ঢাকা: মানুষের সৌন্দর্য সচেতনতা বাড়ার কারণে বাড়ছে প্রসাধনী সামগ্রীর ব্যবহার। ফলে ব্যাপকহারে বাড়ছে প্রসাধনী পণ্যের চাহিদা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে কিছু অসাধু চক্রের সমন্বয়ে নকল, ভেজাল, মানহীন কসমেটিকস পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। রাজধানী ঢাকার চকবাজার, মৌলভীবাজার, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মানিকগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে নকল কসমেটিকস তৈরির কারখানা। চরম গোপনীয়তার সঙ্গে এসব কারখানায় চলে নকল পণ্য উৎপাদনের মহোৎসব। এরপর তা ছড়িয়ে দেওয়া হয় ঢাকাসহ সারা দেশে।
পুরান ঢাকার চকবাজার, মৌলভীবাজারসহ বিভিন্ন মার্কেটে প্রকাশ্যেই বিক্রি হয় বিভিন্ন নামি-দামি ব্রান্ডের নকল প্রসাধনী। ভোক্তা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রায়ই এসব স্থানে অভিযান পরিচালনা করে জরিমানাও করা হয়। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভোক্তা অধিদপ্তরের সদ্য সাবেক ডিজি বলেন, বাংলাদেশে এমন কোনো কসমেটিকস পণ্য নেই যা নকল হয় না।
অপরদিকে বিদেশ থেকে চোরাই পথে দেশে বিপুল পরিমাণ মানহীন প্রসাধনী প্রবেশ করছে। অবৈধভাবে কিংবা লাগেজে যে পণ্যগুলো আসছে, সেগুলোর কোথাও আমদানিকারকের কোনো তথ্য থাকে না, থাকে না বিএসটিআই লোগো।
এছাড়া দেশি-বিদেশি বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের প্রসাধনীর পরিত্যক্ত কৌটাতে নকল প্রসাধনী ঢুকিয়েও বিক্রি করা হচ্ছে। আবার বিদেশ থেকে নকল মোড়ক এনেও তৈরি করা হচ্ছে কসমেটিকস পণ্য। দেশি-বিদেশি কসমেটিকসের কোনটি আসল আর কোনটি নকল, তা নিশ্চিত করা কঠিন।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী দেশের নকল কসমেটিকসের বিষয়ে বলেন, যে পণ্যগুলো কাস্টমসের মাধ্যমে দেশে আসে সেগুলো ছাড়া বিদেশ থেকে আসা বেশির ভাগ পণ্যই ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে হাটে-মাঠে-ঘাটে, বাস-ট্রেনে হকাররাও বিভিন্ন নকল পণ্য বিক্রি করে। ব্র্যান্ডের কোনো পণ্যের নামের বানান একটু এদিক-সেদিক করে হুবহু নকল করা হয়। ব্যবহার করার পর খালি কৌটা সংগ্রহ করে তাতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় ভেজাল পণ্য।
দেশে কী পরিমাণ কসমেটিকস পণ্য নকল ও ভেজাল হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেশে ব্যবহার করা কসমেটিকস পণ্যের আনুমানিক ৪০ শতাংশ নকল, মানহীন কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ থাকে। এসব পণ্য ব্যবহারের ফলে নানা ধরনের ত্বকের সমস্যায় পড়তে হয়।
প্রসাধনীর বাজার নিয়ে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, দেশে কসমেটিকস খাতের প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে।
প্রসাধনী আমদানিকারক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার প্রসাধনী আমদানি করে। এ হিসাব বিবেচনা করলে বৈধপথে আমদানি করা ও দেশীয় কিছু উৎপাদন ছাড়া প্রসাধনীর বাজার পুরোটাই কালোবাজারিদের দখলে।
