ঢাকা: বরাবরের মতো এবারও চলতি অর্থবছরের চেয়ে টাকার অঙ্ক আরও বাড়িয়ে আগামী ৬ জুন (২০২৪-২০২৫) অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ ও রাজস্ব আদায়ের বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
যা হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ আকারের বাজেট।
এটি হবে বর্তমানে অর্থমন্ত্রীর আবুল হাসান মাহমুদ আলীর প্রথম বাজেট উত্থাপন। ইতোমধ্যে সব প্রস্তুতি শেষ বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। ফলে ব্যস্ত সময় পার করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এদিকে বৈশ্বিক সংকটের কথা বিবেচনায় নিয়ে নতুন অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ছয় শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণসহ রিজার্ভ ও রাজস্ব আয় বাড়ানোর বিষয় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। মূল্য কমিয়ে নিত্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে।
একই সঙ্গে সরকারি রাজস্ব আয়ের পরিকল্পনা সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি ধরে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট সাজানো হচ্ছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে সরকার রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্য ঠিক করতে যাচ্ছে তাতে চলতি অর্থবছরের তুলনায় অনেক বেশি টাকা জোগাড় করতে হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)।
এছাড়া নতুন বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হচ্ছে না। দুই বছর পর আবারও অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হতে পারে। এবার বাজেট সামনে রেখে কর ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন না করা হলেও নিত্যপণ্য আমদানিতে উৎসে কর পুরোপুরি বাতিল করা হতে পারে কিংবা এটি দুই শতাংশ থেকে কমিয়ে এক শতাংশ করা হতে পারে।
সম্প্রতি গণভবনে অনুষ্ঠিত ২০২৪-২৫ সালের বাজেট প্রস্তুতির সারসংক্ষেপ উপস্থাপন-বিষয়ক বৈঠকে চলতি অর্থবছরের মতো আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটকেও ব্যয় সংকোচনমুখী করার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আগামী বাজেটেও বিলাস-পণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করার পক্ষে মত দিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই হবে আগামী বাজেটের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি যে সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তাতে সঠিক দিশা ঠিক করতে না পারলে ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। অর্থনীতিকে পথ দেখাতে হলে আগামী বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন পরিকল্পনায় বড় চ্যালেঞ্জ সামলাতে হবে।
বিশেষ করে বাজেটের কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ যেন না বাড়ে, রিজার্ভ যাতে আরও হারিয়ে না যায় এবং রাজস্ব আদায়ে বাড়তি নজর দিতে হবে।
তারা বলছেন, বছর ঘুরে প্রতিবার বাজেটের আকার বাড়লেও বাস্তবায়ন ঘাটতির পুরোনো চিত্রই থাকছে। আরও একটি অর্থবছর শেষ হতে যাচ্ছে একই ধারায়। আসছে বাজেটেও বড় আকারের বাস্তবায়ন ঘাটতি থেকে যাবে।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বাংলানিউজকে বলেন, শুধু পরিকল্পনা করলেই হবে না, অর্থ তো নাই। মূল সমস্যা হচ্ছে, অর্থনীতির ওপর আমাদের আস্থা চলে গেছে। সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনার ওপর আস্থা কমে গেছে।
মূল্যস্ফীতি আমাদের অর্থনীতির মূল সমস্যা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ডলার সংকটের কারণে রিজার্ভ কমে যাওয়ার পাশাপাশি চাপ বেড়েছে মূল্যস্ফীতির। গত বছরের মার্চ থেকে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে রয়েছে। অথচ চলতি অর্থবছরে যা ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার পরিকল্পনা নিয়েছিল সরকার। এজন্য সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে সরকারের ডমেস্টিক ভলিউমটা কমাতে হবে। আমাদের প্রবৃদ্ধি সহজে হবে না। কেননা আমাদের ব্যাংকিং খাতের অবস্থা অনেক খারাপ। সেটা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য বাজেটের কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ যেন না বাড়ে, সে দিকে নজর দিতে হবে এটাই মূল চ্যালেঞ্জ।
