ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

প্রাপ্য আর্থিক সুবিধাবঞ্চিত অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্তরা 

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫২৭ ঘণ্টা, মে ৮, ২০১৮
প্রাপ্য আর্থিক সুবিধাবঞ্চিত অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্তরা  প্রতীকী ছবি

ঢাকা: কুড়িল-পূর্বাচল লিংক রোডের উভয় পাশে (কুড়িল থেকে বালু নদী পর্যন্ত) ১০০ ফুট খাল খনন ও উন্নয়ন প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে আইন মানছেন না জেলা প্রশাসনের দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন ২০১৭ এবং স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল অধ্যাদেশ ১৯৮২-এর ৮(এ) ধারা লঙ্ঘন করে নির্ধারণ করা হচ্ছে অধিগ্রহণের জন্য চিহ্নিত জমির বাজারমূল্য। ওই এলাকার জায়গার দাম নির্ধারণের বিষয়ে ২০১৬ সালের ৮ আগস্ট উচ্চ আদালত যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা-ও আমলে নিচ্ছেন না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

 

ভুক্তভোগীরা বলছেন, কর্তৃপক্ষের একগুঁয়েমির ফলে অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা জমি হারিয়ে এখন ন্যায্য মূল্য থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। এ বিষয়ে গত ২৮ জানুয়ারি ঢাকার জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদন করা হলেও প্রতিকার মিলছে না।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ঢাকার জেলা প্রশাসক আবু সালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান বলেন, ‘অধিগ্রহণ হলে মানুষ কিছুটা কষ্ট পায়। সরকার যাদের জমি নিয়ে থাকে তাদের আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। ২০১৭ সালের  সর্বশেষ আইন অনুযায়ী অধিগ্রহণ এলাকার এক বছরের সব দলিল নিয়ে মূল্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। আর আগের আইনে যদি কোনো কেস (মামলা) চলমান থাকে, তাহলে তা আগের আইন অনুযায়ী নিষ্পত্তি করা হবে। এর পরও যদি কোনো ব্যক্তিবিশেষের কেস আমাদের কাছে আসে, আমরা ভুল হলে তা সংশোধন করে দেবো। ’

জানা গেছে, স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল অধ্যাদেশ ১৯৮২-এর ৮(এ) ধারা মতে, ‘The deputy commissioner shall take into account the average value, to be calculated in the prescribed manner of the properties of simillar description and with similar advantages in the vicinity during the twelve months preceding the date of publication of the notice under section 3.’ তবে এ বিধান মেনে বাজারমূল্য নির্ধারণ করা হচ্ছে না।

এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট এলাকার জায়গার দাম নির্ধারণ বিষয়ে ২০১৬ সালের ৮ আগস্ট উচ্চ আদালতের দেওয়া নির্দেশে বলা হয়েছে, ‘As to why the respondent shall not be directed to access compensation in L/A Case no. 20/2015-16 pending before the respondent in compliance of section 8 of the Acquisition and Requisition of immovable property ordinance. 1982 read with immovable property acquisition manual, 1997 on taking consideration amongst others, the actual market value & natures/class of the property and the advantages such as adjacent 300 feet Kuril-Purbachal road.’ উচ্চ আদালতের ওই আদেশও আমলে নেওয়া হচ্ছে না।

জেলা প্রশাসকের কাছে ভুক্তভোগীদের করা আবেদনে বলা হয়েছে, এল এ কেস নং ২০/২০১৫-১৬-এর মাধ্যমে কুড়িল-পূর্বাচল লিংক রোডের উভয় পাশে (কুড়িল হতে বালু নদী পর্যন্ত) ১০০ ফুট খালখনন ও উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য জোয়ারসাহারা, বরুয়া, ডুমনি ও মস্তুল মৌজায় ব্যক্তিমালিকানাধীন ও খাস জমিসহ মোট ৯০ দশমিক ১৫৪৯ একর জমি অধিগ্রহণ করার প্রক্রিয়া চলছে। এতে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল অধ্যাদেশ, ১৯৮২-এর ৩ ধারার নোটিশ জারির পূর্ববর্তী এক বছরের চারটি মৌজার সাফকবলা দলিলের তথ্য সংগ্রহ করে অবাস্তব বাজারমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।  

অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাবিত জমির পারিপার্শ্বিক এলাকার সমশ্রেণি ও সমসুবিধাযুক্ত (ভিসিনিটি) প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকার জমির প্রকৃত বাজারমূল্য বিবেচনায় না নিয়ে প্রস্তুত করা হয়েছিল। এটি স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল অধ্যাদেশ, ১৯৮২-এর ৮(এ) ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাবিত জমির পারিপার্শ্বিক এলাকার সমশ্রেণি ও সমসুবিধাযুক্ত (ভিসিনিটি) এলাকার জমির প্রকৃত বাজারমূল্য বিবেচনায় না নিয়ে এবং ভূমি অধিগ্রহণ অধ্যাদেশ, ১৯৮২-এর ৮(এ) ধারা ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা আমলে না নিয়ে সব মৌজার বিস্তীর্ণ এলাকার (জোয়ারসাহারা মৌজায় প্রায় ৩০০ ফুট থেকে তিন কিলোমিটার দূরের ভূমিরও) গড় মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।  

