ঢাকা: লাগামছাড়া দামের কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ মাছ-মাংস খাওয়া আগেই কমিয়ে দিয়েছেন। প্রাণিজ আমিষ বলতে ডিমই ছিল তাদের ভরসা।
পণ্যের দাম বাড়ায় নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষদের ওপর চাপ আরও বাড়ছে। ফলে বাজারের তালিকায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে তাদের। এতে করে সাধারণ মানুষ পুষ্টি ঘাটতি নিরাপত্তার মধ্যে পড়ছে। এই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের মনে চাপা ক্ষোভ লক্ষ্য করা গেছে।
এদিকে বেঁধে দেওয়া দাম কার্যকর করতে শুরু থেকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজারে অভিযান চালাচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় সারা দেশের গড়ে একশ’র মতো প্রতিষ্ঠান জরিমানা গুণছে বেশি দামে এসব পণ্য বিক্রি করায়।
এছাড়া ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আলু আমদানিরও প্রস্তাবনা রয়েছে, যদিও তাতে আপত্তি রয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের। এসব নানামুখী তৎপরতার পরও এই এক মাসে বাজারে কোনো পণ্যের দাম কমেনি বরং বেড়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ১৪ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আলু, ডিম ও পেঁয়াজের দাম বেঁধে দেয়। সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা, ডিমের ডজন ১৪৪ বা ১২ টাকা পিস এবং আলুর কেজি ৩৫ থেকে ৩৬ টাকায় বিক্রি করতে হবে।
শনিবার (১৪ অক্টোবর) রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দুই সপ্তাহ ধরে নতুন করে ডিমের বাজারে চলছে অস্থিরতা। শেষ এক সপ্তাহে প্রতি হালি ডিমের দাম পাঁচ টাকা বেড়ে ৫৫ থেকে ৫৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বড়বাজারে কিনলে ডিমের ডজন পড়ছে ১৬০ টাকা, যা পাড়া-মহল্লার খুচরা দোকানে ১৭০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হতে দেখা গেছে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের একটি ডিম খেতে গুনতে হচ্ছে ১৪ টাকা। অথচ সরকার প্রতি পিস ডিমের দাম ১২ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে।
সরকারের বেঁধে দেওয়া দর নির্ধারণ হয় আরেক পণ্য পেঁয়াজে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিপ্রতি যার দাম বেড়েছে ১০ টাকা পর্যন্ত। এখন দেশি ভালো মানের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। আর আমদানি করা পেঁয়াজ ৮০ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
এছাড়া গত ১৩ সেপ্টেম্বর আলুর দাম ছিল ৪৩ থেকে ৫০ টাকা। দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পর সে দাম প্রতি কেজি ৪৫ টাকায় বিক্রি হয় কিছু দিন। এরপর বর্তমানে বাজারে কোথাও ৫০ টাকার নিচে আলু মিলছে না।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, গত এক মাসের ব্যবধানে বাজারে ডিম ও পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। যখন দাম বেঁধে দেওয়া হয় সেসময় বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম ছিল ৭০ থেকে ৮০ টাকার মধ্যে, যা এখন বিক্রি হচ্ছে ৮৫ থেকে ১০০ টাকায়। এছাড়া প্রতি হালি ডিমের দাম ৫০ থেকে ৫৩ টাকার মধ্যে ছিল, যা এখন ৫২ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে আলুর দাম এক মাসের ব্যবধানে বাড়েনি বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। গত ১৩ সেপ্টেম্বর আলুর দাম ছিল ৪৩ থেকে ৫০ টাকা, যা এখন ৪২ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও বাজারে এখন কোথাও ৫০ টাকার নিচে আলু মিলছে না। