ঢাকা, মঙ্গলবার, ২২ বৈশাখ ১৪৩২, ০৬ মে ২০২৫, ০৮ জিলকদ ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

শিল্প ব্যবসাকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে রাখা উচিত

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:৪৯, মে ৫, ২০২৫
শিল্প ব্যবসাকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে রাখা উচিত বন্দরের পুরোনো ছবি

রাজনীতিতে আশা-নিরাশার দোলাচল। এক পক্ষ নির্বাচনের জন্য মরিয়া, আরেক পক্ষ রয়েসয়ে সংস্কার শেষ করে তবেই নির্বাচনের ব্যাপারে একাট্টা।

পাল্টাপাল্টি এই অবস্থানের মধ্যেই কিছুটা মনোযোগ হারিয়ে দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য একটি ক্রান্তিকাল পার করছে। বিশেষ করে অর্থনীতির মূল সূচকগুলোর বেশির ভাগই গতিহীন।

বলতে গেলে সংকটময় পরিস্থিতির মুখে। আমদানি, ব্যবসা ও বিনিয়োগে মন্দার ফলে রাজস্ব আয়ে বড় ঘাটতি। মূল্যস্ফীতি থামাতে নেওয়া উচ্চ সুদের হারের খড়্গ ভোগাচ্ছে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহে। ডলারের উচ্চ দরের প্রভাবে টাকার অবমূল্যায়ন আর গ্যাস, বিদ্যুৎ-জ্বালানির লাগামহীন দামে বেড়েছে ব্যবসার খরচ।

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সন্তোষজনক উন্নতি না হওয়া আর আস্থাহীনতায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় তলানিতে। পুঁজিবাজারে সাধারণ বিনিয়াগকারীদের হাহাকার। চোখের সামনে প্রতিদিন নিজেদের শেষ পুঁজি খোয়াতে দেখে দেখে প্রায় বিপর্যস্ত তাঁরা। ভঙ্গুর ও সিন্ডিকেটের কবজায় থাকা নিত্যপণ্যের বাজারেও উত্তাপ।

স্বল্প আয়ের মানুষ রীতিমতো জীবনসংগ্রামে লিপ্ত। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার নজরদারিতে পড়ে বড় বড় শিল্প গ্রুপও রয়েছে বেকায়দায়। বিনিয়োগ-কর্মসংস্থানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া এসব গ্রুপের ব্যাবসায়িক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতার কারণেও প্রভাব পড়ছে বিভিন্ন খাতে। সব মিলিয়ে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা এখন রীতিমতো দিশাহারা অবস্থায়।
দেশের শীর্ষ অনেক ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তার সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে এ নিয়ে কথা হয়।

