তবে সাভারে স্থানান্তরিত চামড়া শিল্পপল্লীতে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সমস্যার কারণে পুরোপুরিভাবে উৎপাদনে যেতে পারছেন না মালিকরা। তাই তাদের পড়তে হচ্ছে লোকসানে।
মঙ্গলবার ( ১১ এপ্রিল) সাভার চামড়াশিল্প নগরে গেলে চামড়া কারখানার শ্রমিক ও মালিকরা বাংলানিউজের কাছে তাদের এসব সমস্যার কথা তুলে ধরেন।
সাভারে প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু হওয়া আর কে লেদারের শ্রমিক পারভেজ বাংলানিউজকে বলেন, সাভারে যেসব শ্রমিক কাজ করবে তাদের বাসস্থানের কোনো জায়গা বা ব্যবস্থা নেই। এখানে কোনো মেডিকেল নেই। দুর্ঘটনা ঘটলে নিয়ে যেতে হয়/হবে ঢাকায়। গতকালও (সোমবার) অ্যাপেক্স কারখানার মেশিনে জড়িয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এখানে যদি একটি মেডিকেল থাকত তাহলে দুর্ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব হতো।
পারভেজ আরও বলেন, এছাড়া এখানে একবার বিদ্যুৎ গেলে ৬-৭ ঘণ্টার আগে আসে না। শুক্রবারে তো বিদ্যুৎ থাকেই না। আবার এখানে গ্যাসও নেই। লাখ লাখ টাকার মাল নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। ফলে গ্যাস,বিদ্যুৎ ও পানির সমস্যার কারণে পুরোপুরিভাবে কাজ করা যাচ্ছে না। এদিকটায় সংশ্লিষ্ট কারোরই কোনো নজর নেই।
ট্যানারির বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে মার্চেন্টস ট্যানারির ম্যানেজার টিপু সুলতান বাংলানিউজকে বলেন, যেসব ট্যানারি চালু হয়েছে, সেগুলোতে এমুহূর্তে প্রাথমিকভাবে ব্লু ওয়েস্ট-এর কাজ চলছে। এছাড়া আর কোনো কাজই করা যাচ্ছে না। সাধারণত একটি চামড়ার ৩টি ধাপ থাকে। ব্লু ওয়েস্ট, ক্রাটস ও ফিনিশিং। আর ব্লু ওয়েস্ট চামড়া রপ্তানি করা যায় না। এই চামড়া রপ্তানি করতে হলে আরও দুটি ধাপের কাজ করতে হয়। কিন্তু সেটা করতে হলে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ,গ্যাস ও পানির ব্যবস্থা করতে হবে। আর ড্রামে যখন চামড়া প্রক্রিয়াকরণ করা হয় তখন টনকে টন পানির প্রয়োজন। কিন্তু এখানে সেটা নেই। আর হালকা বৃষ্টি হলেই এখানে হাঁটুসমান পানি উঠে যায়। কেননা এখানকার দুই ইঞ্চি ব্যসার্ধের পানির লাইন দিয়ে পর্যাপ্ত পানি যাওয়া সম্ভব নয়। আর পানি সরবরাহের যে লাইন, সেটাও ছোট। এর ফলে একসঙ্গে ১৫৪টি নয়, ৫০ টি কারখানা চালু হলেই পুরো সাভার তলিয়ে যাবে।
অন্যদিকে হাজারিবাগ থেকে চামড়াশিল্প সাভারে সরিয়ে নিতে ট্যানারি মালিকদের নামে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হলেও অনেকে দাবি করেছেন তারা প্লট বরাদ্দ পাননি। আর অনেকে প্লট বরাদ্দ নিয়েও এখনো ট্যানারি শিল্প গড়ে তোলেননি। কবে নাগাদ পড়ে থাকা প্লটগুলোতে কাজ শুরু হবে, তারও কোনো হদিস নেই। আর সাভারের ট্যানারির তিনবছর মেয়াদের প্রকল্পটির মেয়াদ বারবার বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু ১৩ বছরেও শেষ হয়নি পুরো কাজ।
সাভারে প্লট না পাওয়া এমন একজন হাজারীবাগের আরব ট্যানারি লিমিটেডের মালিক হাজী ইলিয়াছুর রহমান। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, প্লট দিতে তদন্ত হয়েছে। শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু নিজে বিসিককে বলেছেন প্লট বুঝিয়ে দিতে। কিন্তু দীর্ঘ দুই বছরও আমাকে ‘দেব, দেব’ করেও প্লট বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে না।
হাজী ইলিয়াছুর রহমান আরও বলেন, এছাড়া ট্যানারি সম্পর্কে শিল্প মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বিসিকের কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। হাজারীবাগ এলাকায় ২শ’টি ট্যানারি কারখানা ছিলো। এসবের মধ্যে ১৫৪টি কারখানা সাভারে জায়গা পেয়েছে। হাজারীবাগ ট্যানারি কারখানার সবক’টিকেই সাভার ট্যানারি পল্লিতে জায়গায় দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার। তবে প্লট-সংকট ও ঋণ না পাওয়ার কারণে ৪৬টি ট্যানারি সাভারে এখনও কারখানা করার অনুমতিই পায়নি। ফলে মালিকরা যেমন আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন, তেমনিভাবে এই ট্যানারি শিল্পের কর্মচারিরাও পড়েছেন দিশেহারা অবস্থায়। তারা কোথায় যাবে, কোথায় থাকবে!
সাভার চামড়াশিল্প নগর সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, যে কারখানাগুলোতে চামড়ার কাজ শুরু হয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগেরই কাজ প্রায় ৫০ শতাংশ বাকি। একমাত্র অ্যাপেক্স ট্যানারি ছাড়া সাভার চামড়াশিল্প নগরে অন্য কোনও কারখানায় শতভাগ উৎপাদন শুরু হয়নি।
সাভার চামড়াশিল্প নগরের বিসিক অফিসে এ বিষয়ে জানতে গেলে অফিস বন্ধ পাওয়া যায়। সেখানে কাউকেই পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, ২০০১ সালে দেওয়া আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী কারখানাগুলো সাভারের হরিণধরায় সরিয়ে নিতে ২০০৩ সালে তিন বছর মেয়াদী প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। তারও মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে একযুগ আগে। এরই মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে সাতবার। ১৭৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকার প্রকল্পের ব্যয় বাড়তে বাড়তে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকায়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, সাভারের চামড়াশিল্প নগরে কাজ করার মতো পর্যাপ্ত অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়নি। রাস্তাঘাট,বিদ্যুৎ,গ্যাস ও পানির সমস্যা এখনো রয়েই গেছে। এতো এতো সমস্যার মধ্যে কারখানার মালিকরা কিভাবে কাজ শুরু করবেন। তাই যত দ্রুত সম্ভব সমস্যাগুলোর সমাধান জরুরি।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১৭
এসজে/জেএম