ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৪ আশ্বিন ১৪৩২, ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ১৬ রবিউস সানি ১৪৪৭

অর্থনীতি-ব্যবসা

বিপন্ন ব্যবসা বিনিয়োগ কর্মসংস্থান শঙ্কায় ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:১৬, অক্টোবর ৯, ২০২৫
বিপন্ন ব্যবসা বিনিয়োগ কর্মসংস্থান শঙ্কায় ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা ছবি: সংগৃহীত

ব্যবসা-বাণিজ্যিক পরিস্থিতি নাজুক সময় পার করছে। আইন-শৃঙ্খলার অবনতিতে কমবেশি সবার মধ্যেই নিরাপত্তা ও আস্থাহীনতা।

ফলে এর প্রভাব পড়েছে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে। উচ্চ সুদের হার, ডলারের উচ্চমূল্য, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি কম এবং পণ্যের চাহিদাও কমে গেছে।

ফলে নতুন ব্যবসা বা উদ্যোগে বিনিয়োগ কিংবা ব্যবসা প্রসারের দিকে মনোযোগ নেই উদ্যোক্তাদের। পুরো ব্যবসা খাতে যখন স্থবিরতা, তখন প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আয়েও। একের পর এক কারখানা বন্ধের কারণে লাখো মানুষ কর্মহীন হয়েছে। বেড়েছে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য।

সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হলেও সর্বশেষ হিসাবে মূল্যস্ফীতি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে রেকর্ড উচ্চতায়। ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন। তাঁরা সরকারের কাছ থেকে কোনো আশ্বাস পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন।
বিশ্বব্যাংক এক দিন আগে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে একটি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

তাতে তারা বলছে, বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বড় ধাক্কা খেয়েছে। সার্বিক অর্থনীতিতে এক ধরনের মন্দার ছায়া দেখা যাচ্ছে। সংস্থাটি বলছে, বেসরকারি বিনিয়োগ নেমেছে ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিও ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে ঠেকেছে। ব্যাংকে ঋণখেলাপিও রেকর্ড গড়েছে।

হার বেড়ে হয়েছে ২৪.১ শতাংশ। কর-জিডিপি অনুপাত কমতে কমতে ৬.৮ শতাংশে এসে ঠেকেছে। বেকারত্ব বেড়ে ৩.৭ শতাংশ। রপ্তানিতে ইতিবাচক ধারা থাকলেও দুই মাস ধরে টানা কমছে। আগস্টে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমেছে ৩ শতাংশ আর সেপ্টেম্বরে কমেছে ৪.৬১ শতাংশ হারে। সবচেয়ে বড় কথা, সংস্থা চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ব্যাংক খাতের দুর্বলতাকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির  গতি হারানোর পেছনে অন্যতম কারণ বলে দায়ী করেছে।

