শাবিপ্রবি, (সিলেট): আজ বিশ্ব চা দিবস। সূচনালগ্ন থেকেই চা সর্বত্র পানীয়, বিশ্বব্যাপী তাৎপর্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বহন করে আসছে।
বিশ্ব চা দিবসে বাংলাদেশের চা শিল্পের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টি টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ও চা গবেষক ড. ইফতেখার আহমেদের সঙ্গে কথা হয় বাংলানিউজের।
বিশ্ব চা দিবসের তাৎপর্য নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০০৫ সালে চা উৎপাদনকারী দেশগুলো এক হয়ে আন্তর্জাতিক চা দিবস পালন করে। এই দেশগুলো- শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, কেনিয়া, মালয়েশিয়া ও উগান্ডা। পরে ২০১৯ সালে ২১ মে বিশ্ব চা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০১৯ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ চা দিবসকে হ্যাঁ বলে। ২০২০ সালের ২১ মে জাতিসংঘ প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব চা দিবস পালন করে। বর্তমানে চা উৎপাদনে বিশ্বে নবম বাংলাদেশ। বাংলাদেশ থেকে চা রপ্তানি হচ্ছে পাকিস্তান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিশ্বের ২৫টি দেশে।
এছাড়াও চা উৎপাদনে মাঠ থেকে শুরু করে কাপে চুমুক দেওয়া পর্যন্ত বিশেষ করে নারীদের পরিশ্রম ও ত্যাগ রয়েছে। তাদের প্রতিটি অবদানকে সম্মান প্রদর্শন এবারের চা দিবসে অনন্য মাত্রা যোগ করে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে চা শিল্প অনেক এগিয়ে গেছে। এ পর্যন্ত ২১টি উচ্চফলনশীল জাতের ক্লোন অবমুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া খরাসহিষ্ণু ও উন্নত ফলনের আরও দুটি ক্লোনও অবমুক্ত করা হয়েছে। চা-শিল্পের বর্তমান বয়স ১৭৮ বছর। সুদীর্ঘ পথচলায় এ শিল্পের রয়েছে অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের ইতিহাস।
বাংলাদেশের চায়ের পথচলা নিয়ে ড. ইফতেখার বলেন, বাংলাদেশে প্রথম চা বাগান করার উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৮২৮ সালে। ১৮৪০ সালে চট্টগ্রাম ক্লাব প্রথম চা-গাছ রোপণ করা হয়। এরপর ১৮৫৪ সাল থেকে সিলেটে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়। সে বছর সিলেট শহরের উপকণ্ঠে মালনীছড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত তখন থেকেই চা এ দেশে একটি কৃষি-শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
চা শিল্পের সংকট-সম্ভাবনা নিয়ে এই চা গবেষক বলেন, চা শিল্প একটা সম্ভাবনার নাম কিন্তু আজকের দিনেও বেশ কিছু জটিল চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন যা এর চিরস্থায়ী এবং লাভজনকতাকে হুমকির মুখে ফেলে। বর্তমানে বিশ্ববাজারে চায়ের দাম কমছে। উৎপাদন খরচ মেটাতেও ব্যর্থ হচ্ছে চা উৎপাদনকারীরা। এই অর্থনৈতিক চাপ অনেক চা উৎপাদনকারীর জন্য উল্লেখযোগ্য আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশে চা শ্রমিকদের শোচনীয় অবস্থা সম্পর্কে সবার অজানা নেই। এতে দেখা যায়, দেশে চা-শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। বাংলাদেশের ৯৫ শতাংশের বেশি নারী চা-শ্রমিকের কোনো নিয়োগপত্র নেই। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি নারী। চা-শ্রমিকদের মাসিক বর্তমান গড় আয় ৪ হাজার ৯৮২ টাকা (প্রায়)। অধিকাংশ শ্রমিকের ক্ষেত্রে মজুরি দেওয়ার আগে কোনো বেতন রশিদ দেওয়া হয় না। পাশাপাশি নারী কর্মীদের যৌন হয়রানির মতো ঘটনাতো রয়েছেই।
বাংলাদেশের চায়ের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানাতে গিয়ে অধ্যাপক ইফতেখার আহমেদ বলেন, নিলামের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ মৌসুমে চট্টগ্রামে ৫০টি নিলামে চা বিক্রি হয়েছে ৯ কোটি ৪৮ লাখ কেজি। প্রতি কেজিতে দাম মিলেছে ১৭১ টাকা ৯১ পয়সা। চা উৎপাদনের উচ্চ মান বজায় রাখা যেখানে বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতার জন্য অপরিহার্য, তবুও জলবায়ু পরিবর্তন, কীটপতঙ্গের উপদ্রব এবং সেকেলে কৃষি অনুশীলনের মতো কারণগুলো চায়ের গুণমান এবং ফলন উভয়কেই নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে আসছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চায়ের প্রভাব রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, চা বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে উল্লেখ করা যায়। পাটের পর দ্বিতীয় সর্বাধিক রপ্তানিকৃত অর্থকরী ফসল হিসেবে এর অবদান আমরা ভোগ করে আসছি। চা শিল্পের দরুন আজ জাতীয় জিডিপিতে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখে এবং প্রায় চার মিলিয়ন লোকের কর্মসংস্থান ও সরাসরি তাদের জীবিকাকে প্রভাবিত করে আসছে। তবে চা শিল্পের রপ্তানি বাড়াতে হলে উৎপাদিত চায়ের গুণগত মান উন্নত করার বিকল্প নেই।