তাঁদের মধ্যে আশার চেয়ে এখন হতাশার কথাই বেশি শোনা যায়। তাঁরা আশা করেছিলেন, ক্ষমতার পালাবদলের মধ্য দিয়ে দায়িত্ব নেওয়া জন-আকাঙ্ক্ষার অন্তর্বর্তী সরকার দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে স্থিতিশীলতা দেওয়ার পাশাপাশি সব বাধা পেরিয়ে একে উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারায় নিয়ে যাবে। গত প্রায় ৯ মাসে সরকারের মধ্যে এ বিষয়ে বেশ প্রচেষ্টা দেখা গেছে এবং ওই প্রচেষ্টা এখনো অব্যাহত রেখেছে বলেই মনে হয়। রিজার্ভ স্থিতিশীল করা, রেমিট্যান্সে উচ্চ প্রবাহ বজায় রাখাসহ কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রবণতা তৈরি হয়েছে। তবে সার্বিক অর্থনীতি এখনো পুরো মাত্রায় ট্র্যাকে ফিরতে পারেনি। বরং বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সত্যিকার অর্থে একটি ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হয়নি এখনো। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক অবস্থায় ফেরেনি। এখনো কারখানাগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ। কথায় কথায় জ্বালাও-পোড়াও, বিক্ষোভ-ভাঙচুর। যখন-তখন মব সন্ত্রাসে আক্রান্ত হচ্ছে শিল্প-কারখানা, ব্যবসা ও উদ্যোগ। সম্প্রতি বিনিয়োগ সম্মেলনের সময়ও মব সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে বেশ কিছু বিদেশি ব্র্যান্ডের আউটলেট। অনেক দিন ধরেই বিনিয়োগে মন্দা চলছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ই ডলারের উচ্চ দরের কারণে আমদানিতে লাগাম টানা হয়। বলতে গেলে ডলার বাঁচাতে আমদানিকে নিরুৎসাহই করা হয়। এর সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ তৈরি হলে মুদ্রাপ্রবাহ কমাতে সুদের হার ক্রমাগত বাড়িয়ে দেওয়া হয়। অর্থনৈতিক অস্থিরতা আগের সরকারের সময়কাল থেকে শুরু হলেও তা অন্তর্বর্তী সরকার এসেও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। বরং বর্তমান গভর্নরও মুদ্রানীতি আরো কঠোর করে সুদের হার কয়েক দফা বাড়িয়েছেন। এতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহে বড় ধাক্কা লেগেছে। আর ১০টি দুর্বল ব্যাংকের বিরুদ্ধে প্রচারেও ভুল বার্তা যায় সর্বত্র। বিভিন্ন কারণে বড় কয়েকটি শিল্প গ্রুপের বিরুদ্ধে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার আইনি পদক্ষেপেরও কিছু প্রভাব পড়ে। এর সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কাঙ্ক্ষিত উন্নতি না হওয়া আর ব্যবসায় খরচ বেড়ে যাওয়াই বড় কারণ। গ্যাসের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ নতুন বিনিয়োগে গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বাড়ানো হয়। এমনিতেই উদ্যোক্তারা আস্থাহীনতায়, তার মধ্যে গ্যাসের দাম লাগামহীন বাড়ানোর ফলে উদ্যোক্তারা রীতিমতো হাত গুটিয়ে বসে থাকেন। দেশের উদ্যোক্তারা যখন বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না, তখন বিদেশি বিনিয়োগ আসাও কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে দেশে এখন বিনিয়োগ পরিস্থিতি মন্দাই বলা যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানি পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলেও বিনিয়োগে মন্দার নেপথ্যের দিকটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তথ্য বলছে, গত জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানিও কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। এর অর্থ হলো, দেশে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। সাদা চোখে আমদানি না হওয়ায় ডলারের সাশ্রয় আর রিজার্ভের উন্নতি মনে হলেও অর্থনীতি ও ব্যবসায় এর নেতিবাচক প্রভাবও কম নয়। মূলধনী যন্ত্রপাতি না আসা মানে মানুষের কাজের সুযোগ কমে যাওয়া। বেকারত্ব বেড়ে যাওয়া। এমনিতেই দেশে বেকারত্ব বাড়ছে। আর সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকও বলেছে, সামনে নতুন করে আরো ৩০ লাখ মানুষ দরিদ্র হবে।

অর্থনীতির হিসাব বলছে, একটি উদীয়মান অর্থনীতিতে কাঙ্ক্ষিত আমদানি না হলে, বিনিয়োগ না হলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সর্বত্র। কর্মসংস্থান হয় না। মানুষের কাজের সুযোগ বাড়ে না। আয় হয় না। আয় না হলে ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। এতে অর্থনীতিতে হয়তো মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা কমিয়ে রাখা যায়, কিন্তু টাকার প্রবাহ না থাকলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমার পাশাপাশি সরকারেরও রাজস্ব আয় হয় না। যার প্রভাব দেখা যাচ্ছে রাজস্ব আয়ে। এখন পর্যন্ত ৬৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি চলছে অর্থনীতিতে। বড় অঙ্কের এই টাকা আয় না হওয়ার একটা বড় কারণ হলো অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি কম। ফলে আমদানি থেকে শুল্ক আদায় কম, পণ্য বেচাকেনা থেকে ভ্যাট আদায় কম। সর্বোপরি ব্যক্তির আয় কমে যাওয়ায় আয়কর আদায়ও কম।

সরকারের রাজস্ব আয় কম হওয়ায় সরকার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় খরচও করতে পারছে না। মানে সরকারের বিনিয়োগ হচ্ছে না সন্তোষজনক হারে। বিশেষ করে উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ কমছে। বাজেট কাটছাঁট করতে হচ্ছে। এতে তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের আয় কমে যায়। ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় মানুষের চাহিদা কমছে। যার প্রভাবে উৎপাদনশীলতা কম। আবার আমদানি কমার কারণেও উৎপাদনে স্থবিরতা তৈরি হয়।

