ঢাকা, শনিবার, ৬ পৌষ ১৪৩১, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

আশুলিয়ায় অশান্তির নেপথ্যে ১৪৭ জন, এবার ‘বাঘ শিকার’

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৪৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৬
আশুলিয়ায় অশান্তির নেপথ্যে ১৪৭ জন, এবার ‘বাঘ শিকার’ আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে সক্রিয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী

আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল ঘিরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে সরকার। এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে ১৪৭ জনকে। যাদের বিরুদ্ধে আশুলিয়াকে অস্থিতিশীল করে তোলার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্য প্রমাণও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে রয়েছে।

ঢাকা: আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল ঘিরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে সরকার। এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি নেওয়া হয়েছে।

এরই মধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে ১৪৭ জনকে। যাদের বিরুদ্ধে আশুলিয়াকে অস্থিতিশীল করে তোলার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্য প্রমাণও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে রয়েছে। এদের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পথেই যাচ্ছে সরকার।

দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, উষ্কানি দিয়ে কারণে অকারণে নিরীহ শ্রমিকদের আন্দোলনে ইন্ধন যোগানো, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাতকে বাধাগ্রস্ত করা, আর বিশ্বের কাছে দেশের পোশাক শিল্পের বিষয়ে নেতিবাচক বার্তা দেয়াই এই স্বার্থান্বেষী গ্রুপটির লক্ষ্য। সে লক্ষ্যেই শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি করছে তারা। বেছে বেছে এমন ১৪৭ জনকে চিহ্নিত করেছে সরকারের একটি শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা।

সূত্র নিশ্চিত করেছে, সেই তালিকা এখন সরকারের নীতি নির্ধারকদের টেবিলে টেবিলে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।

আর এই অপরাধীদের বিন্দুমাত্র ছাড় না দিয়ে এমন ষড়যন্ত্রের বীজ সমূলে উৎপাটনে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্তই নিয়েছে সরকার। নীতি একই জিরো টলারেন্স, জানিয়েছে সূত্র।
আশুলিয়ার অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে পুলিশের রায়টকার, ছবি: ইমন দেওয়ান
পাশাপাশি শ্রমঘন আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল নিয়েও নেয়া হয়েছে নানা ধরনের পরিকল্পনা। এখানে কোন মতেই চলতে পারবে না অননুমোদিত কোন শ্রমিক সংগঠন বা বেসরকারি সংস্থার এনজিও) কার্যক্রম। সিদ্ধান্ত হয়েছে প্রতিটি  কারখানায় শ্রমিক কল্যাণ কমিটি গঠনের। পুলিশের বিদ্যমান কাঠামোতেও আনা হয়েছে পরিবর্তন।

সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নীতি নির্ধারকদের সাথে কথা বলেও এসব তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।

সূত্র মতে, দেশে তৈরি পোশাকের চারটি বড় শিল্প এলাকার মধ্যেই কেন বেছে বেছে সাভারে আশুলিয়ার জামগড়া থেকে অসন্তোষের সূত্রপাত হয়? এই প্রশ্নকে সামনে রেখেই কাজ শুরু করে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা। মাঠ পর্যায়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণে উঠে আসে শ্রমিক অসন্তোষের নেপথ্যে নানা ধরনের কারসাজি আর স্বার্থান্বেষি মহলের তৎপরতার কথা।

তালিকায় উঠে আসে কিছু শ্রমিক সংগঠন, কথিত শ্রমিক নেতা, আবার শ্রমিক নেতা নামধারী টাউট, অভিনেতা নামধারী সন্ত্রাসী, ঝুট ব্যবসায়ি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, বাম ঘরানোর মিশ্র কিছু সংগঠন, সংসদের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলের নেতা, জনপ্রতিনিধি, এমনকি গণমাধ্যমে কাজ করা স্থানীয় সংবাদদাতার নামও।

গোয়েন্দা রিপোর্টে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত একজন শিক্ষার্থী নাম উল্লেখ করে বলা হয়, বাম শ্রমিক সংগঠনের নেতা পরিচয়ে শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে শ্রমিক প্রতি তিনি মাসে ১০ টাকা করে চাঁদা নেন। এভাবে তিন লক্ষাধিক শ্রমিক অনুপাতে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন এই ছাত্র নেতা।

আর শ্রমিকদের উষ্কানি দিয়ে ক্ষুব্ধ করে তোলার প্রাথমিক দায়িত্বটি পালন করেন তিনিই।
আশুলিয়ায় দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
চাকুরি চলে গেলে শ্রম আইন অনুযায়ী বরখাস্ত বা চাকুরিচ্যুত শ্রমিকদের প্রাপ্য তুলে দেবার কথা বলেও মালিকদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধে আদায়ে সিদ্ধহস্ত এই নেতা।

পাশাপাশি চুক্তির অধীনে শ্রমিকদের চাকুরি অবসান সুবিধায় প্রাপ্ত অর্থের একটি বড় অংশই যায় তার পকেটে। এরই মধ্যে ওই ছাত্রনেতাকে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর হেফাজতে নেয়া হয়েছে।

একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাভার সংবাদদাতার বিরুদ্ধে রিপোর্টে বলা হয়,২০১৩ সালেও তিনি দায়িত্বজ্ঞানহীণ ভাবে হীন উদ্দেশে শ্রমিকদের উষ্কানি দেন। সেবার তাকে সর্তক করা হলেও এবার একজন বিএনপি নেতার সাথে দেশের বাইরে গিয়ে তিনি তৈরি পোশাক শিল্পের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন বলে উল্লেখ করা হয় রিপোর্টে।