বাংলাদেশে চা শিল্পের সম্ভাব্যতা ও বর্তমান অবস্থা নিয়ে এ চা গবেষক বলেন, বাংলাদেশের চা বাগানের সম্মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা অভ্যন্তরীণ এবং রপ্তানি চাহিদা উভয়ই পূরণ করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই এর শক্তিশালী অবস্থান পরিলক্ষিত হয়। দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬৮টি বাগান ও ক্ষুদ্র চাষিদের বার্ষিক চা উৎপাদনের চূড়ান্ত হিসাব অনুযায়ী, বার্ষিক উৎপাদন ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ বেড়েছে। ২০২২ সালের ৯৩ দশমিক ৮৩ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হয়েছিল এবং গত বছরের ফলন ১৭০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। উৎপাদনশীলতা ও গুণমান বাড়ানোর জন্য আধুনিক কৃষি পদ্ধতি ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নতুন প্রজাতির চায়ের জাত উদ্ভাবন এবং উন্নত চাষের কৌশল প্রয়োগ করা এখন সময়ের দাবি।
বিশ্ববাজারে চায়ের চাহিদা সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশে মূল বাগান এবং ফাঁড়ি বাগান মিলিয়ে মোট ২৫১টি চা বাগানে মোট জনসংখ্যা সাত লক্ষাধিক। ২৫১টি চা বাগানের মধ্যে ১৬৩টি মূল বাগান ও ৮৮টি ফাঁড়ি বাগান। যেসব চা বাগানে চা প্রক্রিয়াজাতকরণ ফ্যাক্টরি রয়েছে, সেসব বাগানকে মূল বাগান এবং ফ্যাক্টরিবিহীন চা বাগানগুলোকে ফাঁড়ি বাগান হিসেবে অভিহিত করা হয়। ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়া চা বাগান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সিলেট অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষের শুরু হয়। তারপর থেকে গড়ে উঠে নতুন নতুন চা বাগান, বাড়তে থাকে উৎপাদন। ধীরে ধীরে চা হয়ে উঠে সবার পছন্দের পানীয়। দেশে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৫৩টি চা বাগান ছিল।
বর্তমানে বিশ্ব বাজারে বর্তমানে চায়ের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈশ্বিক বিষয়বলির দিকে তাকালে ধারণা করা যায়, ২০১২-২০২৫ সাল অবধি এক ব্যাপক চা বিপ্লব শুরু হয়েছে। এমনকি ২০২২ সালে ৬ দশমিক ৭ বিলিয়ন কিলোগ্রাম চা কনজিউম করেছে এবং এই গ্রাফ থেকেই আশা করা যায় আগামী ২০২৫ সাল নাগাদের পরিমাণ ৭ দশমিক ৪ বিলিয়নে গিয়ে পৌঁছাবে।
চা শিল্পের উন্নয়নে চা-প্রযুক্তিবিদদের অবদান সম্পর্কে তিনি বলেন, দেশের চা-প্রযুক্তিবিদরা চা শিল্পের বাড়ানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এতে চায়ের নতুনত্ব, নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার, চা বিতরণ ও উদ্ভাবন, দক্ষতাসহ সবকিছুতেই টেকসই উন্নয়ন নিয়ে এসে চা শিল্পকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।
পরিশেষে এই চা গবেষক বলেন, চা শ্রমিকদের নিত্যদিনের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা, টেকসই অনুশীলন নিশ্চিত করা এবং শিল্পের অর্থনৈতিক তাৎপর্যকে স্বীকৃতি দেওয়া একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আন্তর্জাতিক চা দিবস এই লক্ষ্যগুলোর একটি অনুস্মারক হিসাবে কাজ করে, চায়ের ফসল থেকে কাপ অবধি প্রতিটি পদক্ষেপ উদযাপন করা এবং যাদের অবদান তাদের সম্মান করা। তাতে নারীদের অবদানকে স্বীকার এবং টেকসই উন্নয়নের প্রচারের মাধ্যমে, চা শিল্প ক্রমাগত বৃদ্ধি ও সমৃদ্ধ হবে এবং বাংলাদেশের চা শিল্পের চিরস্থায়িত্ব ও উন্নয়ন অব্যাহত থাকবে। সর্বোপরি দেশ ও দেশের শিল্প এগিয়ে যাক এই কামনা রইল।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৮ ঘণ্টা, মে ২১, ২০২৪
এএটি