অর্থনীতিবিদ বলেন, আমাদের রিজার্ভ বাড়াতে হবে। ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে অর্থনীতির ওপর আস্থা থাকবে না। আমরা এদিক-সেদিক করলেই খাদে পড়ে যেতে পারি। কারণ আমাদের রিজার্ভ নাই। ২৪ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ আমরা হারিয়ে ফেলেছি। তাই আমাদের সতর্কভাবে চলতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন গ্রস হিসাবে ২৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে রয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটের আগে যা ছিল ৩১ বিলিয়ন ডলারের উপরে।
রাজস্ব আহরণ নিয়ে তিনি বলেন, লক্ষ্য যদি ৫ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা ধরে থাকে তাহলে আমি বলব, এটা বাস্তবতা ও অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে অনেক বেশি ধরা হয়েছে। সঠিক নীতি কৌশল অবলম্বন করা হলে এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার আনা গেলে এটা যে অর্জন সম্ভব না তাও বলা যাবে না। কিন্তু আমরা অতীতে দেখেছি যে, রাজস্ব আহরণের উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা কখনও বাস্তবায়ন করা যায়নি।
তিনি বলেন, রাজস্ব আহরণ অর্জন করা সম্ভব হবে না। টার্গেট যেটা ফিক্সড করেছে, সেটা রিভাইস বাজেটের সাথে ঠিক আছে। কিন্তু রিভাইস বাজেটই তো অর্জন করা সম্ভব হবে না। এটি বরাবরই থাকে এবং সমস্যা তৈরি করে। বাজেট বাস্তবায়নকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, বাস্তবায়নের জন্য আমাদের রাজস্ব বাড়াতে হবে বাজেট বাস্তবায়নে আমাদের সক্ষমতা বাড়ছে না। লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না এবং আগামী বছরও হবে না। যতদিন রাজস্বে ঘাটতি থেকে যাবে, এর সমাধান করা যাবে না। সেজন্য রাজস্বের সঙ্গে মিল রেখে ব্যয় কমাতে হবে। আমরা অপ্রয়োজনীয় অনেক খাতে ব্যয় করে থাকি। সেই জায়গাটি বন্ধ করতে হবে। তাহলে মোটামুটি ঠিক থাকবে।
অর্থমন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি ব্যয় বরাদ্দ রেখে বাজেট পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার। এর মধ্যে পরিচালনসহ অন্যান্য ব্যয় ৪ লাখ ৯৮ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ব্যয় ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা।
এছাড়া আসন্ন বাজেটে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমাতে বিশেষ কিছু জায়গায় কর ও ভ্যাটে ছাড় থাকলেও এবার রাজস্ব আদায়ের আওতা আরও বাড়ানো হচ্ছে। আগামী বাজেটে সরকারের রাজস্ব আয়ের পরিকল্পনা ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা জোগাড় করার লক্ষ্য ঠিক করে দেওয়া হতে পারে এনবিআরকে।
আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে রাজস্ব আদায় বাড়াতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়ার কথা উল্লেখ করা হবে। এর মধ্যে ১০ লাখ বা এর বেশি মূসক (ভ্যাট) পরিশোধের ক্ষেত্রে ই- পেমেন্ট বা এ-চালান বাধ্যতামূলক করা হবে। বর্তমান ই-পেমেন্ট বা এ-চালান শুধু ৫০ লাখ টাকা বা তার বেশি ভ্যাট পরিশোধে ব্যবহারের বিধান আছে।
এদিকে ইলেকট্রনিকস ট্যাক্স ডিটেকশন সোর্স (ইটিডিএস) অনলাইন প্ল্যাটফরম চালুর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বৃদ্ধি, সেবার মান উন্নয়ন ও রাজস্ব আদায় বাড়াতে আয়কর আইন, ২০২৩ প্রয়োগ করা হবে। এবারের বাজেটে আয়কর খাতে কর অবকাশ সুবিধা কাটছাঁট করা হতে পারে। বিত্তবানদের কাছ থেকে আয়কর আদায় বাড়াতে ব্যক্তিশ্রেণির সর্বোচ্চ করহার ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হতে পারে।
এদিকে আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এ কারণে খাদ্যনিরাপত্তা জোরদার করে ভোগ্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার কৌশল রয়েছে আগামী বাজেটে।
এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, আমাদের মূল লক্ষ্য অর্থনীতিকে অনট্র্যাকে ফিরিয়ে আনা। একই সঙ্গে নিত্যপণ্য যাতে মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে, এগুলো নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে সরকার যে নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছিল, সেটির একটা রিফ্লেকশন দেখতে চাই। আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ থাকবে মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ ও রাজস্ব আদায়। আমরা সংকোচনমূলক সময় পার করছি। সংকোচন থেকে কীভাবে সম্প্রসারণ করা যায়, সেটিই চেষ্টা করছি। এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন সামনে রেখেই বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। সর্বোপরি আগামী বাজেটে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে।
অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, সামগ্রিকভাবে বলা যায়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রপ্তানিপণ্যের বৈচিত্র্যকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও প্রান্তিক মানুষের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবারের বাজেটের অগ্রাধিকারে থাকবে। নতুন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে। এবার বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অগ্রাধিকার পাচ্ছে। পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া যেসব খাত দীর্ঘদিন কর অবকাশ সুবিধা পেয়ে আসছে, সেসব খাত থেকে কর অব্যাহতির সুবিধা উঠিয়ে দেওয়ার বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
মূল্যস্ফীতি: আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষের আগ্রহ- বাজেটে খাদ্যপণ্যের দাম কমাতে কী পদক্ষেপ থাকছে। টানা ২২ মাস দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। খাদ্যপণ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্য-উভয় খাতেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার অব্যাহত আছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসেও তা বজায় রয়েছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদনে ২০২৩ সালের মে থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৪১ থেকে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে। গত এপ্রিলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ২২ শতাংশ, যা মার্চে ছিল ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি সাড়ে ছয় শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা বেশ কঠিন।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে খাদ্যপণ্যের দাম কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। খাদ্যপণ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে হবে। বিশেষ করে ধান, চাল, পেঁয়াজ, মাছ, পোল্ট্রি ও গবাদিপশু উৎপাদন ও লালন-পালনে সরকারের ভর্তুকি ও প্রণোদনা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। একই সঙ্গে কৃষকের স্বার্থে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে।
রাজস্ব আদায়: সরকারি রাজস্ব আয়ের পরিকল্পনা সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি ধরে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট সাজানো হচ্ছে। এর সিংহভাগই ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা জোগাড় করার লক্ষ্য ঠিক করে দেওয়া হতে পারে দেশের প্রধান রাজস্ব আহরণকারী সংস্থা এনবিআরকে।
এমনটি হলে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ঘোষিত বাজেটের চেয়ে মোট রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় অর্ধ লাখ কোটি টাকা বেশি, তবে সংশোধিত লক্ষ্যের চেয়ে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি। অবশ্য সংশোধিত লক্ষ্যের চেয়ে আদায় এখন পর্যন্ত ৮ শতাংশ কম। যদি শেষ পর্যন্ত আদায় না বাড়ে, তাহলে চলতি অর্থবছরের তুলনায় এক লাখ কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আয় করতে হবে আগামী অর্থবছর।
চলতি অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের মাধ্যমে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। কর বহির্ভূত ও অন্যান্য আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ২০ হাজার কোটি টাকা। কর ছাড়া প্রাপ্তি ধরা হয় ৫০ হাজার কোটি টাকা।
এছাড়া রাজস্ব আদায় বাড়াতে মোবাইলফোন কলের ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হবে। বর্তমানে গ্রাহকরা ১০০ টাকা দিয়ে মোবাইল রিচার্জ করলে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ কেটে নেওয়ার পর ৭৩ টাকার কথা বলতে পারেন। আবারও সম্পূরক শুল্ক পাঁচ শতাংশ বাড়ানো হলে গ্রাহকরা ১০০ টাকার মধ্যে ৬৯ টাকা ৩৫ পয়সার কথা বলতে পারবেন।