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে এ পণ্যটিরও দাম বেড়েছে। তবে সেটি টিসিবির বাজার দরে আসেনি।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানিয়েছে, একটি ডিমের উৎপাদন খরচ ১০ টাকা ৫০ পয়সা হলে খুচরা বাজারে তা ১২ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। এ হিসেবে এক হালি ডিমের দাম হয় ৪৮ টাকা। কিন্তু বাজারে তা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
সূত্র জানিয়েছে, ডিমের বাজারে কারসাজির মাধ্যমে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি করে বাড়তি মুনাফা করায় ছয় কোম্পানি ও চার বাণিজ্যিক অ্যাসোসিয়েশনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে মামলা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। একই অবস্থা আলুর ক্ষেত্রেও। বেশি মুনাফার আশায় ব্যবসায়ীরা হিমাগার থেকে আলু বের করছেন না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেছেন, যেসব ব্যবসায়ী আলু সংরক্ষণ করেছেন, তারা দাম বাড়াচ্ছেন। খুচরা বাজারে আলুর দাম ৩৬ টাকা কেজির বেশি হওয়া উচিত নয়।
শ্যামবাজারের ইয়াসীন বাণিজ্যালয়ের পাইকারি আলু ব্যবসায়ী সুজন সাহা বাংলানিউজকে বলেন, মোকামে দাম বেশি থাকায় বাড়তি দরে আলু কিনতে হচ্ছে। কোল্ড স্টোর থেকে আলু ছাড়ছে ধীরে। কোল্ড স্টোরেজে সরকার নির্ধারিত দামে আলু পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে আলুর সরবরাহ একটু কমে গেছে। আর সরবরাহ কম থাকলে দাম একটু বাড়ে। দাম বেশির কারণে আমাদের বেচাকেনাও অনেক কমে গেছে। কারণ মানুষ সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। জীবন থেকে কাটছাঁট করতে হচ্ছে অনেক কিছু৷
রায়সাহেব বাজারে ডিম ব্যবসায়ী মো. আবুল বাসার বাংলানিউজকে বলেন, আজকে আড়ত থেকে ১০০ ডিম ১২৮০ টাকায় কিনেছি। সে হিসেবে প্রতিপিসের দাম পড়ে ১২ টাকা ৮০ পয়সা। এর সঙ্গে খরচ ২০ টাকা যোগ হয় তখন দাম পড়ে ১৩ টাকা। আমরা পাইকারি বিক্রি করছি ১৩. ৩০ টাকা। এতে প্রতি হালির দাম পড়ে ৫৩ টাকা ২০ পয়সা। আর খুচরায় ১০০টি ডিম ১৩৫০ টাকা বিক্রি করলে হালি ৫৪ টাকা পড়ে। কিন্তু পাড়া মহল্লায় সেটা বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৫৭ টাকা হালি।
তিনি বলেন, সরকার যে দাম নির্ধারণ করেছে সেই দামে বিক্রি করতে হলে পোল্ট্রি ফিডের দাম কমাতে হবে। এজন্যই ডিমের দাম বেশি বলে জানান ফার্মের মালিকরা। আর ভারতের একটি ডিমও এখন পর্যন্ত বাজারে আসেনি। ডিমের দাম বেড়ে যাওয়াতে বেচাকেনা কমে গেছে।
সূত্রাপুর বাজারের খুচরা আলু ও পেঁয়াজ বিক্রেতা বলরাম সাহা বাংলানিউজকে বলেন, আজকে দেশি পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৯০ থেকে ৯৫ টাকা কিনে বিক্রি করছি ১০০ টাকায়। ভারতেরটা ৭০ থেকে ৭৫ টাকায় কিনে বিক্রি করছি ৮০ টাকা। এর মধ্যে প্রতিকেজিতে আমাদের ২ টাকা খরচ রয়েছে। আর আলু ৪৬ টাকা কিনে ৫০ টাকা দরে বিক্রি করছি। সরকার ঘোষণা দেওয়ার পর আলু ও পেঁয়াজ দাম বাড়ছে৷
রায়সাহেব বাজারে আসা দীপংকর কর্মকার বাংলানিউজকে বলেন, সরকার যেসব পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছে সেগুলোর দাম উল্টো বাড়ছে। ফলে আমরা সংসার চালাতে বাজেট কাটছাঁট করছি। আগে যেখানে সপ্তাহে ৩০টি ডিম লাগতো সেখানে নিচ্ছি ২০টা। এভাবে কাটছাঁট করে কতদিন চলা যাবে। সরকারের এই দাম বেঁধে দেওয়া তামাশা ছাড়া কিছু নয়।