‘তার হাতে সব সময় নগদ ১৫/২০ লাখ টাকা থাকে। যা দিয়ে তিনি শ্রমিক থেকে গণমাধ্যম কর্মি এমন অনেকের জীবন ধারণের ব্যয় নির্বাহ করতেন,’ এমনটাই বলা হয় ওই রিপোর্টে। তাকেও আনা হয়েছে আইনের আওতায়।

‘ম’ আদ্যাক্ষরের একজন অভিনেতা নামধারী ঝুট ব্যবসায়ির বিষয়ে রিপোর্টে বলা হয়েছে, তিনি ছিলেন নির্মাণ শ্রমের যোগালী। ঝুট ব্যবসার সুবাদে এখন শত কোটি টাকার মালিক। অভিনয় না জানলেও অর্থের বিনিয়মের বনে গেছেন অভিনেতা। তবে দর্শক জনপ্রিয়তা বঞ্চিত হয়ে এখন খুলেছেন প্রশাধনী তৈরির কারখানা। নিজেকে শিল্পপতি পরিচয় দিলেও ঝুট নিয়ে এখনো তিনি তৈরি পোশাক শিল্পে ষড়যন্ত্র করছেন বলেও উল্লেখ করা হয় ওই রিপোর্টে।

এমন মোট ১৪৭ জনের নাম ছকে সাজিয়ে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য, শিল্পাঞ্চল ঘিরে তাদের অশুভ তৎপরতা চিহ্নিত করে যার যার আমলনামা তুলে ধরা হয় ওই রিপোর্টে।

গোয়েন্দা তথ্যমতে, আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল ঘিরে অধিকতর সক্রিয় রয়েছে ১৭ টি শ্রমিক সংগঠন। এদের মধ্যে ৮ টিরই কোন অনুমোদন নেই।
সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় কেবলমাত্র বৈধ শ্রমিক সংগঠনগুলোই কাজ করতে পারবে। ভূইফোঁড় বা দেশি বিদেশি স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচণায় নামে বেনামে অবৈধ কোন শ্রমিক সংগঠন আশুলিয়ায় কাজ করতে পারবে না। করলেই তাদের আনা হবে আইনের আওতায়। ইতোমধ্যে ভূইফোঁড় সংগঠনের এমন বেশ কয়েকজন নেতাকেও নেয়া হয়েছে পুলিশ হেফাজতে।

আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল ঘিরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে পুলিশি তৎপরতা, ছবি: ইমন দেওয়ান
শিল্পাঞ্চলের নিরাপত্তায় পুলিশের বিদ্যমান কাঠামোতেও আনা হয়েছে পরিবর্তন। কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থাকে নেয়া হচ্ছে কারখানা পর্যায়ে। আগে থানায় দু’জন পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) থাকলেও এখন সেখানে কাজ করবেন চারজন। বিদ্যমান কাঠামো মধ্যে  অফিসার ইনচার্জ (ওসি), পরিদর্শক (তদন্ত) পদের বাইরে পরিদর্শক (অপারেশন্স) ও পরিদর্শক (কমিউনিটি পুলিশিং ও ইন্টিলিজেন্ট)  নামের নতুন দুটি পদে ইতোমধ্যে নিয়োগ দেয়া হয়েছে জনবল।

দ্রুত নজরদারীর আওতায় আনতে কারখানায় পুলিশের তদারকিতে গঠন করা হবে শ্রমিক কল্যান কমিটি। যার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক থাকবেন শ্রমিকরা। ৫’শ অধিক শ্রমিক রয়েছে। এমন প্রতি ১০টি শিল্প কারখানার দায়িত্ব থাকবেন একজন করে পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর।

এ ছাড়াও শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিকদের সুবিধা অসুবিধা নিশ্চিত করা,  হয়রানি বন্ধ করা, শ্রমিক অসন্তোষের তাৎক্ষণিক কারণ উৎঘাটন ও প্রতিকারে গঠন করা হয়েছে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি। স্থানীয় সংসদ সদস্যকে উপদেষ্টা করে এই কমিটির প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন ঢাকার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম। কমিটিতে রয়েছেন দু’জন সহকারী পুলিশ সুপার ও চারজন ইন্সপেক্টর।

শ্রমিকরা যাতে অযথা হয়রানি বা বঞ্চনার শিকার না হয়, আগামী তিন বছরের মধ্যে তাদের বাড়িভাড়া না বাড়ে সেসবও নিশ্চিত করবে এই কমিটি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলানিউজকে জানান, সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বেশকিছু নির্দেশনা তারা পেয়েছেন। সেসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে তারা কাজ করছেন।

গত ২১ ডিসেম্বর বাংলানিউজে প্রকাশিত ‘পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলন, কালো বেড়াল খোঁজার পথের সন্ধান! শিরোনামে খবরের প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে তিনি আরো জানান, এবার কিন্তু আর কালো বেড়াল নয়। বলতে পারেন আমরা বাঘ শিকার করতে নেমেছি। শিগগির এর ফলাফল দৃশ্যমান হবে বলেও জানান তিনি।

‘পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলন, কালো বেড়াল খোঁজার পথের সন্ধান!

বাংলাদেশ সময় ০৯৩৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৬
এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।