ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

শুক্রবারের সরেজমিন

অবরোধের আগুনে ছাই সবজিচাষীর স্বপ্ন

সাজেদা সুইটি, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৫
অবরোধের আগুনে ছাই সবজিচাষীর স্বপ্ন ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শুক্রবারের সরেজমিন, বাংলানিউজের নিয়মিত উদ্যোগ। প্রতি শুক্রবার বাংলানিউজের একটি টিম চলে যাচ্ছে কোনো বিশেষ ঘটনাস্থল বা সাইটে।

সেখানে ঘুরে কথা বলে, বিষয়ের গভীরে ঢুকে তুলে আনছে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলের রিপোর্ট ও ফিচার। থাকছে ছবি-ভিডিও। যা প্রকাশিত হচ্ছে পরবর্তী রোববারে। ‘শুক্রবারের সরেজমিন’র এবারের স্পট ছিলো নরসিংদীর সবজি বাজারগুলো। বাংলানিউজ টিম গত শুক্রবার এ জেলার বিভিন্ন বাজার-মাঠ ঘুরে কৃষকের কর্ম-চাঞ্চল্য দেখেছে। আশেপাশে এ পেশায় জড়িত মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে। যার মধ্য থেকে উঠে এসেছে কৃষকের মানুষের চাওয়া-পাওয়ার গল্প। এবারের টিমে ছিলেন চিফ অব করেসপন্ডেন্টস সাজেদা সুইটি, সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্টস দেলোয়ার হোসেন বাদল, নিউজরুম এডিটর শামীম হোসেন ও শুভ্রনীল সাগর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট শাহজাহান মোল্লা ও আবু খালিদ।

নরসিংদী থেকে ফিরে: অবরোধের আগুন শুধু যানবাহনেই লাগেনি, এই আগুনে খাক হচ্ছে নরসিংদীর প্রান্তিক সবজিচাষীর স্বপ্নও। সাদামাটা জীবনযাপনের ন্যূনতম স্বপ্নই প্রতিদিন চূর হচ্ছে তাদের।  
 
শুক্রবার নরসিংদীর সবজিচাষীদের দোর ঘুরে তাদের কষ্টের সাক্ষী হয় বাংলানিউজ। কষ্টে ফলানো সবজি ন্যায্যদামে বিক্রির সুযোগ মাটি হচ্ছে চাষীদের। কিছু সবজি বিক্রি করছেন তারা নামমাত্র দামে, আর কিছুতো চোখের সামনেই পচে।
 
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ‘অবরুদ্ধ’ ঘটনার পর দেশব্যাপী চলা অবরোধের সরাসরি শিকার এসব চাষী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বা বিএনপি প্রধান খালেদার প্রতি নয়, চাষীদের কারও কারও অভিমান নিজের নিয়তির প্রতি। জানাচ্ছেন, জন্ম থেকেই জ্বলছেন তারা নানারকম আগুনে।  
 
রাজধানীসহ দেশের নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, ফেনী-নোয়াখালী-চৌমুহনী ও চট্টগ্রামে সবজি চাহিদার অন্যতম যোগানদার নরসিংদীর চাষীরা। দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও রপ্তানি হয় এ সবজি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ খাতটির বর্তমান ও ভবিষ্য‍ৎ –দুই’ই নষ্ট হচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতায়। কোথায় গেলে উপায় পাবেন, জানেন না এ অসহায় মানুষগুলো।
 
বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপে কেউ অবরোধ তোলার আকুতি জানান, আর কেউ চান সরকারের কাছ থেকে নগদ ক্ষতিপূরণ।
 
কুয়াশাভেজা ভোরে কথা হয় শিবপুরের সবজি চাষী মো. দুলাল মিয়া ও তার মা তারাবানুর সঙ্গে। সিএনবি বাজারের কাছের একটি ‘ক্ষেতে’ ‘পিঁয়াজের ঠোসা’ (পিঁয়াজ পাতা বা কলি) তুলছিলেন তারা। নিজেদের এই জমিটি চুক্তি ছাড়াই এক লাখ ৭০ হাজার টাকায় বন্ধক নিয়ে চাষ করছে এ পরিবার।  
 
বাংলানিউজকে তারাবানু বলেন, ‘বৃষ্টি, কুয়াশার ক্ষতি তো রইছেই, লগে রইসে হরতাল(অবরোধ)। গাড়ি চলে না, চইললেও কম চলে। চউক্ষের সামনে পইচা যায় উরি (শিম), কপি, পিঁয়াজের ঠোসা। এক টাকা-দুই টাকায় ছাইরা (বেচে) দেওয়া লাগে কপি, উরির দামও খালি কমে। ’
 
কোলে রাখা নাতি সায়েম ও পাশে দাঁড়ানো নাতনি সানজিদার দিকে দেখিয়ে বলেন, ‘অ্যারার ভবিষ্য‍ৎ কী অইবো জানি না। দ্যাশে খাইয়া বাচতারবো নি কইতে পারি না। ’
 
