কুড়িগ্রাম: গত বছর ভালো দাম পাওয়ায় এবার আলু চাষের দিকে ঝুঁকেছিলেন কুড়িগ্রামের চাষিরা। আর বাড়তি চাহিদা তৈরি হওয়ায় সিন্ডিকেটের দখলে ছিল আলু বীজের বাজার।
কুড়িগ্রাম জেলার ৯ উপজেলার প্রায় সব উপজেলায় হচ্ছে আলুর চাষ। সমতল ভূমিতে যেমন চাষ হচ্ছে, তেমনি চাষ হচ্ছে ধরলা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমার, ফুলকুমারসহ প্রায় সবগুলো নদ-নদীর অববাহিকায়। জেলার আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ৭ হাজার হেক্টর হলেও চাষ হয়েছে ৮ হাজার হেক্টর জমিতে। তবে সার ও কীটনাশকের সঙ্গে বীজ আলুর বাড়তি দামে আলু চাষিরা বিপাকে পড়েছেন। সরকার নির্ধারিত ৬০ টাকার বীজ আলু কৃষকদের কিনতে হয়েছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়।
বর্তমানে কুড়িগ্রামে কিছু কিছু আগাম আলু উত্তোলন হলেও এখনও অধিকাংশ জমিতে আলু উত্তোলন বাকি রয়েছে। ভোক্তা পর্যায়ে আলুর দাম ২০/২৫ টাকা হলেও পাইকারি বাজারে ১৩ থেকে ১৬ টাকা কেজি। কৃষকরা বিক্রি করছেন ১০ থেকে ১২ টাকায়। অথচ এবার সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ পড়েছে ২৫ থেকে ২৭ টাকা। মাঠ পর্যায়ে সব আলু উত্তোলন হলে দাম আরও কমার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই পর্যাপ্ত দাম না পেয়ে লোকসানের আশঙ্কায় রয়েছেন হাজারো কৃষক।
কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার তিস্তার চরে আরিফ হোসেন দুই একর জমিতে আলু চাষ করেছেন। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘আমি এখন আলু বিক্রি করছি ৮ টাকা কেজি দরে। অথচ আমার আলুতে খরচ হয়েছে কেজি প্রতি ২৫ টাকার মতো। সব মিলিয়ে দুই একরে আমার লোকসান হবে দুই লাখ টাকা। ’
আলু চাষি আরিফ আরও বলেন, ‘শুধু আমিই না, আমাদের এলাকার অনেক কৃষক এবার আলু চাষ করে পথে বসে যাবে!’
সদর উপজেলার কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নের কৃষক রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আমরা পথে বসে যাব এবার। বীজ কিনছি ১১০ টাকা কেজি। বিএডিসিতে (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন) দালালে ভরা। কৃষকের কোনো উপকার করে না এই বিএডিসি। বিএডিসিতে তিন দিন গেছি। তারা পাত্তা দেয় না। তারা বলে, বীজ আসে নাই, পাওয়া যায় না। কয়েকদিন পরে বলে, বীজ আর নাই, শেষ! পরে দালালের কাছ থেকে বীজ কিনলাম। তারা ৬০ টাকার আলু নিল ১১০ টাকা। আলুর ন্যায্য দাম না পেলে মাঠে মরা যাব! এর আগে কয়েকবার স্টোরেজেই আলুর বস্তা ছেড়ে দিয়ে আসছি। ‘
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এলাকার কৃষক সুমন ৩০ একর, নুরনবী ৬০ একর ও মাহাবুব ৪০ একর জমিতে চাষ করেছে। তারা সবাই লোকসানের ঝুঁকিতে আছে। ’
বেলগাছা ইউনিয়নের কৃষক আনোয়ার হোসেন ১০ একর জমিতে আলু চাষ করেছেন। আলুর বীজের দামের কারণে এবার উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে বলে জানান তিনি। উৎপাদন খরচের সাথে সঙ্গতি রেখে দাম না পেলে লোকসানের কূল কিনারা থাকবে না উল্লেখ করে আনোয়ার বলেন, ‘এবার এক একর জমির বীজ কিনতে হয়েছে ৯০ হাজার টাকায়। পটাশ, ডিএপি, এমওপি, টিএসপি, ইউরিয়া সার মিলিয়ে ২৫ হাজার টাকা খরচ পড়েছে। জৈব সার ৪ হাজার টাকা, জমি চাষ বাবদ খরচ ৩ হাজার টাকা। সেচ দিতে খরচ হবে ৫ হাজার টাকা, কীটনাশকে খরচ হবে ১০ হাজার টাকা, শ্রমিকের মজুরিতে খরচ হবে ১৫ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে একরে মোট খরচের পরিমাণ দাঁড়াবে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। ’
নাম না প্রকাশ করার শর্তে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) কুড়িগ্রাম বীজ বিপণন কার্যালয়ে কর্মরত এক কুলি বলেন, ‘বিএডিসির বীজ হিমাগারে চলছে সিন্ডিকেট। ঠিকাদার, বিপণন কেন্দ্রের কর্মকর্তা ও কুলির সর্দার মিলে একটা সিন্ডিকেট করে বাড়তি দামে আলুর বীজ বিক্রি করতো। ’
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) কৃষিবিদ মো. আসাদুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, এবার আলুতে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির মূল কারণ হচ্ছে বীজ আলুর দাম বেশি। এ ছাড়াও এবার কৃষকরা বেশি বেশি আলুর উৎপাদনের দিকে ঝুঁকেছিল, শ্রমব্যয় বেশি ছিল। সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচটা একটু বেশি হয়েছে। তবে আমরা যদি কৃষকদের গুদামজাতের নিশ্চয়তা দিতে পারি, কৃষকরা যদি ভালোমতো গুদামজাত করতে পারে তবে দাম যখন বেশি হবে তখন বিক্রি করলে কৃষকদের লাভবান হবার সম্ভাবনা আছে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৫
এমজেএফ