অ্যাসোসিয়েশন অব স্কিন কেয়ার অ্যান্ড বিউটি প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা এবং ব্যবসায়ী এ বিষয়ে বলেন, বাংলাদেশে বিদেশ থেকে আসা বেশির ভাগ কসমেটিকস পণ্যই চোরাইপথে আসে এবং এগুলো নিম্নমানের। চোরাইপথে পণ্য আসার ফলে দেশীয় উৎপাদনকারীরা টিকতে পারছে না। আমদানিকারকরা আবার ডিকলারেন্স ভ্যালু কম দেখাচ্ছে। দেশে কসমেটিকস পণ্যের এত বড় বাজারে মাত্র পৌনে ৩০০ কোটি টাকার রাজস্ব আসে। অথচ এটা কয়েক হাজার কোটি টাকা হওয়া উচিত। এখানেই বড় একটা কারসাজি রয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের নজরদারি বাড়াতে হবে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কসমেটিকস পণ্যের মোড়কে আমদানিকারকের তথ্য, সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য, উপাদান, পরিমাণ, ব্যবহারবিধি, উৎপাদনের তারিখ ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ উল্লেখ থাকে না। প্রাইস গান মেশিনের সাহায্যে খুচরা বিক্রেতারা বিক্রয়মূল্য লিখে দেন। পণ্যের মোড়কে আমদানিকারকের লেখা মূল্য কেটে বেশি লিখে রাখা হয়। বিদেশি পণ্য নকল করে দেশেই তৈরি হয় বিদেশি ব্র্যান্ডের পণ্য। এসব পণ্যের ক্ষেত্রে কোনো মানদণ্ড বজায় রাখা হয় না। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) নিষিদ্ধ ও অনুমোদনহীন পণ্যও বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (বিএসটিআই) ২০১৮ সালের আইনে আছে, স্থানীয় ব্যবহার, রফতানি বা আমদানি, যাই হোক না কেন, পণ্যসামগ্রী, মালামাল, উৎপাদিত পণ্য এবং খাদ্যসামগ্রীসহ অন্যান্য দ্রব্যের গুণগতমান প্রত্যয়ন করা বিএসটিআইয়ের অন্যতম কাজ।
অতি সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) উপ-পরিচালক মোরশেদা বেগম বলেন, আমরা চেষ্টা করছি পণ্যের মান নিশ্চিতের পর যেন বাজারজাত হয়। নতুন পণ্যের বাজারজাতকরণের আগে পণ্য, মোড়কসহ সব বিষয়ের মান নিয়ে কাজ করছি। আমরা রপ্তানিযোগ্য পণ্যের মান নিশ্চিতকরণে জোর দিচ্ছি। সামগ্রিক উৎপাদনের ৩০ শতাংশ পণ্য বিএসটিআই মান সনদের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। তার বক্তব্য অনুযায়ী এখনও দেশের ৭০ শতাংশ পণ্য মান নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের সার্টিফিকেশন মার্কস (সিএম) উইংয়ের পরিচালক বাংলানিউজকে বলেন, যে কসমেটিকস পণ্যগুলো বৈধ্যপথে বিদেশ থেকে দেশে আসে, সেগুলো বিএসটিআইয়ের পরীক্ষা ছাড়া দেশে ঢোকার সুযোগ নেই। তবে যেগুলো লাগেজে, অবৈধ ও চোরাই পথে আসে সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।
তিনি আরও বলেন, নকলের বিরুদ্ধে আমরা অভিযান পরিচালনা করছি, যারা ভেজাল বা নকল পণ্য তৈরি করে তাদের ধরছি। বিভিন্ন নামি-দামি কোম্পানির পণ্য বেশি নকল হয়। প্যাকেট বা লেভেল নকল করে সেগুলোও আমরা ধরছি। যখনি আমরা কোনো তথ্য পাই, অ্যাকশানে যাই।
নকল পণ্য ব্যবহারের ফলে ভোক্তাদের ত্বকের ক্ষতি প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য এবং চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ শিকদার বলেন, আমাদের কাছে মুখের ত্বকে দাগ পড়া, কিংবা কালো হয়ে যাওয়া যে রোগী আসে হরমোনাল সমস্যা ছাড়া, তার ৬০ শতাংশের বেশিই বিভিন্ন রকম প্রসাধনী, আর্টিফিশিয়াল উপাদান ব্যবহারের কারণে হয়। এছাড়া খাওয়া-দাওয়া এবং রোদে যাবার কারণেও মুখে দাগ পড়তে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নকল ও মানহীন পণ্য ব্যবহার করে একদিকে ভোক্তারা যেমন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছেন তেমনি ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অন্যদিকে অবৈধ পথে কসমেটিকস পণ্য দেশে আসার কারণে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই দেশের নকল পণ্য এবং বিদেশ থেকে চোরাই পথে আসা পণ্যের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এতে ভোক্তা, বৈধ পণ্য উৎপাদনকারী ও দেশের জন্যও মঙ্গল হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫১ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৮, ২০২৪
আরকেআর/আরবি