সম্প্রতি দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা ঘটা করে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে ব্যবসা-বিনিয়োগের নাজুক পরিস্থিতি তুলে ধরেছেন। একটি পত্রিকায় প্রকাশিত বিজিএমইএ, বিটিএমএ, বিকেএমইএ ও বিটিটিএলএমইএর দেওয়া ওই যৌথ বিবৃতিতে তাঁরা উল্লেখ করেন, উচ্চ দাম দিয়েও তাঁরা গ্যাস পাচ্ছেন না। ফলে চরম গ্যাসসংকটে তাঁদের শিল্পগুলো প্রায় বসে যাওয়ার দশা। এরই মধ্যে রপ্তানিমুখী অনেক পোশাক ও বস্ত্রশিল্প বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকগুলো বন্ধের পথে। তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, এভাবে চলতে থাকলে সামনে তাঁদের বৈদেশিক ক্রয়াদেশ বহাল রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। তাঁরা এও উল্লেখ করেছেন যে সরকারের শীর্ষ মহলে দফায় দফায় চিঠি দিয়েও তাঁরা কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। তাঁরা জানান, দেশের রপ্তানি আয়ের অন্তত ৮৫ শতাংশ তাঁদের শিল্পের অবদান। তাঁদের ওই শিল্পকে গ্যাস দেওয়ায় অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা থাকলেও তা করা হচ্ছে না।

তাঁরা আরো জানান, পোশাক খাতের অন্তত ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগই এখন হুমকির মুখে। উদ্যোক্তারা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, তাঁদের শিল্পগুলো টিকতে না পারলে পরিণামে তা রিজার্ভেও ঝুঁকি তৈরি করবে।

অর্থনীতির আরেক স্তম্ভ পুঁজিবাজারেও আশার খবর নেই। কয়েক মাস ধরেই মন্দার কবলে পড়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্রমাগত পুঁজি হারাচ্ছেন। তাঁরা প্রায় প্রতিদিনই বিক্ষোভ করছেন। কিন্তু বাজারে কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে না।

মোটকথা, সব মিলিয়ে অর্থনীতি এখন বেশ চাপের মুখে। উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে যেটা মনে হচ্ছে, অর্থনীতির জন্য এখন সরকারের অগ্রাধিকার ঠিক করা দরকার। একদিকে মুদ্রাবাজারকে স্থিতিশীল করা, সুদের হার ও গ্যাস-বিদ্যুৎ-জ্বালানির দর সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে এনে বিনিয়োগে গতি ফেরানো; অন্যদিকে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখে তাঁদের নিয়ে বসা এবং তাঁদের সমস্যাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে শোনা উচিত। তাঁরা কী কী সমস্যা মোকাবেলা করছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে কী নীতি-কৌশল গ্রহণ করা যেতে পারে।

সত্যিকার অর্থে এখন অর্থনীতিতে গতি ফেরানো সরকারের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত বলে প্রায় সব মহল থেকেই বলা হচ্ছে। আর এ জন্য সবস্তরের ব্যবসায়ীদের আস্থায় নেওয়াও সমান জরুরি। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি শক্ত হাতে দমনের পাশাপাশি তাঁদের গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ দেওয়া, আমদানি আরো উদার করা, সুদের হার কমিয়ে ঋণপ্রবাহ বাড়ানো, ডলারের দর আরো সহনীয় রাখা, ঋণ শোধে সহনীয় নীতি সহায়তা দেওয়া, আইএমএফের প্রেসক্রিপশন অগ্রাহ্য করে খেলাপি হওয়ার নীতিমালা আরো সহনীয় করা, ছোট-বড় সব ব্যবসায়ীদের কোনো ধরনের হয়রানি, নজরদারি বা জেল-জরিমানা, হামলা-মামলা না দিয়ে তাঁদের নিয়ে একসঙ্গে দেশ গঠনে আরো আন্তরিকভাবে কাজ করা। মোটাদাগে এগুলোই এখন সরকারের অগ্রাধিকারে থাকা উচিত। যেকোনো মূল্যে অর্থনীতিতে মানুষের কাজ আর আয়ের সুযোগ যেন বাড়ে তা দেখতে হবে। প্রয়োজনে এ বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে সরকার একটি বিশেষ কমিটিও করতে পারে। ওই কমিটি ত্বরিত করণীয় নির্ধারণে সুপারিশ করবে সরকারকে। তার আলোকে সরকার কাজ শুরু করবে।

এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।