ঢাকা, রবিবার, ৩০ চৈত্র ১৪৩১, ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্তে কী প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে

গৌতম ঘোষ ও জাফর আহমদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৪৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০২৫
ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্তে কী প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে

ঢাকা: বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে ভারত। এ ধরনের সিদ্ধান্ত দুই দেশের সম্মিলিত উন্নতি, প্রবৃদ্ধি ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে বাধা সৃষ্টি করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, সরকারের উচিত দ্রুত এ ধরনের ট্রেড ব্যারিয়ার নিয়ে কথা বলে সমস্যার সমাধান করা।

২০২০ সালে এই ট্রান্সশিপমেন্টের সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। তখন বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য রপ্তানিতে ভারতের কলকাতা বন্দর, নবসেবা বন্দর ও কলকাতা বিমান কার্গো কমপ্লেক্স ব্যবহার করার সুযোগ দিয়েছিল ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস (সিবিআইসি)।

বুধবার ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে সিবিআইসি এক আদেশ জারি করে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারতের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য অপ্রত্যাশিত। নতুন এই সিদ্ধান্ত রপ্তানি প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করবে। এর ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানে ঝুঁকি তৈরি হবে।  

তারা বলছেন, ভারতের স্থলপথ ব্যবহার ছাড়া ভুটান, নেপাল ও মিয়ানমারের মতো দেশে পণ্য পৌঁছানো কঠিন। এতদিন ট্রান্সশিপমেন্টের আওতায় ভারতের ভূমি ও অবকাঠামো ব্যবহার করে কম খরচে ও কম সময়ে এসব দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করার সুবিধা পেয়ে আসছিল বাংলাদেশ।  

বিশেষত, বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের সিদ্ধান্তের প্রভাব পড়বে। তৈরি পোশাক সাধারণত বড় আকারে সমুদ্রপথে রপ্তানি করা হয়, কিন্তু জরুরি শিপমেন্টে আকাশপথ ব্যবহার করা হয়।

বর্তমানে ভারতের বিমানবন্দর ব্যবহার করে রপ্তানি সুবিধা পাওয়া যায়, যা খরচ কমায় এবং সময় বাঁচায়। কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যও ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য এবং সড়কপথ ব্যবহার করে ভুটান ও নেপালে রপ্তানি হয়। এর সঙ্গে কিছু প্লাস্টিক পণ্য ও ইলেকট্রিক পণ্য রপ্তানি হয়।

বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহারের কথা উল্লেখ করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, একটি বড় সময় ধরে বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার কারণে ভারতের বিমানবন্দর ও বন্দরগুলোতে উল্লেখযোগ্য জট দেখা দিয়েছে।  

পরিবহন সরঞ্জাম ও অন্যান্য সেবা (লজিস্টিক্যাল) সুবিধায় বিলম্ব এবং উচ্চ ব্যয়ের কারণে ভারতের নিজেদের রপ্তানি বিঘ্নিত হচ্ছে এবং পণ্যের জট (ব্যাকলগ) তৈরি করছে। সে কারণে এ সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়েছে, যা ৮ এপ্রিল ২০২৫ থেকে কার্যকর থাকছে।

বিবৃতিতে ভারত দাবি করেছে, এসব পদক্ষেপে ভারতের সীমান্ত দিয়ে পরিবহন করে নেপাল ও ভুটানে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির ওপর প্রভাব পড়বে না। পরে এক ব্রিফিংয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়ালও একই কথা বলেন।

তবে ভারতের এই উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি কিছুটা ব্যাহত হবে বলে মনে করছেন তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক মহিউদিন রুবেল।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধে যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা কিছুটা হলেও আমাদের ক্ষতি করবে। পাশাপাশি আরও একটি ক্ষতি হবে, তা হলো মনস্তাত্ত্বিক বাধা তৈরি হবে। নিশ্চয়ই আমাদের সরকার কূটনৈতিক পথে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করবে।

এ বিষয়ে দেশের প্রধান কৃষিজাত পণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএলের পরিচালক (মার্কেটিং) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ভারতের সড়ক ব্যবহার করে এখন যেসব পণ্য রপ্তানিতে সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে, ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধ হলে তা আর থাকবে না।  

তিনি বলেন, যেসব পণ্য রপ্তানি করি, পরিমাণে বেশি, সেসব পণ্য আকাশপথে রপ্তানি করলে অনেক খরচ পড়বে। ফলে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধ হলে রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে। বন্ধ হবে ১০ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি। সেজন্য আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান জরুরি।

