সিরাজগঞ্জ: সিরাজগঞ্জবাসীর দুই যুগের (২৪ বছর) স্বপ্ন এবার পূরণ হতে চলেছে। বন্যা ও যমুনা ভাঙনে বিধ্বস্ত এ জেলা শহরটি শিল্পনগরে রূপান্তর হওয়ার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।
শত শত শিল্পকারখানা স্থাপনের মধ্য দিয়ে লাখো মানুষের কর্মসংস্থান, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার সব মিলিয়ে উন্নয়নের নতুন দিগন্ত সূচিত হবে যমুনাপাড়ের জেলায়।
২৪ বছরের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সিরাজগঞ্জ বিসিক শিল্পপার্ক নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। চলতি বছরই এটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন এবং উদ্যোক্তাদের মাঝে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হবে। ৮২৯টি প্লটে ৫৭০টি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যাবে।
উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার যমুনা নদী বিধৌত সিরাজগঞ্জ জেলা শিল্প-ব্যবসা ও বাণিজ্যের দিক দিয়ে অনেকটাই পিছিয়ে ছিল। ১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধনের পর ঢাকার সঙ্গে সিরাজগঞ্জসহ সমগ্র উত্তরাঞ্চলের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ চালু হয়। তখন থেকে নদীভাঙন কবলিত এ জেলার মানুষ উন্নয়নের নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচিত হওয়ার স্বপ্ন দেখছিল। তারই ধারাবাহিকতায় প্রায় এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে যমুনা নদীর পশ্চিম অববাহিকায় বিসিক শিল্পপার্ক নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই সময় বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপাড়ে বিসিক শিল্পপার্ক নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রকল্পের কাজ শুরুও হয়। নির্মাণ করা হয় বাউন্ডারি ওয়াল ও অফিস ঘর। কিন্তু ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় আসার পর আবার প্রকল্পটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপাড়ে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়নের ছাতিয়ানতলী ও পশ্চিম মোহনপুর এবং কালিয়া হরিপুর ইউনিয়নের বনবাড়িয়া, বেলুটিয়া ও মোড়গ্রাম মৌজার মোট ৪০০ একর জমির ওপর প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। ৭১৯ কোটি ২১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পটির কাজ এখন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সরকার পরিবর্তন, আমলাতান্ত্রিক নানা জটিলতাসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতায় ২৪ বছর লেগে যাচ্ছে স্বপ্নের এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে।
সিরাজগঞ্জ বিসিক শিল্পপার্ক প্রকল্প অফিস সূত্র জানায়, ২০১০ সালের ৩১ আগস্ট একনেক সভায় বিসিক শিল্পপার্ক প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদিত হয়। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নদী অনুশাসনসহ ১ম সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদন হয়। ২০১৫ সালে জমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়। এদিকে প্রকল্প এলাকা যমুনার অববাহিকায় হওয়ায় নদীর তীর রক্ষাবাঁধ নির্মাণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড ৩ ও ৪ নম্বর ক্রসবার নির্মাণ শেষ করার পর ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে মাটি ভরাটের অনুমতি পায়। কিন্তু প্রকল্পের ১ম সংশোধনের মেয়াদ ২০১৬ সালের জুনে শেষ হলে ওই বছরের নভেম্বরে একনেকে ২য় সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদিত হয়। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ওটিএম পদ্ধতিতে মাটি ভরাট ও ডাইক নির্মাণ কাজের দরপত্র আহ্বান করলেও যোগ্যতাসম্পন্ন ঠিকাদার পাওয়া যায় না। পরে মাটি ভরাটে ডিপিএম পদ্ধতিতে ঠিকাদার বাছাই শুরু হয়। ২০১৮ সালের মে মাসে ঠিকাদার নিয়োগের অনুমোদন পাওয়ার পর নভেম্বরে নৌবাহিনী নারায়ণগঞ্জের ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করা হয়।
এভাবে দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ২০১৮ সালে মাটি ভরাট শুরু হয়। ২০১৯ সালের ৩০ জুন প্রকল্পের ২য় সংশোধিত মেয়াদও শেষ হয়। অর্থ বরাদ্দ না থাকায় কাজের গতি আবারও মন্থর হয়ে যায়। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে ৩য় সংশোধিত প্রকল্প একনেকে অনুমোদিত হয়। সর্বশেষ ব্যয় বাড়ানো ছাড়াই ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের বর্ধিত মেয়াদ একনেকে অনুমোদন হয়।
প্রকল্প অফিস আরও জানায়, ৪০০ একর জমির ওপর স্থাপিত প্রকল্পের ২৭৫ একর জমিতে এ, বি ও এস (স্পেশাল) এ তিন ক্যাটাগরির ৮২৯টি প্লট প্রস্তুত করা হয়েছে। বাকি জমির মধ্যে ১০ একর জায়গাজুড়ে সবুজ বৃত্তসহ একটি হ্রদ থাকবে, যাতে শিল্পপার্কের সৌন্দর্য বাড়ে। নির্মাণ হয়েছে রাস্তাঘাট ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন অবকাঠামো। এছাড়া পার্ক এলাকায় পুলিশ ফাঁড়ি, প্রশাসনিক জোন, আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, আবাসিক কোয়ার্টার, রেস্টুরেন্ট ও মার্কেটের কাজ এগিয়ে চলছে। এ ক্যাটাগরির প্লট ২০ হাজার, বি ক্যাটাগারির প্লট ১০ হাজার ও এস ক্যাটাগরির প্লট ৬ থেকে ২৬ হাজার বর্গফুট আয়তনের। ডিপিপি অনুযায়ী প্রতি বর্গফুটের মূল্য ধরা হয়েছে ৭৬৮ টাকা।
বিসিক শিল্পপার্ক অফিস সূত্র আরও জানিয়েছে, ৮২৯টি প্লটে ছোট, বড় ও মাঝারি ৫৭০টি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যাবে। দেশীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সঙ্গে রপ্তানি ও আমদানিমুখী শিল্প প্লট অনুমোদনের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে।
সিরাজগঞ্জের বিসিক শিল্প পার্কের উপ-মহাব্যবস্থাপক ও প্রকল্প পরিচালক জাফর বায়েজিদ বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতুকে উত্তরাঞ্চলে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে একটি গুরত্বপূর্ণ ফ্যাক্ট হিসেবে বিবেচনা করে বিসিক শিল্পপার্ক নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে আমাদের লক্ষ্য পূরণের কাছাকাছি রয়েছি। প্রকল্পের সব কাজই প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। শিগগিরই প্লট বরাদ্দের দরপত্র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিল্পপার্কটি উদ্বোধন করবেন। প্রকল্পটি চালু হলে এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৩ ঘণ্টা, জুন ২৮, ২০২৪
এসআই