এদিকে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫ দশমিক ৬১ শতাংশ রাজস্ব প্রবৃদ্ধি অর্জন করার পরও, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বরং ঘাটতি ছাড়িয়ে গেছে ২৪ হাজার ২০৭ কোটি টাকা। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম (জুলাই-এপ্রিল) ১০ মাসে বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার ২৯ দশমিক ৪২ শতাংশ অর্জন করা যায়নি। আলোচ্য সময়ে আদায় হয়েছে ২ লাখ ৮৯ লাখ ৩৭৬ কোটি টাকার রাজস্ব। একই সময়ে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ১৩ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা।
এনবিআর প্রতিবেদন বলছে, চলতি অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছিল এনবিআরকে। পরে বড় অঙ্কের ঘাটতি পড়ে যাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে তা ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। এনবিআর’র এক কর্মকর্তা বলেন, রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৯২.২৮ শতাংশ অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের হার ছিল ৮৭.৮০ শতাংশ।
এনবিআরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, এবারের বাজেটে কর ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন না হলেও নিত্যপণ্য আমদানিতে বিশেষ ছাড় দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে কর ও ভ্যাট কমানোর মতো সুযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং দ্রব্যমূল্য কমাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। আর এ কারণে কোনো কোনো জায়গায় এনবিআর ছাড় দিলে ভোগ্যপণ্যের দাম কমবে, সে বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। আশা করছি, নিত্যপণ্যের দাম কমানোর উদ্যোগ থাকবে বাজেটে।
রিজার্ভ: বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে। বর্তমানে মোট রিজার্ভ কমে ২ হাজার ৩৭৭ কোটি ডলারে (২৩ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন) দাঁড়িয়েছে। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ এখন ১ হাজার ৮৩২ কোটি ডলার (১৮.৩২ বিলিয়ন)। প্রকৃত বা ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারের কিছুটা কম। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে আজ এ তথ্য পাওয়া গেছে।
আগামী বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে: আগামী অর্থবছরে ফের কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ আসতে পারে। এই সুযোগ দেওয়া হতে পারে এক বছরের জন্য। দুই বছর আগে ১০ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তেমন সাড়া না পাওয়ায় পরে এ সুযোগ বাতিল করা হয়। এর পরের বছর দেশ থেকে পাচার করা টাকা ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া হলেও কেউ এই সুযোগ নেয়নি। এক বছর বিরতির পর আগামী অর্থবছরে আবারও ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হতে পারে।
করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ছে না: আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ছে না। তবে করদাতার হয়রানি কমাতে আয়কর রিটার্ন অ্যাসেসমেন্টের বিধান বাতিল করা হচ্ছে। এ জন্য বাজেটে আয়কর আইনে বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে এনবিআর। এ সিদ্ধান্তের ফলে ব্যক্তি ও কোম্পানি দুই শ্রেণির করদাতাই কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে।
এনবিআর মনে করে, করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়লে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী আয়করের আওতার বাইরে চলে যাবে। মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, সেই সঙ্গে আনুপাতিক হারে মানুষের আয়ও বেড়েছে। তাই সীমা বাড়ানোকে যৌক্তিক মনে করে না সংস্থাটি। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরের বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা তিন লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা করা হয়েছে। ২০২০-২১ সালে করমুক্ত আয়ের সীমা আড়াই লাখ থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে আড়াই লাখ টাকা করা হয়। বর্তমানে নারী করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা চার লাখ টাকা।