সব মিলিয়ে অর্থনীতি বেশ চাপেই রয়েছে। দেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারাও ক্রমাগত পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও সংশয় প্রকাশ করে যাচ্ছেন। তাঁরা নতুন বিনিয়োগ দূরের কথা, চলমান ব্যবসারও অন্তত ৫০ শতাংশ কম সক্ষমতায় ব্যবসা চালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। কেউ কেউ বলছেন, সবচেয়ে ইতিবাচক খাত পোশাক রপ্তানিতেও ভাটার টান দেখা যাচ্ছে। খোদ সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পেও গতি নেই। কেউ কেউ বলছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে অনেকটা রোগী আইসিইউতে থাকলে যেভাবে থাকে সে রকম। কোনো রকমে টিকে থাকার মতো অবস্থা। অনেকে বলছেন, তাঁদের খাতের কারখানা একের পর এক বন্ধ হয়ে বিপুল লোকের কর্মসংস্থান হারাচ্ছে সুদের হার ও উপকরণের বাড়তি খরচের কারণে। সরকারের তাঁদের দিকে বলতে গেলে কোনো মনোযোগই নেই। এমনকি সরকারের কোনো পক্ষ থেকে ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের সঙ্গে তাঁদের সংকট নিয়ে আলাপও করেনি। জানতে চাওয়া হয়নি এমন সংকট থেকে কিভাবে উত্তরণ ঘটানো যায়। অনেক ব্যবসায়ীর শিল্প-কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে নানা অভিযোগে। অথচ তা চালু রেখেই আইনি প্রক্রিয়া চালানো যেত বলে কথা উঠেছে। কারো কারো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে রাখার কারণে তাঁদের কারখানাগুলো বেতন-ভাতা দিতে পারছে না। বলতে গেলে রুগ্ণ হয়ে বন্ধের পথে। অনেক ব্যবসায়ীকে হয়রানি করা হচ্ছে। অনেকে মামলা-হামলার শিকার হয়ে অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছেন। বিদেশে ব্যবসা-বিনিয়োগ বৈঠকেও অংশ নিতে পারছেন না। তাঁরা রীতিমতো হতাশ, ক্ষুব্ধ।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল হাই সরকার বলেন ‘বলতে গেলে অর্থনীতির সব সূচকই এখন খারাপ অবস্থায় রয়েছে। ব্যবসা-বিনিয়োগবান্ধব নয়। দেশে এরই মধ্যে অনেক ভুলভ্রান্তি হয়ে গেছে বিভিন্ন স্তরে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ব্যবসায়ীদের কেউ বোঝার চেষ্টা করে না। বিশেষ করে আমলা বা নীতিনির্ধারকরা আমাদের দুঃখগুলো বোঝেন না। তাঁরা খালি বসে আছেন কিভাবে পয়সা বানাবেন। যাঁরা নীতি প্রণয়ন করবেন তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকা দরকার। কী কারণে ব্যবসা বাধাগ্রস্ত হয় সেগুলো জানলে আমাদের জন্য সহজ হতো। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ডিগ্রি নিয়েছেন, থিউরিটিক্যাল লোক, কিন্তু আমরা কিভাবে ব্যবসা করি সেটা তাঁরা বুঝতে চান না। প্র্যাকটিক্যাল যেসব বাধা রয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে একটি গ্যাপ রয়েছে। এগুলো কমানো দরকার। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা স্থানীয়রা কেমন আছে, সেটি দেখেন আগে। অনেকগুলো ফ্যাক্টর দেখেন তাঁরা। আমাদের কথায় চলে আসেন না। এ ছাড়া বিনিয়োগের মূল শক্তি হলো জ্বালানি ও বিদ্যুৎ। এগুলো না পেলে আর সবকিছু থাকলেও চলবে না। ’

রপ্তানি খাতেও ভাটার টান দেখা যাচ্ছে। গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে টানা রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমেছে। নিট পোশাক রপ্তানি খাতের উদ্যোক্তা ও বিকেএমইএর সাবেক প্রেসিডেন্ট ফজলুল হক বলেন ‘ব্যবসা-বাণিজ্য এখন আসলে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায়। চলছে আর কি, চালিয়ে রাখা হয়েছে। রোগী মরে যায়নি, বেঁচে আছে, সবাই খুশি—এ রকম অবস্থা। সরকারের লোকজন বলছে অর্থনীতি নাকি চলছে। এই চলাতেই তারা হ্যাপি। বন্ধ হয়ে যায়নি। অর্থনীতিতে বড় ধরনের অগ্রগতি তেমন নেই। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি যে ব্যবসায়ীদের নিয়ে বসা দরকার। তাঁদের আস্থায় নিয়ে কিছু করা দরকার ছিল, সেটা হয়নি। সরকার সম্ভবত প্রয়োজন মনে করছে না যে বসা দরকার, এ জন্য বসে না। আবার এখন হয়তো যাওয়ার সময় হয়ে গেছে—এটাও কারণ হতে পারে। নতুন সরকার না আসা পর্যন্ত এটা থেকে উদ্ধারের আর কোনো আশা আমি দেখছি না। ’