দুলাল বলেন, ‘সারামাসে এমনিতে কোনভাবে খায়া-পইরা বাঁচি। কিন্তুক অবরোধে দাম পইড়া যায়, লস অয়। কপি বেচি ছয় টাকা/সাত টাকায়, আর অহন এক টাকা/দুই টাকায়। ’
 
শিবপুরের জমজমাট পাইকারি বাজারগুলোর অন্যতম সোম ও শুক্রবারের সিএনবি বাজার। অবরোধের কারণে এই বাজারেও এখন ভিন্ন চিত্র। সবজি আসছে, কিন্তু ক্রেতা নেই। পাইকারি বাজারগুলোর সরগরম ভাব নেই- এসব তথ্য জানালেন বাজারের নিয়মিত পণ্যদাতা সবজিচাষী মো. রমিজ উদ্দিন।
 
অবরোধে বিরক্ত ও বিক্ষুব্ধ রমিজ বাংলানিউজকে বলেন, বিরোধীদল হরতাল দেয়, অবরোধ দেয়। সর্বনাশ হয় আমাদের মতো কৃষকের। তাই আমাদের নগদ ক্ষতিপূরণ দেওয়া দরকার।
 
তিনি বলেন, চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ে দ্বিগুণ। কিন্তু কৃষকদের দিকে কারও খেয়াল নাই। সরকার যদি কৃষকদের না দেখে কে দেখবে? বিরোধীদল নিজেদের স্বার্থই দেখবে। আমাদের স্বার্থতো সরকারকেই দেখতে হবে।
 
অষ্টম শ্রেণী পাস রমিজ রাজনীতিবিদদের প্রতি নানা বিষয়ে বিরক্ত। সচেতন কণ্ঠে রমিজ বলেন, দেশ যেমন চলছে, তাতে যদি বিরোধীদলের আপত্তি থাকে, তারা যদি নিজেরাই আরও ভালোভাবে দেশ চালাবে মনে করে, তাহলে অন্য সমাধান খুঁজতে পারে। আমাদের সর্বনাশ করে কী লাভ? 
 
বাংলানিউজের ফটোসাংবাদিকের ক্যামেরা দেখে কৃষক আবুল কাশেম কন্ঠে অভিমান চড়িয়ে বলেন, ‘ছবি তুইল্যা কী করবো হুদাহুদি! কপি বেচতারিনা চাইর আনা কইরা। গাড়ি-ঘোড়া বন্ধ রইসে। সবই গরীবের কপাল!’
 
শিবপুরের যোশর বাজার শনি ও বুধবার জমে। সঙ্গতকারণে শুক্রবার বন্ধই পাওয়া গেল যোশর। তবে অবরোধের প্রভাব পড়েছে এই বাজার ঘেরা কৃষকদের ওপরও।
 
বেলাব উপজেলার কলেজগেটে শুক্র ও মঙ্গলবার বসে পাইকারি বাজার। সবজিচাষী ফজলুল হক বাংলানিউজকে বলেন, বৃষ্টি, কুয়াশা, বন্যা, হরতাল-অবরোধ- যেকোনো দুর্যোগেই অতি অল্প সময়ে সরাসরি ক্ষতিতে পড়েন সবজির কৃষক। কিন্তু তাদের ক্ষতি কমাতে কেউ কোনো উদ্যোগ নেয় না। না সরকার, না কোন সংগঠন- কেউ কোন চিন্তা করে না কৃষকদের নিয়ে।
 
তিনি বলেন, ‘এখন ফলাচ্ছি ফুলকপি, শিম ও লাউ। এরপরে চাষ হবে বেগুন, করলা, কাকরোল, ধুন্দল। এখন কুয়াশার কারণে লাউয়ের করা নষ্ট হয়, মইজ্জা যায়, রোদে জ্বইল্যা যায়। বর্ষাকালে বৃষ্টিতে নষ্ট। এর ওপরে অবরোধ। সব দিক দিয়ে মাথায় বাড়ি। ’
 
এই চাষীরা সারা দেশের চাষীদের অবস্থাই যেন তুলে ধরছেন। গুরুত্বপূর্ণ কৃষিখাত, সারাবছরের প্রয়োজন সবজি- তাই এর যোগানদাতাদের আকুতি রাজনীতিকদের প্রতি, সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের প্রতি। যেকোনো ঘটনায় বড় ক্ষতির শিকার যেন কৃষকরা না হন, সেদিকে দৃষ্টি চান সবার। খুব বড় চাহিদা তাদের নেই, বরং ঘর-পরিবার নিয়ে একটু খেয়ে-পরে বাঁচার নিশ্চয়তা চান সবার কাছে। অবরোধের আঁচে জীবন ছাই যেন না হয়- সেটাই সরকারের কাছে তাদের চাওয়া।  

** ফুলকপির বাম্পার ফলনেও বিপাকে কৃষক!
** ‘তোলা’ সবজিতেই কল্পনাদের জীবন
 
বাংলাদেশ সময়: ০৮০০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।