ঢাকা, শনিবার, ৯ ফাল্গুন ১৪৩১, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২২ শাবান ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

পরোক্ষ করে চাপে নিম্ন আয়ের মানুষ

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট   | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৫
পরোক্ষ করে চাপে নিম্ন আয়ের মানুষ

ঢাকা: দেশের কর ব্যবস্থার মাত্র দুই-তৃতীয়াংশ আসে প্রত্যক্ষ কর থেকে। যা সর্বনিম্ন আয়ের বস্তির মানুষ নির্বিশেষে জীবনযাপনের ব্যয় এবং সব ধরনের কেনা-কাটার মধ্য দিয়ে শোধ করতে হয়।

এসব মূল্য সংযোজন কর  আমদানি শুল্ক, স্থানীয় পর্যায়ে শুল্ক ও রপ্তানি শুল্কের মাধ্যমে নেওয়া হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর ছয় মাসে মোট রাজস্বের ৬৬ শতাংশ বা  এক লাখ  চার হাজার ২৬১ কোটি টাকা।

অন্যদিকে মানুষের আয়ের নির্দিষ্ট অংশ সরাসরি নেওয়ার পাশাপাশি ভ্রমণ কর মোট রাজস্বের এক তৃতীয়াংশ।  জুলাই-ডিসেম্বর এ ছয় মাসে প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ ৫২ হাজার ১৮৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা। কম বেশি একই ধারায় বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ কর।

সরকারের ব্যয় নির্বাহে রাজস্ব আদায় করতে হয়। পরোক্ষ কর আদায় তুলনামূলক সহজ হওয়ার কারণে সরকারকে সে পথেই রাজস্ব আদায়ে যেতে হয়। বাংলাদেশের ৫৩ বছরে ধরেই সে পথে রয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

দেশের রাজস্ব কাঠামোর পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে কর কাঠামা একই রয়েছে। সামান্য কিছু পরিবর্তন হলেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয় না। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে আহরণ  করা মোট রাজস্বের ৩৪ শতাংশ প্রত্যক্ষ কর, আর পরোক্ষ কর ছিল ৬৬ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ কর ছিল ৩১ দশমিক ৩৫ শতাংশ, পরোক্ষ কর ছিল ৬৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ কর ৩০ দশমিক ৮১ শতাংশ, আর পরোক্ষ কর ৬৯ দশমিক ১৯ শতাংশ।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে আহরণ করা মোট রাজস্বের প্রত্যক্ষ কর ৩২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, পরোক্ষ কর ৬৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ কর ৩৩ শতাংশ, পরোক্ষ কর ৬৭ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ কর ৩২ দশমিক ৭৯ শতাংশ, পরোক্ষ কর ৬৭ দশমিক ২১ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ কর ৩৪ দশমিক ১০ শতাংশ, পরোক্ষ কর ৬৫ দশমিক  ৯০ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ কর ৩৪ দশমিক ৭১ শতাংশ, পরোক্ষ কর ৬৫ দশমিক ২৯ শতাংশ।

রাজস্ব বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কর নেট বৃদ্ধি, বর্তমান ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টিআইএন) নম্বরধারীদের আয়কর রিটার্ন নিশ্চিত করা, সম্পদ কর আদায়সহ নতুন নতুন উৎসের খোঁজের পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, পরোক্ষ করে সাধারণ মানুষের ওপরই বেশি চাপ পড়ে। দেশে বৈষম্য কমাতে পরোক্ষ করের পরিমাণ কমানো ও প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।

তিনি বলেন, অনেক আগে থেকেই প্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধিতে মতামত দেওয়া হচ্ছে। উদ্যোগের কথাও শোনা যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে তা কাজে আসছে না। আগের জায়গাতেই রয়ে গেছে। পরোক্ষ কর কমানোর জন্য এখন আমাদের সামনে যে পথটি তা হলো, আগে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে হবে।

ব্যবসায়ীসহ বিত্তবানদের আরও বেশি করের আওতায় আনার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, দেশে এমন অনেক ব্যবসায়ী আছেন, যারা আমাদের মতো চাকরিজীবীর চেয়ে কম কর দেন; অনেকে দেনই না। তাদের সঠিকভাবে করের আওতায় আনতে হবে। এভাবে আমাদের প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে হবে। আর আস্তে আস্তে পরোক্ষ কর কমাতে হবে।

কর বৃদ্ধিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দুটি বড় ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। টিআইন বৃদ্ধি, সব টিআইএনধারীদের আয়কর রিটার্নে বাধ্য করা ও কর প্রদানে সহজিকরণের অংশ হিসেবে প্রযুক্তির ব্যবহারের মতো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

দেশের টিআইএন সংখ্যা প্রায় এক কোটি ২০ লাখ। এর মধ্যে আয়কর রিটার্ন দেয় মাত্র ৪০ লাখ। বাকি ৮০ লাখ টিআইএনধারী আয়কর রিটার্ন দেন না। এসব টিআইএন ধারী রিটার্নের আওতায় আনা গেলে কমপক্ষে ২০ শতাংশ প্রত্যক্ষ কর বাড়বে। সব টিআইএনধারীকে আয়কর রিটার্নে বাধ্য করতে উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর।  

এনবিআরের আয়কর বিভাগ সূত্র জানা গেছে, যেসব টিআইএনধারী রিটার্ন জমা দেয় না তাদের নোটিশ পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যারা আয়কর যোগ্য তারা করসহ আয়কর দেবে, যারা কর যোগ্য না তারা কর ছাড়া আয়কর রিটার্ন দেবে। এর ফলে রাজস্ব বাড়বে।

