পরিবেশ বিষয়ক উপমন্ত্রী মিস রাগনহিল্ড সজোনার সিরস্টাডের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলের সঙ্গে এক দ্বিপাক্ষিক সভায় তিনি একথা বলেন।

প্রতিনিধিদলে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত নরওয়ের রাষ্ট্রদূত এসপেন ইকটার-সেভেনডসেন, নরওয়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এবং নরওয়ের জাহাজ মালিক সমিটির নেতারা। এতে অন্যদের মধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানা, অতিরিক্তি সচিব মো. জাফর উল্লাহ ও শেখ ফয়েজুল আমীন এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসময় উপস্থিত ছিলেন।  

শিল্পমন্ত্রী বলেন, জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পে বাংলাদেশ পরিবেশগত, পেশাগত সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে উল্লেখ্যযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। পরিবেশ দূষণ রোধ করতে না পারা, বিভিন্ন রকম দুর্ঘটনা এবং দেশে-বিদেশে নানা নেতিবাচক প্রচারের কারণে জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ সেক্টর বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দূরদর্শী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ২০১১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাত কার্যক্রমকে ‘শিল্প’ হিসেবে ঘোষণা করেন। শিল্প মন্ত্রণালয় জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের পরিচালনা, উন্নয়ন ও বিকাশের অংশ হিসেবে ২০১১ সালে ‘শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড শিপ রিসাইক্লিং রুলস্’ জারি করে এবং ২০১৮ সালে ‘বাংলাদেশ জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ আইন’ প্রণয়ন করে।

মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ আইন ২০১৮ অনুযায়ী এ সংক্রান্ত একটি প্রশিক্ষণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ ব্যাপারে তিনি নরওয়ের সহযোগিতা কামনা করেন।

নরওয়ের উপমন্ত্রী রাগনহিল্ড সজোনার সিরস্টাড ‘হংকং কনভেনশন’ অনুমোদনে বাংলাদেশের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এ কনভেনশন অনুমোদনের ফলে জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পাবে। নরওয়ে একটি জাহাজ নির্মাণকারী জাতি। মেয়াদকাল শেষ হয়ে যাওয়ায় নরওয়েতে প্রচুর জাহাজ রিসাইক্লিংয়ের অপেক্ষায় রয়েছে। বাংলাদেশি ইয়ার্ডগুলো এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে লাভবান হতে পারে। এজন্য পরিবেশগত ও নিরাপত্তার বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। ‘দি হংকং কনভেনশন’ ২০২৩ সালের মধ্যে অনুমোদন করা হলে বাংলাদেশ আরও দুই বছর সময় পাবে এ সংক্রান্ত শর্তগুলো প্রতিপালন করার জন্য।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের শিপ রিসাইক্লিং শিল্পের উন্নয়নে নরওয়ে বিগত এক দশক ধরে সহযোগিতা করে আসছে। ফলে ইতোমধ্যে বাংলাদেশে এ শিল্পের ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। তিনি এ শিল্পের আধুনিকায়ন এবং সমুদ্র ও শিল্প বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নরওয়ের কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সহায়তা অব্যাহত থাকবে বলে জানান। তিনি জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ কাজে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারে সহযোগিতার আশ্বাস দেন।  

শিল্পসচিব জাকিয়া সুলতানা বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব শিপ রিসাইক্লিং শিল্পের উন্নয়নে নরওয়ের সঙ্গে দীর্ঘদিনের কারিগরি সহযোগিতার কথা তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশের জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প ক্রমেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করছে। আমরা গত ৮ মে তারিখে এ সংক্রান্ত একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করেছি। তিনি এ শিল্পের শ্রমিক ও জনবলের দক্ষতা বাড়াতে নরওয়ে থেকে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা বাড়ানোর জন্য নরওয়ের উপমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

তিনি বলেন, এ শিল্পে প্রায় ৩০ হাজার হতে ৫০ হাজার শ্রমিক প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত রয়েছে এবং পরোক্ষভাবে প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। অন্যদিকে এদেশের ৬০০ এর মতো রি-রোলিং স্টিল মিল রয়েছে, যেগুলো এই শিল্পের উপর নির্ভরশীল। বিশ্বের যে পাঁচটি দেশ সবচেয়ে বেশী জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াকরণ করে তাদের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার উপরে।

