ঢাকা: ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের নতুন নজির তৈরি হয়েছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে ঋণ বিতরণের চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে, যা অতীতে কখনো দেখা যায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ ও ডিসেম্বর শেষে ঋণ বিতরণের তথ্য পর্যালোচনা করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৪৩ হাজার ৬৩৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা। মার্চ মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা।
শেষের তিনি মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৮ হাজার ৬৬১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। একই সময়ে ঋণ বিতরণ বেড়েছে মাত্র ২৩ হাজার ১৬৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশে সর্বশেষ ঋণ স্থিতির (আউট স্ট্যান্ডিং) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। আর তিন মাস আগে ডিসেম্বর শেষে ঋণ স্থিতি ছিল ১৬ লাখ ১৭ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। শেষ তিন মাসে ১০০ টাকার বিপরীতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৬০ টাকা।
প্রভাব খাটিয়ে ঋণ নিয়ে আর ফেরত না দেওয়ার একটি অপসংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। আর ব্যাংকের টাকায় ভোগসর্বস্বতা বেড়েছে। এর ফলে বৈষম্য বেড়েছে। এটি ব্যাংক ঋণ ব্যবস্থাপনায় নতুন একটি মডেলের জন্ম দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, আগে এমন একটা ব্যবস্থা ছিল, ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যার রেকর্ড ভালো, ঋণ নিয়ে ফেরত দিয়েছে, সুনাম আছে—এমন ব্যবসায়ীকে ঋণ দিতে হবে। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ক্যারেক্টার, জামানত ইত্যাদি বিবেচনা করা হতো। এখন আর বিষয়টি সেরকম নেই। এখন ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনা ও প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি বিবেচনা করে ঋণ দেওয়া হয়। যে কারণে এ ঋণের অনেকাংশ ফেরত আসছে না।
এটা এখন একটি টেনডেন্সি (প্রবণতা) হয়ে গেছে। পুরাতন ঋণ ফেরত দেয় না; নতুন ঋণ ফেরত আসবে, ব্যাংকের তারল্য বাড়বে, সেটাও আর হচ্ছে না। এটা একটি মারাত্মক অবস্থা তৈরি হয়েছে, বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর।
তিনি আরও বলেন, এর ফলে একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। তারা এমন ধারণাই তৈরি করেছে ঋণ নিলে আর ফেরত দিতে হয় না। বিষয়টি এমন, ঋণ নিয়ে আমি ব্যবসা করব, মুনাফা করব কিন্তু ফেরত দিতে হবে না। এটা এখনকার মডেল। দেখবেন এ ধরনের ঋণের মাত্রাটাও বেড়ে গেছে। এটা নয়া ভোগসর্বস্ব ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে। আর একটি সমতাভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার বিপরীতে বৈষম্যপূর্ণ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। এটা আমাদের স্বাধীনতার মূল্যবোধেরও পরিপন্থি।
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। খেলাপি ঋণের মাত্রার ওপর নির্ভর করে শতভাগ, ৫০ শতাংশ, ২৫ শতাংশ পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে হয়, যা ব্যাংকের মুনাফা শেয়ার হোল্ডারদের মাঝে বিতরণ না করে সংরক্ষণ করা হয়। গ্রাহকের আমানতের রক্ষাকবজ হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয় এই প্রভিশন। প্রভিশনের অর্থ দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বিতরণ করা যায় না।
প্রভিশন সংরক্ষণ ঋণের লাগাম হিসেবে মনে করেন আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, প্রভিশন সংরক্ষণ এ জন্য জোরদার করা হয়েছে, যাতে খেলাপি হওয়ার পরও ঋণ বিতরণে টান পড়ে। কিন্তু তারপরও খেলাপি কমানো সম্ভব হয়নি। বরং প্রভিশন ঘাটতিও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। এর বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে এক লাখ ১১ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংকগুলো সংরক্ষণ করেছে ৬৪ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা। আর প্রভিশন ঘাটতি ২৬ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। ঋণ খেলাপির পাশাপাশি প্রভিশন ঘাটতির কবলে ব্যাংকিং খাত।
ব্যাংকগুলোর প্রদর্শিত খেলাপি ঋণের বাইরে আরও দেড়গুণ খেলাপি ঋণ রয়েছে, যা সম্প্রতি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণাতে উঠে আসে। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশে এখন মন্দ ঋণের পরিমাণ প্রায় পাঁচ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরাসরি খেলাপি ঋণ এক লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। এর বাইরে রাইটআপ, পুনঃতফসিলিসহ মন্দ ঋণের পরিমাণ দুই লাখ ৩২ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা। এছাড়া অর্থ ঋণ আদালতে ৭২ হাজার ৫৪৩টি মামলার বিপরীতে এক লাখ ৭৮ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা আটকে আছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৪১ ঘণ্টা, জুন ১৭, ২০২৪
জেডএ/এমজেএফ