ল্যান্ডলকড কান্ট্রি হিসেবে নেপাল ও ভুটানের ক্ষতি হবে। নিশ্চয়ই বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটান ক্ষতি করতে চাইবে না। সেজন্য ভারতসহ অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান প্রয়োজন, বলেন প্রাণ গ্রুপের এই কর্মকর্তা।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বাংলানিউজকে বলেন, ভারত কেন ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে, তা আগে জানতে হবে। এই সিদ্ধান্ত আমাদের আমদানি-রপ্তানি বা বাণিজ্যে বাধা সৃষ্টি করবে। একইসঙ্গে ট্রেড কস্ট বা পণ্য পরিবহন খরচ বেড়ে যাবে। এটি আমাদের জন্য মোটেও সুখকর নয়। ভারতের এ ধরনের আচরণ আমাদের মোটেও কাম্য নয়।

তিনি বলেন, সরকারের উচিত এই ট্রেড ব্যারিয়ার নিয়ে দ্রুত আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করা। এতেও যদি সমস্যা সমাধান না হয়, তাহলে আমরা তো বসে থাকব না। আমাদের বিকল্প বাজার বা পথ খুঁজতে হবে।  

তিনি আরও বলেন, আমরা এখন নেপাল বা ভুটানের সঙ্গে যে পণ্যগুলো নিয়ে বাণিজ্য করছি, সেগুলোতে খরচ বেড়ে যাবে। তাই সরকারের উচিত দ্রুত এসব ট্রেড ব্যারিয়ার নিয়ে কথা বলে সমস্যার সমাধান করা। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, যেহেতু ভারত নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, আমাদের প্রথমে এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে। সরকারি পর্যায়ে আলোচনা করে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। যদি সমাধান না হয়, তাহলে বিকল্প পথ দেখতে হবে। এর জন্য তো আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে থাকবে না।

অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ভারত বাংলাদেশের শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদারগুলোর মধ্যে একটি। ভারতের এই নীতিগত সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য অপ্রত্যাশিত। আমি জানি না ভারত এ বিষয়ে বাংলাদেশকে আগে সতর্ক করেছে কি না।  
 
তিনি বলেন, ভারতের বিমানবন্দরের সুবিধাটা আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পের ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করেন। তবে, এই নিষেধাজ্ঞায় আমার মনে হয় না বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের তেমন কোনো সমস্যা হবে। কারণ আমাদের থার্ড টার্মিনাল চালু হলে ভারতের বিমানবন্দর ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে।

সিপিডির এই ফেলো বলেন, আমরা আন্তরিকভাবে আশা করি, ভারত নিজের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করবে এবং উভয় দেশের জন্য উপকার হয়, এমন একটি সমাধান বের করতে আলোচনায় বসবে। বিশ্ববাজারের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা শুরু করাটা ভালো হবে। তাদের কনসার্নটা আগে জানতে হবে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়ম অনুযায়ী, সদস্য দেশগুলোকে ভূমিবেষ্টিত দেশগুলোর জন্য অবাধ ট্রানজিট সুবিধা নিশ্চিত করতে হয়। ১৯৯৪ সালে সংস্থাটির জারি করা জেনারেল অ্যাগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফস অ্যান্ড ট্রেডের (জিএটিটি) পঞ্চম অনুচ্ছেদ অনুসারে, সব সদস্যকে স্থলবেষ্টিত দেশগুলোতে পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রানজিট দিতে হবে এবং এক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট সীমা দেওয়া যাবে না। তা ছাড়া এই পণ্য পরিবহনকে শুল্কের আওতায় ফেলা যাবে না।

ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের ঘোষণা নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বৈঠক শেষে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন সাংবাদিকদের বলেন, নেপাল ও ভুটানে রপ্তানির যে প্রক্রিয়া তাতে এ সিদ্ধান্তে কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে সরকার তৈরি পোশাক রপ্তানিসহ সার্বিক বাণিজ্য স্বাভাবিক রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। ঢাকা ও সিলেট বিমানবন্দরের নিজস্ব সক্ষমতা ব্যবহার করে এ প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখা হবে। অন্যান্য ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে।  

বাংলাদেশ সময়: ০০৪২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০২৫

জিসিজি/জেডএ/আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।