জানা গেছে, ‘হংকং কনভেনশন’ ২০০৯ সালে ৬৩টি দেশের কূটনৈতিক সম্মেলনে পাশ হয়েছিল। ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও), সদস্য রাষ্ট্র, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও ব্যাসেল কনভেনশনের পক্ষগুলোর সহায়তায় ‘হংকং কনভেনশন’ পাশ করা হয়। হংকং কনভেনশনের উদ্দেশ্য হলো জাহাজগুলো বিভাজনের সময় পরিবেশ এবং মানব স্বাস্থ্যের যেন কোনো প্রকার ক্ষতি না হয় তা নিশ্চিত করা। ‘হংকং কনভেনশন’ কার্যকর করার জন্য ইতোমধ্যে যে বিশটি দেশ অনুসমর্থন করেছে সেদেশগুলি হলো: বেলজিয়াম, কঙ্গো, ক্রোয়েশিয়া, ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, ঘানা, ভারত, জাপান, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, পানামা, সায়াতোমি অ্যান্ড প্রিনসিপ, সার্বিয়া, স্পেন ও তুরস্ক এবং পর্তুগাল।

এ বছর হংকং কনভেনশন কার্যকর হলে: ইয়ার্ডগুলোকে এইচকেসি কমপ্লায়েন্স ইয়ার্ড হতে হবে। সেক্ষেত্রে ইয়ার্ডগুলোতে কনক্রিটের তৈরি অভেদ্য মেঝে থাকতে হবে, সুন্দর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকতে হবে। সুনির্দিষ্ট  আগুন নির্বাপণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। জাহাজ কাটিং জোন ও স্ট্যাকিং জোন সুন্দরভাবে মার্ক করতে হবে, মেডিকেল চিকিৎসার ব্যবস্থা ও ট্রেনিং দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে, মেকানাইজড।

কার্যক্রমের জন্য ইকুইপমেন্ট (ক্রেনসহ) ও মেশিনারি সেটআপ থাকতে হবে। HAZMAT (হ্যাজার্ডাস ম্যাটারিয়ালস) সংরক্ষণাগার থাকতে হবে। শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ ও স্বাস্থ্য এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থা থাকতে হবে। এছাড়া প্রতিটি জাহাজের বিপরীতে এসআরপি প্রদান, ইয়ার্ডগুলির এসআরএফপি বাস্তবায়ন ক্রমে কমপ্লায়েন্স অর্জন, মনিটরিং, রিপোর্র্টিং, সার্টিফিকেশন করতে হবে।

‘হংকং কনভেনশন’ কার্যকর হলে, বাংলাদেশ সম্ভাব্য যে সুবিধাগুলি পেতে পারে তা হচ্ছে- ওইসিডি দেশগুলো থেকে অনেক কম দামে জাহাজ প্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি হবে। ফলে বাজারে রডের মূল্য কমে আসবে। এ শিল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ট্রিটমেন্ট স্টোরেজ এন্ড ডিসপোজাল ফেসিলিটি (টিএসডিএফ) তৈরি ও পরিচালনার জন্য জাপান থেকে কারিগরি সক্ষমতা প্রাপ্তি এবং সফট লোন প্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি হবে। ইয়ার্ডগুলোতে কম দুর্ঘটনা ঘটবে, দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে এবং শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, সমুদ্রের পানি ও পরিবেশের বিপর্যয় রোধ হবে।

উল্লেখ্য, জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে অন্যতম প্রধান। বাংলাদেশে ১৬৭টি জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াকরণ ইয়ার্ড রয়েছে যা চট্রগ্রামস্থ সীতাকুণ্ড উপজেলাতে অবস্থিত। যাদের মধ্যে কার্যরত ইয়ার্ড হচ্ছে ৫০টি। এদেশের বার্ষিক জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াকরণ সক্ষমতা ১০ মিলিয়ন টনেরও অধিক। বাংলাদেশের ইয়ার্ডগুলো পৃথিবীর ৫২.৪ শতাংশ জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে থাকে। দেশের সামগ্রিক আয়রন চাহিদার ৬০-৭০ শতাংশ জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ শিল্প থেকে আসে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৯ ঘণ্টা, মে ১০, ২০২৩
জিসিজি/এসএ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।