সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনের পর চার কারণে বেড়েছে চালের দাম। এগুলো হচ্ছে- সরবরাহে সমস্যা, ধানের দাম বাড়া, খুচরা পর্যায়ে মনিটরিং না করা ও অসাধু সিন্ডিকেটের কারসাজি।
বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, নির্বাচনের আগে সরকারের পক্ষ থেকে বাজারে কঠোর তদারকি থাকায় ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াতে পারেনি। ফলে নির্বাচনের পর তদারকিতে ঘাটকির সুযোগ বুঝে হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছে অসাধু সিন্ডিকেট। তাদের কারসাজির কারণে ধানের বাম্পার ফলনের পরও ভরা মৌসুমে বেড়েছে চালের দাম।
৫০ কেজির বস্তায় চালের দাম বেড়েছে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। সে হিসাবে, নতুন বছরে চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ২ থেকে ৬ টাকা। ফলে উৎপাদন ভালো হওয়ার পরও চালের দাম বেশি হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ।
এদিকে দাম বাড়ানোর জন্য মিলমালিকরা দুষছেন আড়তদার-ব্যবসায়ীদের। আর ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাস্তায় চালের ট্রাকে চাঁদাবাজি ও খুচরা বিক্রেতাদের সরকার মনিটরিং না করায় চালের বাজারের এই অবস্থা।
তবে পাইকারি ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, মিল থেকে বেশি দাম কিনতে হয় তাই বেচতেও হচ্ছে বেশি দামে। অন্যদিকে বাজারে ধানের সঙ্কট থাকায় এর প্রভাব পড়েছে চালের বাজারে পড়েছে বলে জানিয়েছেন মিলমালিকরা।
এ অবস্থায় আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। বৈঠকে মিলমালিকসহ চালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্যরাও ছিলেন। বৈঠকে নতুন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার চালের সরবরাহ বাড়াতে মিল মালিকদের নির্দেশ দেন।
আর অযৌক্তিক কারণে চালের দাম না বাড়াতে ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানান বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।
এছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও বাজার মনিটরিং জোরদারের কথা জানানো হয়েছে। সরকারের এসব উদ্যোগে আগামী সপ্তাহের মধ্যে চালের দাম কমতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শনিবার বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বছরের দ্বিতীয়দিন অর্থাৎ ২ জানুয়ারি থেকে চালের দাম বাড়া শুরু হয়। বর্তমানে খুচরা পর্যায়ে ভালোমানের মিনিকেট চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫৪ থেকে ৫৮ টাকা; যা নির্বাচনের আগে ছিলো ৫০ থেকে ৫২ টাকা। সে হিসেবে মিনিকেট চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৪ থেকে ৬ টাকা। তবে সব থেকে বেশি বেড়েছে মাঝারি মানের চালের দাম।
বর্তমানে মাঝারিমানের চাল বিআর-২৮ ও লতা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৪ থেকে ৪৮ টাকা কেজি; যা আগে ছিলো ৩৮ থেকে ৪২ টাকা। অর্থাৎ নতুন বছরে মাঝারিমানের চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৬ টাকা। নির্বাচনের আগে ৩৪ থেকে ৩৬ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া মোটা চালের দাম বেড়ে হয়েছে ৩৮ থেকে ৪০ টাকা। এ হিসাবে মোটা চালের দাম ৪ টাকা কেজিতে বেড়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, নতুন করে মজুদ শুরুর আগে সরকারি গুদামে চাল ও গমসহ ১২ লাখ ১৮ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য মজুদ ছিলো। যার মধ্যে ৯ লাখ ৬৮ হাজার মেট্রিক টন ছিলো চাল। এছাড়া চাল আমদানিতে শুল্ক হার বাড়ার কারণে হিলি স্থলবন্দর দিয়ে চাল আমদানি অনেক কমেছে।
১ জানুয়ারি ২৭টি ট্রাকে ৬৭৫ টন চাল, ২ জানুয়ারি ১৯টি ট্রাকে ৪৭৫ টন চাল, ৩ জানুয়ারি ১২টি ট্রাকে ৩০০ টন চাল আমদানি হয়েছে। এভাবে গত তিনদিনে স্থলবন্দর দিয়ে ১ হাজার ৪৫০ টন চাল আমদানি হয়েছে।