যেহেতু ৩০০ ফুট রোডটি প্রায় ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ, তাই ওই রাস্তার গুরুত্ব বিবেচনা করে খুব কাছের জমিগুলোর গড় মূল্য নির্ধারণ করা হলে আইন অনুযায়ী প্রকৃত মূল্য নির্ধারিত হবে। বর্তমানে যে নিয়মে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে এতে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকরা কোনো কোনো মৌজায় প্রকৃত মূল্যের অর্ধেকেরও কম এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০ শতাংশের ১ শতাংশ মূল্যও পাবে না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৩০০ ফুট রাস্তার পাশের জমি এখন অনেক মূল্যবান। রাজউকের পূর্বাচল উপশহর হওয়ায় সেখানে জমির বাজারদর দেশের যেকোনো স্থানের চেয়ে অনেক বেশি। ডুমনি, বড়ুয়া, মাস্তুল ও জোয়ারসাহারা মৌজার কুড়িল-পূর্বাচল ৩০০ ফুট সড়কের সমান্তরালে অবস্থিত একই এলাইনম্যান্ট ও সমসুবিধাযুক্ত জমি। ওই জমিতে সব ধরনের ইউটিলিটি সুবিধা থাকায় বাণিজ্যিক ও আবাসিক চাহিদাও ব্যপক। তাই এই চার মৌজায় অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাবিত ভিটি/বাড়ি শ্রেণির জমির প্রকৃত মূল্য দেড় কোটি থেকে দুই কোটি টাকা।  

বরুয়া মৌজায় খাল প্রকল্পভুক্ত স্থানে ডোবা-নালা প্রকৃতির প্রতি শতাংশ জায়গার দাম এক লাখ ৯৩ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ বাস্তবে সেখানে প্রতি শতাংশ জমির দাম এক কোটি টাকারও বেশি। ডুমনি মৌজাভুক্ত স্থানে ডোবা শ্রেণির প্রতি শতাংশ জায়গা এক লাখ ৮৩ হাজার টাকা হারে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হচ্ছে। বাস্তবে সেখানে জমির বর্তমান বাজারমূল্য ৫০ গুণেরও বেশি।  

৩০০ ফুট রাস্তার উভয় পাশে দুই বছর আগেও প্রতি কাঠা জমি  দেড় থেকে দুই কোটি টাকায় কেনাবেচা হয়েছে। এখন দাম আরো বেড়েছে। তিন-চার বছর আগে প্রতি কাঠা জমি দেড়-দুই কোটি টাকায় কেনাবেচা হলেও সেসব জমি অধিগ্রহণকালে দাম দেড়-দুই লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

২০১৬ সালের ৬ আগস্ট ওই এলাকার জায়গার যে দাম নির্ধারণ করা হয় তা ক্ষতিপূরণ বাবদ দেওয়ার জন্য হাইকোর্ট এক রায় দেন। ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সেই রায়ও সুস্পষ্টভাবে অমান্য করা হয়েছে। এটি অনেকটাই আদালত অবমাননার শামিল। এল এ কেস ২০/২০১৫-১৬ এর ক্ষতিগ্রস্ত জমি মালিকদের দায়ের করা রিট আবেদনের (নম্বর ৯৭৫৯/২০১৬, ৯৭৬০/২০১৫-১৬) পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া রায়ে অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাবিত জমির প্রকৃত বাজারমূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে জমির পারিপার্শ্বিক এলাকার (ভিসিনিটি) সমশ্রেণি ও সম সুবিধার বিষয়গুলো বিবোচনা নেওয়ার নির্দেশ রয়েছে।

আদালতের আদেশে বলা হয়, ঢাকা জেলা প্রশাসক স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল অধ্যাদেশ, ১৯৮২-এর ৮(এ) ধারা এবং স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ অধ্যাদেশ, ১৯৯৭-এর সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী বাজারমূল্য ও ভিসিনিটি নির্ধারণ করতে হবে। এ ছাড়া সর্বশেষ স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন, ২০১৭ অনুযায়ী বাজারমূল্যের ওপর অতিরিক্ত ২০০ ভাগ যোগ করে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে।  

কিন্তু কুড়িল-পূর্বাচল লিংক রোডের উভয় পাশে (কুড়িল হতে বালু নদী পর্যন্ত) ১০০ ফুট খালখনন ও উন্নয়ন প্রকল্পে জমির ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অধিগ্রহণের শিকার ক্ষতিগ্রস্তরা।

বাংলাদেশ সময়: ১১২০ ঘণ্টা, মে ০৮, ২০১৮
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।