ঢাকা, সোমবার, ৩০ ভাদ্র ১৪৩২, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

অর্থনীতি-ব্যবসা

শ্রমিকদের ভূমি অধিকারসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত চা শিল্প

ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:৫১, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৫
শ্রমিকদের ভূমি অধিকারসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত চা শিল্প নারী শ্রমিকের চা-পাতা উত্তোলনের দৃশ্য/ছবি: বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

গত কয়েক বছর ধরে ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’র সাম্রাজ্যে চলছে টানাপড়েন। দেশের কৃষিভিত্তিক এই চা-শিল্পটি ইদানীং বড় ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে সঠিক পরিকল্পনা, শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার প্রদান, তদারকি ও পরিচালনার প্রভৃতির অভাবে।

গত বছর দেশে চায়ের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১০৩ মিলিয়ন কেজি ছিল। কিন্তু উৎপাদন হয় ৯৩ দশমিক তিন মিলিয়ন কেজি। অবশ্য তার আগের বছর ২০২৩ সালে চা উৎপাদন হয় ১০২ দশমিক ৯২ মিলিয়ন কেজি। যা ছিল দেশের চা-শিল্পের ইতিহাসে রেকর্ড।

বিগত পাঁচ বছর থেকে আলোচিত সিন্ডিকেটের কারণে নিলাম বাজারে চায়ের ন্যায্যমূল্য পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ক্রমাগত লোকসান গুনতে হচ্ছে বাগানগুলোকে। চা সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা বলছেন, এই সংকট কাটিয়ে উঠতে না পারলে চা-বাগানগুলো চিরতরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

চা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বাগানগুলোর আর্থিক সংকট দূরীকরণে চার ভাগ থেকে পাঁচ ভাগ হারে ব্যাংক ঋণ প্রদানসহ নানা অসুবিধা দূরীকরণে বাগান মালিকরা চা সংসদদের চেয়ারম্যানের পদক্ষেপ দাবি করেছেন।  একইসঙ্গে তারা চা-শিল্পকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা, সিলেটে একটি নিলাম কেন্দ্র স্থাপন, চা বেশি পরিমাণে রপ্তানি করা, চা-শ্রমিকদের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করার উদ্যোগসহ ১২টি প্রস্তাবনা চা-সংসদের চেয়ারম্যান বরাবরে উত্থাপন করেছেন।  

একইসঙ্গে তারা উত্তারাঞ্চলে মান নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চায়ের উৎপাদনে চায়ের দরপতনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উত্থাপন করেছেন চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চা বাগানের ফসলের পরিমাণ কমে যাওয়া, গুণগত মানে বিঘ্ন ঘটানো এবং উৎপাদনের অস্থিরতা প্রভৃতি পরিবর্তনের সরাসরি দৃশ্যমান। চা গাছের জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বজায় রাখতে না পারা, নানা রোগ ও পোকামাকড়ের প্রকোপ বাড়ানো, এসব কারণে উৎপাদন প্রভাবিত হচ্ছে। এই সমস্যা মোকাবিলায় প্রযুক্তির আধুনিকীকরণ ও নতুন পদ্ধতির প্রয়োগ অপরিহার্য। চা-শ্রমিকদের রেশন, বেতন-ভাতা প্রদানসহ নানা বিষয় নিয়ে বাগানমালিকরা চরম সংকটে রয়েছেন। সম্প্রতি ফুলতলা চা বাগান, বুরজান চা বাগানসহ কয়েকটি চা বাগান মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়ছে।  

সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তা রক্ষায় পৃথক কোম্পানির পৃথক পরিচালনা কমিটি গঠন করে কোনোরকমে কীটনামক ওষুধ প্রয়োগ করে টিকিয়ে রেখেছেন। কোম্পানিগুলো আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বাগানগুলো পর্যবেক্ষণসহ পরিচালনার কথা জানিয়েছে।

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের (বাচাশ্রই) ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল বলেন, চা শুধু একটি জনপ্রিয় পানীয় নয়; এটি বাংলাদেশের লাখো কৃষক ও শ্রমিকের জীবিকা ও সামাজিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। চা শ্রমিকদের অধিকাংশই নারী, যারা তাদের পরিবারের অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলতে চা শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। তাই শ্রমিকদের ভূমি অধিকার সুরক্ষা, ন্যায্য মজুরি নিশ্চিতকরণ এবং কল্যাণমূলক কার্যক্রম গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।

তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, চা শ্রমিকদের ভূমি অধিকার থেকে পুরোপুরিভাবে বঞ্চিত। বাংলাদেশ শ্রম আইনের ৩২ ধারায় (১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘কোনো শ্রমিকের চাকরির অবসান হলে, তা যে কোনোভাবে হোক না কেন, তিনি চাকরির অবসানের ৬০ দিনের মধ্যে মালিক কর্তৃক বরাদ্দ করা বাসস্থান ছাড়িয়া দেবে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের চা শ্রমিকদের দাবি, দেশের নিবন্ধিত ১৬৭টি চা বাগানের যে সোয়া লাখের মতো চা শ্রমিক রয়েছে তার সঙ্গে অন্য শ্রমিকদের এক করে দেখার অদূরদর্শিতায় ভূমি অধিকারের মতো রাষ্ট্রীয় মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। পৌনে ২শ বছরেও চা শ্রমিকদের ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনযাপনের সঙ্গে দেশের মূল সমাজের সংযোগ সামান্য। চা বাগানের বাইরে অচেনা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় তাদের চা বাগানের পরিবেশেই আটকে থাকতে হয়। তারপরও চা শ্রমিকদের ভূমি অধিকার নেই।

সিনিয়র টি-প্লান্টার এবং বাংলাদেশীয় চা সংসদের সিলেট ব্রাঞ্চ প্রতিনিধি ইবাদুল হক বলেন, সরকার নিলাম মূল্য প্রতি কেজি চা ২৪৫ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও সিন্ডিকেটের তৎপরতায় বাগানমালিকসহ সংশ্লিষ্টরা এ নিয়ে শঙ্কিত। এমনিতেই সার কীটনাশক, তেল ইত্যাদির দাম বেড়েছে। এই অবস্থায় চায়ের আকাঙ্ক্ষিত মূল্য পাওয়া না গেলে চায়ে লোকসান বাড়বে। দেশের চা-বাগানগুলোর আদৌ টিকে থাকবে কি না সন্দেহ।  

তিনি বলেন, ২০১৫ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত চায়ের উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৫৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। একই সময়ে চায়ের দর বেড়েছে ৯ দশমিক ১৬ ভাগ। দামের তুলনায় উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় চা-শিল্পের আর্থিক সক্ষমতা কমেছে। তাই চা-শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে প্রতি কেজি চায়ের গড় মূল্য ২৫০ টাকায় উন্নীত করতে হবে।  

দেশের চা-বাগানগুলো মহাক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। চা একটি সংবেদনশীল কৃষি পণ্য। এর জন্য প্রয়োজন সুষম আবহাওয়া। এবারও মৌসুমের প্রথমে খরা দেখা দেওয়ায় উৎপাদন হার হ্রাস পায়। জুন থেকে মোটামুটি ভালোই বৃষ্টি হচ্ছে। এটা যদি পুরো সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে তাতে করে খরাজনিত লোকসান পুষিয়ে যেতে পারে বলে জানান এই চা বিশেষজ্ঞ।   

বিবিবি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।