কমতে পারে করপোরেট করহার: শর্তসাপেক্ষে করপোরেট করহার কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআর। উৎপাদনশীল খাতে তালিকাভুক্ত নয় এমন শিল্পে কর সাড়ে ২৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা করা হতে পারে। তবে অন্য সব খাতে কর অপরিবর্তিত থাকবে।
এ ছাড়া কৃষি উপকরণ আমদানিতে শুল্ক সুবিধা অব্যাহত রাখা হবে। রাজস্ব আদায় বাড়াতে বিত্তবানদের ওপর বাড়তি কর আরোপের পরিকল্পনা করছে এনবিআর। ১৬ লাখ টাকার বেশি বার্ষিক আয়ের ক্ষেত্রে ব্যক্তি পর্যায়ের করহার ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হচ্ছে।
বিভিন্ন খাতে কর অব্যাহতি হ্রাস এবং শেয়ার বাজারের বিনিয়োগ থেকে মূলধনি আয়ের ওপর কর ছাড় প্রত্যাহারের পরিকল্পনাও করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। চলতি বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। তবে পরে এটি সংশোধন করে চার লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে।
বাড়বে বাজেটের ঘাটতি মেটাতে ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা: বাজেটের ব্যয় মেটাতে সরকারের ঋণনির্ভরতা আরও বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের মতো আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের জন্যও সরকার বিপুল পরিমাণ ঋণ করতে যাচ্ছে। আগামী বাজেট হতে পারে প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার। এর এক-তৃতীয়াংশ অর্থই আসবে দেশি-বিদেশি ঋণ হিসেবে। ঋণের পরিমাণ হতে পারে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো।
আগামী অর্থবছরে মোট ঋণের মধ্যে নিট বিদেশি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকার মতো। বাকি ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা হতে পারে দেশি ঋণ। দেশি ঋণের মধ্যে ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে। বাকি ২০ হাজার কোটি টাকা নেয়া হবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও অন্যান্য উৎস থেকে। বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছরে মোট ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা।
ব্যয় বাড়বে সুদ পরিশোধে: সুদ পরিশোধের জন্য আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে বড় আকারের অর্থ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। রাজস্ব আদায় প্রত্যাশা মতো না হওয়ার পাশাপাশি উন্নয়ন ব্যয় মেটানো-এসব ধরে নিয়েই সরকার বড় আকারের ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা করছে। এই ঋণের বিপরীতেই গুনতে হবে বড় অঙ্কের সুদ। বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ বরাদ্দ থাকবে ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে দেশি ঋণের সুদ ১ লাখ ৮ হাজার কোটি এবং বিদেশি ঋণের সুদ ২০ হাজার কোটি টাকা। পাঁচ বছর আগের তুলনায় এ বরাদ্দ দ্বিগুণের কাছাকাছি। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সুদ খরচ বাবদ ৯৪ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো বলছে, অর্থবছর শেষে সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় আরও বাড়তে পারে।
বাড়ছে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী: আগামী অর্থবছরে বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মোট বরাদ্দ রাখা হবে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। চলতি অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। নগদ সহায়তা, খাদ্যসহায়তা ও কর্মসৃজন, বৃত্তি, বিশেষ সহায়তা, বিশেষ জনগোষ্ঠীর জন্য সহায়তা, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ইত্যাদি বিষয়ে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী খাতের আওতায় ১১৫টি বিষয় বা কর্মসূচি রয়েছে। বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে ২৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ।
খাদ্যনিরাপত্তা ও কর্মসৃজন কর্মসূচিতে থাকছে ১১টি বিষয়। এ ছাড়া বৃত্তি বাবদ ৬টি, নগদ ও খাদ্যসহায়তা সংক্রান্ত ১৭টি, ঋণসহায়তার ২টি, বিশেষ সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠীর ১৩টি, বিভিন্ন তহবিল ও কর্মসূচি ৯টি এবং ৩৪টি উন্নয়ন কর্মসূচি বাবদ বরাদ্দ রাখার কথা বলা হবে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে।
বাংলাদেশ সময়: ০১৩০ ঘণ্টা, জুন ০২,২০২৪
জিসিজি/এসএএইচ