ঢাকা, রবিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

লেবুর রাজ্য মৌলভীবাজারে লেবুর দামে আগুন

ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০২৪
লেবুর রাজ্য মৌলভীবাজারে লেবুর দামে আগুন শ্রীমঙ্গলের সিডলেস লেবু | ছবি: বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

মৌলভীবাজার: লেবুর রাজ্য হিসেবে পরিচিত মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলায় লেবুর দাম ব্যাপক চড়া। রমজান মাস উপলক্ষে বাজারে বাড়তি চাহিদা এবং পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় সপ্তাহখানেক ধরে মৌলভীবাজারের লেবু বাজার অস্থির।

তবে সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগ বলছে, এখানে তো প্রক্রিয়াজাত করে রাখার ব্যবস্থা নেই, যদি সেই ব্যবস্থা থাকতো তাহলে এতটা মূল্যবৃদ্ধি হতো না।

পাইকারি বাজারে লেবুর হালি ৪০ টাকা থেকে ৬০ টাকা থাকলেও খুচরা বাজারে তা ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকা ছুঁয়েছে। বাজারে পর্যাপ্ত লেবু থাকার পরও চড়া দামে তা বিক্রি হচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। কমলগঞ্জ উপজেলায় রয়েছে শতাধিক লেবুর আড়ত। এলাকায় প্রতি দিন লাখ লাখ টাকার লেবু পাইকারি বাজারে বিক্রি হয়। এছাড়া শ্রীমঙ্গল উপজেলাতেও একই চিত্র। কয়েকটি আড়ত ও দোকান ঘুরে সেখানেও দেখা গেছে লেবুর বাজার চড়া।

আড়তদাররা বলেছেন, গত ৯ মাস লেবুর তেমন চাহিদা ছিল না। কৃষকদের খেতের মধ্যেই লেবু পড়েছিল। শ্রমিকদের টাকা দেওয়া কষ্টকর হয়েছে। ১-২ মাস লেবুর চাহিদা থাকে, তখন দামও একটু চড়া থাকে। রমজান মাসে লেবুর চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় দাম বেড়েছে। অথচ লেবুর হালি কিছুদিন আগেও বিক্রি হয়েছে ১০-১৫ টাকায়।

কমলগঞ্জের ভানুগাছ বাজার, আদমপুর বাজার ও শমসেরনগর বাজার এবং শ্রীমঙ্গলের পুরান ও নতুন বাজারে দেখা যায়, প্রতিটি লেবু পিস বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায়। হালি বিক্রি হচ্ছে ঠিক ১১০-১২০ টাকায়। তবে ছোট লেবুর দাম কিছুটা কম।

বাজারে লেবু কিনতে আসা ডলি বেগম বলেন, ‘আমার পরিবারের সব সময় লেবুর দরকার হয়। তাছাড়া রমজান মাস, ইফতারের সময় লেবুর শরবত করে আমরা সবাই খাই। এখন ভানুগাছ বাজারে এলাম লেবু নেওয়ার জন্য। কিন্তু যে লেবু নিয়েছিলাম দুই দিন আগে ১৫-২০ টাকা করে হালি। এখন সেই লেবু কিনতে বাজারে এসে দেখি ১০০ টাকা। অবাক লাগে কী করে এমন দাম হঠাৎ করে বাড়লো? আমার লেবুর প্রয়োজন থাকায় এত দামে নিতে বাধ্য হচ্ছি। কিন্তু তাতে স্বস্তি পাচ্ছি না। ’

শ্রীমঙ্গলের মা বাণিজ্যালয়ের আড়তদার রাজিব আহমদ বলেন, ‘লেবু তিন ধরনের রয়েছে। বড়, ছোট ও মাঝারি। আমরা প্রতিটা পিস লেবু ৮ টাকা থেকে ১৫ টাকা করে পাইকারি বিক্রি করছি। কিছুদিন ধরেই লেবুর বাজার চড়া। যার কারণ হলো, ৯ মাস লেবুর চাহিদা থাকে না। এই ২-১ মাস লেবুর চাহিদা থাকে। যার কারণে লেবুর এই দাম। এবার লেবুর ফলন ভালো হলেও সঠিক সময়ে কৃষক লাভ করতে পারেনি। ৯ মাস লেবুর চাহিদা থাকে না। ফলে কৃষকরা ক্ষতির মধ্যে থাকে। এখন সরবরাহও কম। তাই দাম চড়া। এখানে বিক্রেতাদের কিছু করার নেই। চাহিদা আর সরবরাহের কথা বিবেচনায় দামের এই চড়া ভাব আরও বেশ কিছুদিন থাকবে। ’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা লেবু দাম দিয়ে রাখি। কিছু টাকা হাতে রেখে বিক্রি করে ফেলি। কিন্তু প্রশাসন আমাদের মাঝে মাঝে এসে জরিমানা করে। এতে যেমন আমাদের ক্ষতি হয় তেমন ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতেও মন চায়। ’

