ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

টুপি তৈরিতে ব্যস্ত বগুড়ার নারীরা

কাওছার উল্লাহ আরিফ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ৭, ২০২৪
টুপি তৈরিতে ব্যস্ত বগুড়ার নারীরা

বগুড়া: বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় টুপি পল্লীতে নারীদের নিপুণ হাতের ছোঁয়া আর সুতা ও ত্রুশ কাঁটার মিলিত বন্ধনেই তৈরি হচ্ছে রকমারি টুপি।

ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে বাহারি ডিজাইনের টুপি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন টুপি পল্লীর কারিগররা।

শেরপুরে তৈরি হাতে বোনা জালি টুপি দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। ঘরে বসে গ্রামীণ নারীদের অর্থ উপার্জনের নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে এ টুপি।

সম্প্রতি জেলার শেরপুর ও ধুনট উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে টুপি তৈরিতে নারীদের ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা যায়।  

এ শিল্পে জেলার শেরপুর উপজেলার নারীরা অগ্রগামী হলেও ধুনট, সদর, শিবগঞ্জ উপজেলাসহ বিভিন্ন গ্রামে এমন টুপি পল্লী গড়ে উঠছে। অসংখ্য নারী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত টুপি শিল্পের সঙ্গে। এতে করে সন্তানদের ছোটখাটো আবদার রক্ষার পাশাপাশি পরিবারকেও সহযোগিতা করতে পারছেন গ্রামীণ নারীরা।

শেরপুর ও ধুনট উপজেলার প্রায় সব গ্রামের নারীরাই টুপি তৈরির সঙ্গে জড়িত। শেরপুর উপজেলার জয়লা-জুয়ান, জয়লা-আলাদি, কল্যাণী, চক-কল্যাণী, গুয়াগাছী, বিনোদপুর, মির্জাপুর, খানপুর, খানপুর দহপাড়া, ভিমজানি ও ধুনটের বহালগাছা, চৌকিবাড়ি, ফড়িংহাটা, কুড়হা-হাটা, বিশ্বহরিগাছা, চানদার, ভূবনগাতি, চালাপাড়া, পাঁচথুপি, থেউকান্দি, বাটিকাবাড়ি পেঁচিবাড়ী, জালশুকা, বেলকুচি, বিলকাজুলি, অলোয়া, শ্যামগাতী, পিরহাটি, খাদুলী, হিজুলী, সাগাটিয়া, কাশিয়াহাটা, শাকদহ, মথুরাপুর ও মাটিকোড়সহ অসংখ্য গ্রামের প্রায় লক্ষাধিক নারী এ পেশার সঙ্গে জড়িত।

নারী টুপি শিল্পীরা জানান, টুপি বিক্রি করে সংসারের অভাব-অনটন দূর করা সম্ভব হচ্ছে। রমজান মাসকে ঘিরে সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন শহর থেকে ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি এসে গ্রামে গ্রামে ঘুরে নগদ টাকায় সংগ্রহ করেন টুপিগুলো। রমজান ও ঈদ উপলক্ষে টুপির চাহিদা বেশি থাকায় চাপ বেড়েছে কারখানাগুলোতেও।

কয়েক দশক আগে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার কল্যাণী গ্রামের গৃহবধূরা টুপি বানানো শুরু করেন। সে সময় নারী-পুরুষ সবাই টুপি তৈরি করে বিক্রি করতেন। এরপর থেকে তা আস্তে আস্তে চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এমনকি বিগত এক যুগের ব্যবধানে টুপি তৈরিতে অনেকটা বিপ্লব ঘটে যায়। বর্তমানে শেরপুর উপজেলার প্রায় শতাধিক গ্রামে কমবেশি বাণিজ্যিকভাবে টুপি তৈরি করা হচ্ছে।

শেরপুর উপজেরার কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, বাড়ির উঠানে, বারান্দায় ও গাছ তলায় বসে গৃহবধূ সালমা বেগম, তৌহদা খানম, সেজুতি রানীসহ একদল নারী একত্রে গল্পের ফাঁকে ফাঁকে সুতা আর ত্রুশ কাটা দিয়ে টুপি বানাচ্ছেন। বাড়িতে অবসর সময়টা বসে থাকার চেয়ে কিছু একটা করাই ভালো। এমন ভাবনা এবং ঐতিহ্যকে ধারণ করতে অনেকেই টুপি শিল্পের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছেন।

তারা বাংলানিউজকে জানান, গ্রামের স্কুল পড়ুয়া ছোট মেয়েরাও লেখাপড়ার পাশাপাশি টুপি তৈরি করে থাকে। এছাড়া গ্রামের গৃহবধূরা সাংসারিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে টুপি বানিয়ে থাকেন। তা থেকে আয় মন্দ হয় না। বিশেষ করে প্রতি বছর রমজান মাসে গ্রামে গ্রামে টুপি তৈরির হিড়িক পড়ে যায়।  