এ বিষয়ে বাবুবাজার আড়তদার সরকার ট্রেডিং এজেন্সির স্বত্ত্বাধিকারী হাজী ইব্রাহিম বাংলানিউজকে জানান, কয়েকদিন ধরেই চালের দাম বাড়তি। প্রথমে রশিদের চালের দাম বেড়েছে। এরপর একে একে সব কোম্পানি চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। নির্বাচনের আগে ৫০ কেজির এক বস্তা মিনিকেট চাল বিক্রি করেছি ২৬০০ থেকে ২৬৫০ টাকা। এখন সেই চাল ২৭৫০ টাকা বিক্রি করতে হচ্ছে। ১৯৫০ টাকা বিক্রি করা বিআর-২৮ চালের বস্তা এখন বিক্রি করতে হচ্ছে ২২৫০ টাকা। এভাবে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে।
‘হঠাৎ কী কারণে যে চালের দাম এমন বাড়লো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার মনে হয় মিল মালিকরা সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ নির্বাচনের সময় সরকারের নজরদারি কম ছিলো এই সুযোগ তারা নিয়েছে।
চালের দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে বাদামতলী চাল ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সেক্রেটারি নিজাম উদ্দিন আহমেদ জানান, এখন চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। এটা অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হয়েছে। এখন দেশে কোনো বন্যা, খরা, বৃষ্টি কিছুই হয়নি। সরবরাহও স্বাভাবিক রয়েছে। তাহলে কেন চালের দাম বাড়বে। চালের দাম বাড়ার যদি কোনো কারণ থাকে তাহলো সিন্ডিকেট। মিল মালিকেরা সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই নির্বাচনের পর রশিদের চালের দাম বস্তায় বাড়ানো হয়েছে ৩০০ টাকা। দেশে কি এমন ঘটল যে হঠাৎ করে চালের দাম এমন বাড়িয়ে দিতে হবে। মূলত নির্বাচনের পর সরকারকে চাপে ফেলতে মিল মালিকরা জোট হয়ে এ কাজ করেছে। তবে চালের দাম স্বাভাবিক করতে হলে মিল মালিকদের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। সেই সঙ্গে বাজারে নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে।
বাবু বাজারের চাল ব্যাবসায়ী মেসার্স দয়াল ভাণ্ডারের আবু সাঈদ বাংলানিউজকে বলেন, সারাদেশে চালের দাম বেড়েছে। বিশেষ করে দিনাজপুর, নওগাঁ ও কুষ্টিয়ার মোকামে চালের দাম বেশি। মিলমালিকরা বাড়তি দামে চাল বিক্রি করছেন। এর কারণে পাইকারিতেও দাম বেড়েছে। এতে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়াই স্বাভাবিক।
তিনি বলেন, নির্বাচনের পরপরই মিলাররা চালের দাম বাড়ানোর অপচেষ্টা চালাতে থাকে। সেই অপচেষ্টায় তারা সফল, আর এ কারণেই দাম বেশি।
খুচরা পর্যায়ে চাল মজুদের কোনো সুযোগ নেই দাবি করে এই ব্যবসায়ী বলেন, সপ্তায় সপ্তায় চাল এনে তাদের বিক্রি করতে হয়। এছাড়া মূলধনও সামান্য। নির্বাচনের আগে বেশ কয়েক মাস চাল নিয়ে কেউ দাম বাড়ানোর সুযোগ পায়নি। সে সময় বাজার মনিটরিং ব্যবস্থাও কঠোর ছিলো।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং ওনার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও রশিদ অ্যাগ্রো ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের মালিক মো. আব্দুর রশিদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী বলেন, চালের দাম মূলত ধানের দামের সঙ্গে বাড়ে কমে। কিছুদিন আগে ধানের দাম বাড়ায় চালেল দাম বেড়েছে। তবে মোট চালের দাম সরকারের বেঁধে দেওয়া দামেই বিক্রি হচ্ছে। কোনো জেলাতেই মোটা চালের কেজি ৩৬ টাকা পার হয়নি।
ঢাকায় কেন ৪০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে এটা সরকারের খোঁজ নেওয়া উচিত বলেও মনে করেন তিনি।
কেএম লায়েক আরও বলেন, দাম কমানোর বিষয়ে আমরা সভায় বসবো। আর তিন মাস পর নতুন চাল বাজারে এলে দাম অটোমেটিক কমে আসবে।
এর আগে ২০১৭ সালের মাঝামাঝি থেকে কয়েক মাস ধরেই চালের দাম বাড়ছিলো। ওই বছর এপ্রিলে আগাম বন্যায় হাওরের কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে চালের দাম বাড়তে শুরু করে। সে সময় সরু চালের দাম খুচরায় কেজি প্রতি ৭০ টাকা পর্যন্ত বাড়ে; সমানতালে বাড়ে মোটা চালের দামও। পরে নতুন ধান ওঠায় চালের দাম কমে আসে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০১৯
জিসিজি/এমএ