লেবু বিক্রেতা আলিম মিয়া বলেন, ‘আমরা পাইকারি বাজার থেকে হালি ৮০-১২০ টাকায় কিনে আনি। অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে তাই ১০০-১৫০ টাকায় বিক্রি করতে হয়। দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বিক্রিও কমেছে সমান হারে। রমজানের জন্য লেবুর শরবতে উপকারিতা থাকায় লেবুর চাহিদা প্রচুর বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বাজারে লেবুর দাম বেড়েছে। ’

শ্রীমঙ্গলের লেবু চাষি শামসুল হক বলেন, ‘আমি ২০-২৫ বছর ধরে লেবুর চাষ করি। এ বছর লেবুর চাষ করেছি ১৫ একর জমিতে। যার জন্য প্রায় খরচ হয়েছে ১০ লাখ টাকার মতো। এই পর্যন্ত বাজারে বিক্রি করেছি ৩-৪ লাখ টাকার মতো। জমিতে কিছু লেবু আছে। যা বিক্রি করলেও আমার মূল টাকা বেরিয়ে আসবে না। ১০ মাস লেবুর দাম পাইনি। লেবু বিক্রি করে আমার লাভ হয়নি বরং ক্ষতি হয়েছে।

‘এখন লেবুর শেষ সময়। আর এই মাসটাই আমাদের একটু লাভ হয়। এই লেবু চাষ করতে গিয়ে আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়। কেউ সেটা বুঝবে না। আমরা বাজারে ঠেলাগাড়ি ও জিপগাড়ি হিসেবে বিক্রি করি। প্রতিটা ঠেলাগাড়ি (৮০০ লেবু) বিক্রি করছি এখন ৬ হাজার ৪০০ টাকা আর জিপগাড়ি (২ হাজার লেবু) বিক্রি করছি ১৪ হাজার ৬০০ টাকা। সবদিন আবার এক যায় না। ’

শামসুল হক আরও বলেন, ‘তবে ৪ মাস আগে প্রতিটা ঠেলাগাড়ি বিক্রি হয় ৪০০ টাকা মাত্র (৮০০ লেবু) ও জিপগাড়ি বিক্রি করছি ১ হাজার ২০০ টাকা (২ হাজার লেবু)। কিছুদিন আগেও আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবাইকে বলেছি ফ্রি লেবু দেব। তখন চাহিদা ছিল না। বাগানেই লেবু পচে থাকতো। আসলে শুধু লাভটা সবাই দেখে, ক্ষতি কেউ খোঁজে না। এখন ৩-৪টা গাছ খুঁজে একটা লেবু পাওয়া যায়। প্রতিটা গাছ থেকে লেবু সংগ্রহ করে বাজারে নিয়ে আসতে হয় গাড়ি করে। তা পাইকারি বাজারে বিক্রি করে কিছু টাকা বের হয়। সেটা খরচও হয় না। হয়তো কিছুদিন পর লেবু চাষ করা ছেড়ে দিতে হবে। ’

শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. মহিউদ্দিন বলেন, শ্রীমঙ্গলে এ বছর ৮০০ এবং কমলগঞ্জে ১৪০ হেক্টর জমিতে লেবু চাষ হয়েছে।

এত লেবু চাষ হওয়ার পরও এত দাম কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, সারা বছর লেবুর চাষ হয়। কিন্তু কৃষকরা তো সারা বছর লাভ করতে পারেন না। ১০ মাসে খরচটা বের করে আনা তাদের দায় হয়ে পড়ে। এই দুই মাস লেবুর একটু চাহিদা। তাই এই সময়টাতে তারা কিছুটা লাভ করে।

কৃষিবিদ মহিউদ্দিন আরও বলেন, এখানে তো প্রক্রিয়াজাত করে রাখার ব্যবস্থা নেই। যদি সেই ব্যবস্থা থাকতো তাহলে দাম এতটা হতো না। আমরা কর্তৃপক্ষকে বিষয়টা অবগত করেছি। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে এখানে প্রক্রিয়াজাতের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ২০৫২ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০২৪
বিবিবি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।