ঢাকা: যেন রোলার কোস্টারের মতো সকাল-বিকেল ওঠা-নামা করছে কাঁঁচা মরিচের দাম। কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না এই পণ্যের বাজার।
রোববার (৯ জুলাই) রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে মানভেদে প্রতি কেজি দেশি শুকনা মরিচ ৩৫০ টাকা থেকে ৩৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর আমদানি করা ভারতীয় শুকনা মরিচ মানভেদে প্রতি কেজি ৪৪০ থেকে ৫৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কোরবানির ঈদের আগেও এই বাজারে প্রতি কেজি দেশি শুকনা মরিচ ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা এবং আমদানি করা ভারতীয় শুকনা মরিচ ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। অর্থাৎ, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারি ও খুচরা বাজারে প্রতি কেজি শুকনা মরিচের দাম বেড়েছে ৪০ থেকে ৮০ টাকা।
এমন এক সময় শুকনা মরিচের দাম বাড়ল, যখন কাঁচা মরিচের দাম নিয়ে বাজারে চলছে অস্থিতিশীল অবস্থা। তাই ক্রেতাদের অনেকে মনে করছেন কাঁচা মরিচের বাজারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অসাধু বিক্রেতারা কারসাজি করে শুকনা মরিচের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
তবে বিক্রেতাদের দাবি, ঈদের সময় স্থলবন্দরগুলো বন্ধ থাকায়, বাজারে সরবরাহের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী জোগান না থাকায় দাম বাড়ছে। এ ছাড়া, এবার খরা ও বৃষ্টির কারণে দেশে কাঁচা মরিচের ফলন নষ্ট হওয়ায় এবং গত কয়েকদিনে বৃষ্টিতে শুকনা মরিচ উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটায় পণ্যটির দাম বেড়েছে।
কারওয়ান বাজারের শুকনা মরিচের আড়তদার খান ট্রেডার্সের বিক্রেতা বলেন, গত ছয় মাস আগে শুকনা মরিচের দাম এমন বাড়তিই ছিল। মাঝে কিছুদিন দাম কম ছিল। এখন আবার ঈদের পর দাম কেজিতে ৩০-৪০ টাকা বেড়েছে।
হঠাৎ দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব পণ্যের দামের ঠিক নেই। আজ এক দামে কিনি, তো কাল আরেক দাম থাকে। আমরা শ্যামবাজার থেকে শুকনা মরিচ কিনে আনি। আজ ৩৪৫ টাকা করে কিনে এনেছি। এরপর পরিবহন খরচ আছে আরও ৫-৬ টাকা। তারপর ৩৫০ টাকা থেকে ৩৮০ টাকায় বিক্রি করছি। দাম কেন বাড়ছে, সেটা আমরা বলতে পারব না। শ্যামবাজারে যারা বিক্রি করে তারা বলতে পারবে।
রিফাত জেনারেল স্টোরের বিক্রেতা আশু মিয়া বলেন, আমরা পাইকারিতে দেশি শুকনা মরিচ ৩৫০ টাকা এবং আমদানি করা ভারতীয় শুকনা মরিচ ৪৪০ টাকায় বিক্রি করছি। বাজারে মরিচের সরবরাহ কম, কিন্তু চাহিদা বেশি। তাই দাম বেড়েছে।
মায়ের দোয়া স্টোরের পাইকারি বিক্রেতা মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, শুকনা মরিচ তো শুকিয়ে নিতে হয়। গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে সেটি ঠিকভাবে করা যাচ্ছে না। যার কারণে ভারত থেকে শুকনা মরিচ আমদানি কম হচ্ছে। তাই দাম বেশি। বৃষ্টি পরিস্থিতি ঠিক হলেই আবার দাম কমে যাবে।
খুচরা বিক্রেতা ইব্রাহিম বলেন, বাজারে মরিচের অভাব নেই। তারপরও দাম বেশি। শুধু মরিচ নয় জিরা, লবঙ্গ ধরে সব মশলার দাম বেড়েছে। আমরা খুচরা ব্যবসায়ীরা যে দামে কিনে আনি, তা থেকে কিছু টাকা লাভ রেখে বিক্রি করি। কেন বাড়ছে সেটা বলতে পারব না।
জব্বার স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো. আব্দুল জব্বার বলেন, কাঁচা মরিচের যখন দাম বেশি থাকে তখন, কেউ আর মরিচ শুকিয়ে বিক্রি করে না। কাঁচা অবস্থাতেই বিক্রি করে দেয়। এখন কাঁচা মরিচের দাম বেশি, তাই শুকনা মরিচের ঘাটতি আছে। দামও বেড়েছে।
কারওয়ান বাজারে শুকনা মরিচ কিনতে আসেন গৃহিনী হালিমা বেগম। দুই কেজি শুকনা মরিচ কেনার আশা নিয়ে এলেও দামের কারণে কিনেছেন মাত্র দেড় কেজি। হালিমা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, কাঁচা মরিচের দাম বাড়ার পর আর কিনিনি। দাম না কমা পর্যন্ত কিনবও না। কিন্তু রান্নায় তো ঝালের প্রয়োজন আছে। তাই শুকনা মরিচ কিনতে এলাম। দুই কেজি কেনার ইচ্ছা থাকলেও সামর্থ্যে কুলোয়নি। তাই ৩৭০ টাকা করে দেড় কেজি কিনলাম। শুধু কাঁচা বা শুকনা মরিচ নয়, সব জিনিসের দামই তো বেশি। কোন জিনিসটি সস্তা আছে বলুন?