আয়কর বৃদ্ধিতে সহজিকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অনলাইনের রিটার্ন দাখিল বাড়লে আয়কর বৃদ্ধি পাবে বলেও মনে করছে এনবিআর।

এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক একজন চেয়ারম্যান বাংলানিউজকে বলেন, অনেক দিন ধরে আমরা বলে আসছি টিআইএনধারীর সংখ্যা বাড়াবো, কেন টিআইএনধারীরা ট্যাক্স দেয় না, তাদের করের আওতায় আনা হবে; এমন কথা বলা হলেও আসলে কাজের কাজ হয় না। মুখে বলা কথা আর বাস্তবতা এক নয়।

তিনি বলেন, যে সব কারণে কর বৃদ্ধি পায় না সেগুলো কার্যত সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগে শৈথিল্য বা পক্ষপাত করা করা;  বিদেশে টাকা পাচার হওয়া ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া; রাজস্ব বিভাগে লোকজনের দক্ষতা ও সক্ষমতার অভাব এবং জনগণের কাজে বিশ্বাসযোগ্য ব্যবহার করতে পারা। এ  কারণে মানুষ কর দিতে উৎসাহ বোধ করে না। প্রত্যক্ষ কর দেওয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও প্রকট।

রাজস্ব আদায়ে কারো ওপর আইনের কঠোর প্রয়োগ করা হয়, কাউকে ছাড় দেওয়া হয়-গত সরকারের সময়ে প্রায় দুই যুগ ধরে এ ব্যবস্থা  আরও প্রকট ছিল উল্লেখ করেন এ শীর্ষ কর্মকর্তা। বলেন, কর না দেওয়ার ক্ষেত্রে মানুষ যদি মনে করে কর দিলে দেশের কোনো কাজে আসছে না। বা মানুষ যদি মনে করে, পাচার করে কেউ কেউ বিদেশের গিয়ে গাড়ি-বাড়ি, সম্পদ জমা করছে; স্বাচ্ছন্দের জীবনযাপন করছে; পাচারকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এমন ব্যবস্থা থাকলে মানুষ কর দিতে চাইবে না।

তিনি বলেন, রাজস্ব আদায়ে এনবিআর এখন যে সব উদ্যোগের কথা বলছে এটা বাস্তবতা বর্জিত, কথার কথা। প্রত্যক্ষ কর বৃদ্ধিতে বাস্তব ভিত্তিক, বিশ্বাসযোগ্য এবং এক্ষেত্রে আইনের সঠিক প্রয়োগে জোর দিতে হবে। রাজস্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে মানুষকে আস্থায় আনতে হবে ।

বাংলাদেশের পরোক্ষ করাঘাত নজিরবিহীন। বাংলাদেশেই শুধু পরোক্ষ কর বেশি; পৃথিবীর সব দেশে প্রত্যক্ষ কর বেশি। প্রত্যক্ষ কর বাড়তে থাকা মানে হলো, যার যেমন আয় বা সম্পদ বেশি সে তত বেশি কর দেয়। যার কম আয় সে কম কর দিয়ে থাকে।  

অর্থনীতিবিদদের বলছেন, সব দেশেই প্রত্যক্ষ কর বাড়ে ‘ইক্যুইটি প্রিন্সিপাল‘ হিসেবে। যার দশ লাখ টাকা আয় সে যদি ১০ শতাংশ হারে কর দেয়, যার ৫০ কোটি টাকা আয় স্ল্যাব অনুযায়ী তার ট্যাক্স উঠবে ৫০ শতাংশে। বাংলাদেশ একটি অদ্ভুত দেশ। বড়লোকের সুবিধা করে দেওয়ার জন্য কর কাঠামোতে পরোক্ষ করই দুই-তৃতীয়াংশ, যা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আদায় করা হয়।

রুটির ওপরে ভ্যাট; বড়লোক যে দামে রুটি কেনে, গরিব মানুষও সেই দামে রুটি কেনে। এটা সমতা বিবেচনায় সঠিক নয়। সাধারণ মানুষের ব্যবহার্য পণ্য ও সেবায় ট্যাক্স কম থাকবে। বাংলাদেশে এমন কোনো পণ্য নেই যেখানে ট্যাক্স নেই। এ ধরনের ট্যাক্স আদায় এনবিআরের কাছে খুব সহজ হয়। পরোক্ষ কর আদায়ে কষ্ট করতে হয় না। আর প্রত্যক্ষ কর আদায় করতে এনবিআরকে কষ্ট করতে হয়, সিস্টেম ডেভেলপ করতে হয়। বরং নেগোশিয়েন করে আরও কম কর দেয় ধনীরা। আবার এ ট্যাক্স পুরোপুরি সরকারের কাছে যায় না। অথচ পরোক্ষ কর, যা গরিব মানুষ দেয়-সেই কর কমানোর সুযোগ নেই। আর এ কারণে বৈষম্য প্রকট হচ্ছে।

ফিনল্যান্ড, ডেনমার্কের মতো উন্নত দেশে প্রত্যক্ষ কর ৬০ শতাংশ। সেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য সব কিছু সরকার ব্যবস্থা করে থাকে। আর আমাদের এখানে এসবের কিছুই করবে না। চিকিৎসা নিতে হলে বেসরকারি খাতে টাকা খরচ করতে হবে। শিক্ষা নেবেন, বেসরকারি খাতে বেশি টাকা খরচ করে নিতে হবে। পাবলিক সার্ভিস ভালো না, প্রাইভেট সার্ভিস নিতে হবে। এটা কোনো ভালো নীতি নয়। এটা আর্থসামাজিক উন্নয়নেরও সম্পূর্ণ পরিপন্থি।  

বাংলাদেশ সময়: ১৪২১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৫
জেডএ/জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।