সূত্রাপুর বাজারে চা বিক্রেতা সাখাওয়াত হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন কোনো রকমে টিকে আছি। সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে তারপর দাম আরও বেড়ে গেছে। আগে যাও একটু দাম কম ছিল এখন আর পারছি না দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এতে আমরা ডিম, আলু, পেঁয়াজ কেনা অর্ধেক করে দিয়েছি। এখন শাক, ভর্তা আর ডাল দিয়ে খেয়েই বেশির ভাগ দিন কাটাতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে ইব্রাহিম জেনারেল হাসপাতালের উপপ্রধান পুষ্টি কর্মকর্তা ফারজানা আনজিন বলেন, নিম্নবিত্তের মানুষ প্রতিদিন মাছ-মাংস পান না। তাদের প্রোটিনের চাহিদা ডিম পূরণ করে। ইদানীং দাম বেড়ে যাওয়ায় পুষ্টি ঘাটতি দেখা দিতে পারে। ডিমে ৬ গ্রামের মতো প্রোটিন থাকে। দাম বাড়ার কারণে ডিম খাওয়া কমিয়ে দেওয়াটা উদ্বেগজনক। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে তা বড় ধরনের পুষ্টি ঘাটতির কারণ হবে। মানুষের চিকিৎসা ব্যয় বাড়বে।
বেশ লম্বা সময় ধরেই ডিমের বাজারে অস্থিরতা চলছে। গত আগস্টে এক ডজন ডিমের দাম ১৪৫ টাকা থেকে বেড়ে ১৮০ টাকা পর্যন্ত হয়েছিল। কারণ হিসেবে ‘সিন্ডিকেটের’ মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণকে দায়ী করা হয়। গত ১৪ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো প্রতিটি ডিমের মূল্য ১২ টাকা নির্ধারণ করে দেয়।
এরপর তিন দফায় ১৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অনুমতির ২৭ দিন পার হলেও এ পর্যন্ত আমদানির কোনো ডিম দেশে আসেনি। দর বেঁধে দেওয়ার এক মাস পরও বাজারে তা কার্যকর করা যায়নি। খুচরা বাজারে প্রতিটি ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৪ টাকায়।
বেঁধে দেওয়া এ দর যথাযথভাবে কার্যকর না হওয়ায় প্রথম দফায় গত ১৮ সেপ্টেম্বর চার প্রতিষ্ঠানকে এক কোটি করে চার কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে: মীম এন্টারপ্রাইজ, প্রাইম এনার্জি ইমপোর্টার্স অ্যান্ড সাপ্লায়ার্স, টাইগার ট্রেডিং ও অর্ণব ট্রেডিং লিমিটেড।
দ্বিতীয় দফায় ২১ সেপ্টেম্বর আরও ছয় প্রতিষ্ঠানকে এক কোটি করে ছয় কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেসব প্রতিষ্ঠান হলো: চিজ গ্যালারি, পপুলার ট্রেড সিন্ডিকেট, এমএস রিপা এন্টারপ্রাইজ, এসএম করপোরেশন, বিডিএস করপোরেশন ও মেসার্স জয়নুর ট্রেডার্স। মোট দশ প্রতিষ্ঠানকে ১০ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়।
এরপর তৃতীয় দফায় গত ৮ অক্টোবর আরও ৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। অনুমতি প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো হলো: ইউনিয়ন ভেনচার লিমিটেড, জে এফ জে প্যারাডাইস কানেকশন, লায়েক এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স লাকি এন্টারপ্রাইজ এবং মেসার্স পিংকি ট্রেডার্স।
যেসব শর্তে ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। সেগুলো হলো- এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ড ফ্লু মুক্ত দেশ থেকে ডিম আমদানি করতে হবে। আমদানিকৃত ডিমের প্রতিটি চালানের জন্য রপ্তানিকারক দেশের সরকারের মাধ্যমে নির্ধারিত কিংবা ক্ষমতাপ্রাপ্ত উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ড ফ্লুর ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ামুক্ত সনদ দাখিল করতে হবে। সরকার নির্ধারিত শুল্ক বা কর পরিশোধ করতে হবে। নিষিদ্ধ পণ্য আমদানি করা যাবে না। সরকারের অন্য বিধিবিধান মেনে চলতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০২৩
জিসিজি/আরএ