রিফাত আহমেদ নামে আরেক ক্রেতা বলেন, আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের জিনিসের দাম বাড়ানোর জন্য শুধু অজুহাত প্রয়োজন। এতদিন খরা-বৃষ্টির অজুহাত দিয়ে কাঁচা মরিচের দাম বাড়িয়েছে। এখন কাঁচা মরিচের বাড়তি দাম দেখিয়ে শুকনা মরিচের দাম বাড়াচ্ছে। কয়দিন পর শুকনা মরিচের দাম দেখিয়ে গুড়া মরিচের দাম বাড়াবে। এদেশে শুধু জিনিসের দাম বাড়েই, কমে না। সাধারণ মানুষ কিভাবে তাদের জীবন পার করছে, সেটা কেউ ভাবে না।
কোরবানির ঈদের দুই সপ্তাহ আগে হঠাৎ করে বাড়তে থাকে কাঁচা মরিচের দাম। এক পর্যায়ে ঈদের সময় কাঁচা মরিচের দাম বেড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে এক হাজার থেকে ১২শ টাকা পর্যন্ত ওঠে। দাম বাড়ার কারণ হিসেবে বিক্রেতারা খরায় ফলন কম এবং বৃষ্টিতে ব্যাপক পরিমাণে মরিচ নষ্ট হওয়ার অজুহাত দেখান। ঈদের আগে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার দীর্ঘ ১০ মাস পর ভারত থেকে কাঁচা মরিচ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। টনে টনে ভারত থেকে কাঁচা মরিচ এলেও দাম নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বরং রাজধানীর বাজারগুলোতে একদিন কাঁচা মরিচ ১৬০ টাকায় নেমে আসে তো আরেকদিন ৫০০ টাকায় গিয়ে ঠেকে। সবশেষ রোববার (৯ জুলাই) কারওয়ান বাজারে ২৪০ থেকে ২৮০ টাকায় কাঁচা মরিচ বিক্রি হতে দেখা যায়।
এদিকে, সম্প্রতি কাঁচা মরিচের আকাশছোঁয়া দাম বৃদ্ধির পেছনে অদৃশ্য হাত কাজ করেছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান।
তিনি বলেন, কাঁচা মরিচের মূল্য ১০ গুণ বাড়ার কোনো কারণ নেই। প্রতি বছর বর্ষার সময় মরিচের উৎপাদন কমে, দাম বাড়ে। তাই বলে কোনো বছরই মরিচের দাম এমন এভাবে রেকর্ড করেনি। তার মানে বাজারে কোনোভাবে অদৃশ্য হাত কাজ করেছে। সেটার ফলাফল কাঁচা মরিচের দাম এক হাজার টাকা হয়েছে। এর জন্য আমরা সবাই একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছি। এটি কোনো সভ্যতার লক্ষণ নয়।
চিনি, কাঁচা মরিচ, আদা ও রসুনের মূল্য ও সরবরাহ স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে সুপারশপ, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মতবিনিময় সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের সভাকক্ষে রোববার (৯ জুলাই) এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়।
সভায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ডিজি আরও বলেন, ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযান ও ভারত থেকে আমদানি শুরুর পর কাঁচা মরিচের দাম কিছুটা স্বস্তির জায়গায় এসেছিল। ২৫০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে নেমেছিল। এখন কিন্তু আবার দাম বাড়তি। মরিচের দাম বৃদ্ধির কয়েকটি যৌক্তিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে বৃষ্টি, কোরবানির ঈদের সময় পরিবহন সংকট, বর্ডার বন্ধ থাকা রয়েছে। কিন্তু এসব কারণ দিয়ে কোনোভাবেই কাঁচা মরিচের কেজি ৮০০-১০০০ টাকা হবে, তা মেনে নেওয়া যায় না।
বাংলাদেশ সময়: ২০০২ ঘণ্টা, জুলাই ৯, ২০২৩
এসসি/আরএইচ