তারা বলেন, সংসারের সব কাজ শেষ করে ক্রুশ কাঁটা নিয়ে বসে থেকে টুপি তৈরি করি।

টুপির রয়েছে হরেক নাম। বিভিন্ন নামের টুপি তৈরি করে থাকেন তারা। এর মধ্যে তাহফিজ, স্টার, বুটা, কদমফুল, মাকড়াসা, ফ্যান ফুল, রাজু বুটা, নব্বই ফুল, আনারস, গাছ, ফুল ডিজাইনের জাল টুপি বেশি তৈরি হয়। টুপি তৈরির পর সে সব টুপি ধুয়ে পরিষ্কার করে রোদে শুকিয়ে দেওয়া হয়। পরিষ্কার টুপি পাইকাররা বেছে বেছে কিনে প্যাকেট করে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করেন।

দামের কথা জানতে চাইলে তারা জানান, টুপি তৈরির ক্ষেত্রে একেকটা একেক দাম হয়ে থাকে। ভালোমানের টুপি ১০০ টাকা পর্যন্ত এবং জালি টুপির দাম সর্বনিম্ন ৩০ টাকা হয়ে থাকে। এ টুপি আবার বাজারে বিভিন্ন দামে বিক্রি হয়। একজন নারী কারিগর দিনে ২০ থেকে ২২টি সাধারণ নকশা করা টুপি বানাতে পারেন। ক্রুশ কাঁটায় জালি টুপি দিনে বানাতে পারেন আট থেকে ১০টি। তাদের প্রতিদিনের আয় গড়ে ২৫০-৪০০ টাকা।

টুপির পাইকারি ব্যবসায়ী আফজাল হোসেন, আব্দুল মোতালেব মিয়া বাংলানিউজকে জানান, টুপি বানাতে নারীদের খুব একটা পুঁজি লাগে না। চিকন ও মোটা সূতার একেকটি ববিন ৯০ থেকে ২০০ টাকা দাম ধরে টুপি শিল্পীদের দেওয়া হয়। এক ববিন সুতা থেকে ডিজাইন ভেদে প্রায় ১৫টি টুপি তৈরি করা সম্ভব। এসব টুপি সুতার দাম ছাড়া প্রতিটি ডিজাইন ভেদে ৩০ টাকা থেকে শুরু করে ১০০ টাকায় কেনা হয়। তৈরি করা টুপির প্রায় ৭০ শতাংশ মূল্য নারীদের দেওয়া হয়। এছাড়া ১০ শতাংশ সুতার ব্যয় এবং অবশিষ্ট ২০ শতাংশের মধ্যে কিছু উৎপাদন খরচ বাদে বাকিটা তাদের আয় হয় বলে জানান তারা।

তারা জানান, নারীদের তৈরি করা এসব টুপি নিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের রপ্তানিকারকরা তাদের কাছে অর্ডার দেন। পরে রপ্তানিকারকরা এসব টুপি সৌদি আরব, দুবাই, কাতার, ইরাক, ইরান, মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপালসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করেন।

ব্যবসায়ীরা জানান, বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি টুপি তৈরি হয়ে থাকে। তাহফিজ নামে জালি টুপির কদর এবার সবচেয়ে বেশি। দেশীয় টুপি নিতে দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ীরা অগ্রিম অর্ডার দিয়ে থাকেন। সেই অনুযায়ী নারীদের পারিশ্রমিক দিয়ে টুপি তৈরি করিয়ে নেওয়া হয়। পরে এসব বাহারি ডিজাইনের টুপি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়।

শেরপুর উপজেলায় অবস্থিত টুপি রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান জুয়েল ক্যাপ ডিপোর ম্যানেজার আহসান জামিল আপন বাংলানিউজকে জানান, বিদেশে টুপির বাজার ধরতে টুপির মানোন্নয়নে শেরপুরে গড়ে তোলা হয়েছে টুপি রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। এখানে টুপি বানানোর সুতার ববিন তৈরি হয়। প্যাকেজিং ইউনিটে টুপি ধোলাই ও ক্যালেন্ডারের পর কার্টনে ভরে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যে বগুড়ার তৈরি টুপির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।

বিসিকের বগুড়া জেলা কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপ-মহাব্যবস্থাপক এ.কে.এম. মাহফুজুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, বগুড়ায় লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের মতো এটিও (টুপি শিল্প) একটি সম্ভাবনাময় খাত। বিসিক থেকে উদ্যোক্তাদের এরই মধ্যে ঋণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। আরও চাহিদা রয়েছে। বরাদ্দ পেলে প্রান্তিক পর্যায়ে আরও ঋণ  দেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৭, ২০২৪
কেইউএ/এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।