বেসরকারি উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগই স্থবির। আস্থাহীনতা চরমে। ঢাকা চেম্বারের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসেন খালেদ বলেন ‘অর্থনীতিতে মন্দার একটা ছায়া রয়েছে, এর একটা প্রধান কারণ হলো—সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ প্রায় গতিহীন। সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প থেকে জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ আসে। সেখানে বেসরকারি খাতও জড়িত। সরকার শুধু বরাদ্দ দেয়। বাস্তবায়ন করে বেসরকারি খাত। শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া, তাঁদের খাদ্য সরবরাহ করা—সবই একটা সাপ্লাই চেইনের ব্যাপার। এক বছর ধরে পুরো কাজটা থেমে রয়েছে। ঠিকমতো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আমার মনে হয়, সেটা থেকে অর্থনীতিতে যে ইমপ্যাক্ট আসার কথা সেটা আসছে না। জিডিপির শর্টফলটা ওটার কারণেই। অন্য অনেক ইন্ডাস্ট্রিও এখন শর্টফলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গত এক বছরে সেরকারি খাতে ইকুইটি বা ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট অলমোস্ট জিরো। নতুন সক্ষমতা বাড়েনি। বেসরকারি খাতেও আস্থা নেই, চাহিদা নেই। মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও কমেছে। সবাই কমবেশি অর্ধেক ক্যাপাসিটিতে চলছে। নতুন সরকার আসারও ছয় মাস পর পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে। তার আগে নয়। ’
নারী উদ্যোক্তারাও সংকটময় পরিস্থিতি পার করছেন। সবাই একটি নির্বাচন শেষে সুস্থ পরিবেশ আশা করছেন। উইমেন এন্টারপ্রেনার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডব্লিউইএবি) প্রেসিডেন্ট নাসরিন আউয়াল মিন্টু কালের কণ্ঠকে বলেন ‘এখন চলছে অন্তর্বর্তী সরকারের শাসন। এটি রাজনৈতিক সরকার নয়। ফলে যার যা ইচ্ছা করছে। কোনো দায়বদ্ধতা নেই। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হচ্ছে। কেউ কিছু বলার নেই। বিনিয়োগকারীরাও তাকিয়ে রয়েছেন রাজনৈতিক সরকারের দিকে। নারীদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে। লুটপাট হচ্ছে। ভল্ট কেটে জুয়েলারির সব নিয়ে যাচ্ছে। এসব থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সুষ্ঠু ভোট হওয়া দরকার। একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক সরকার এলে তখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে। না হলে এসব চলতেই থাকবে। সবাই অপেক্ষা করছে নতুন সরকার এলে বিনিয়োগ করবে। এখন তারা ভয় পাচ্ছে। এক বছরে বেকারত্ব অনেক বেড়েছে। এখন সবাই স্ট্রাগল করছে। নারী উদ্যোক্তারাও অনেক সংকটের মধ্যে রয়েছেন। ’

অ্যাকসেসরিজ খাতের সংগঠন বিজিএপিএমইএর প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন ‘আমার সেক্টরের ৪৩ শতাংশ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। উচ্চ সুদের হারই এর বড় কারণ। আগে ঋণের সুদ ছিল ৯ শতাংশ। এখন দিতে হচ্ছে ১৬ শতাংশ। বেশি দাম দিয়েও ঠিকমতো জ্বালানি সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া ক্রয়াদেশও আগের মতো নেই। আমাদের পণ্যের দরও কমে গেছে। সব মিলিয়ে সবাই সংকটে রয়েছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক কারণ তো রয়েছেই। মালিকরা শঙ্কায় দিন পার করছেন। তাঁরা ঠিকমতো ফ্যাক্টরি চালাতে পারছেন না। আর নতুন তো হচ্ছেই না। আমাদের খাতে সাড়ে আট হজারের মতো শ্রমিক কর্মহীন হয়েছেন ক্রমাগত ক্যাক্টরি বন্ধ হওয়ার কারণে। ’

সূত্র: কালের কণ্ঠ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।