চট্টগ্রাম: কাপড়, প্লাস্টিক দানার মতো প্রচ্ছন্ন রফতানির বন্ডে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা বিভিন্ন ধরনের কাগজ চট্টগ্রামের খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নজরদারির কথা বলে এলেও এই কালোবাজারি বন্ধ করা যাচ্ছে না।
চট্টগ্রাম নগরের আন্দরকিল্লার পাইকারি কাগজের বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এক শ্রেণীর অসাধু আমদানিকারক বন্ড সুবিধায় চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা কাগজ খোলা বাজারে বিক্রি করছে। মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি, শুল্ক ফাঁকি, পণ্য খালাস ও খোলাবাজারে পাচার করার কাজটি সুকৌশলে করছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কাগজ ব্যবসায়ী বলেন, চট্টগ্রামের ইপিজেড, কালুরঘাটসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে হাতবদল হয়ে বন্ডের কিছু কাগজ বাজারজাত হচ্ছে। অনেক সময় রফতানির জন্য চাহিদার চেয়ে কিছু বেশি কাগজ এনে সেগুলো বাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়। বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে চালিয়ে যাওয়া এই জমজমাট কালোবাজারিটা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ঢাকা থেকে। চট্টগ্রামে হাতেগোনা কয়েকজন আমদানিকারক থাকলেও এক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা বেশি নয়।
আরেকজন ব্যবসায়ী বলেন, দেশে ভালো মানের অনেক কাগজ তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। শিক্ষার্থীদের লেখার খাতা, পরীক্ষা গ্রহণ, বই-পোস্টার ছাপানোসহ কাগজের বড় অংশের জোগান আসছে দেশি কারখানা থেকে। কিন্তু বন্ডের কাগজ খোলাবাজারে ছড়িয়ে অস্থিরতা তৈরি করা হয়েছে।
দেশের সবচেয়ে বড় রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কাগজ আমদানির শুল্কায়ন হয় ‘সেকশন-৩’ বিভাগে। আবার বন্ড সুবিধায় শতভাগ রফতানির শর্তে এবং প্রচ্ছন্ন রফতানির শর্তে আমদানি করা কাগজের শুল্কায়ন হয় ‘সেকশন-৮ (সি ও ডি) দিয়ে।
এসব বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বিদেশ থেকে পেপার মিলের কাঁচামাল (মণ্ড) তৈরির জন্য ওয়েস্ট পেপার, পাল্প, লাইট ওয়েটেড পেপার, পেপার অ্যান্ড পেপার বোর্ড, ডুপ্লেক্স পেপার, সংবাদপত্রের জন্য নিউজপ্রিন্ট ইত্যাদি সেকশন-৩ দিয়ে আমদানি হয়। চীন, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে (এইচএস কোড: 4801.00.00 থেকে 4823.90.99) এসব কাগজ আমদানি হয়ে থাকে। এর বাইরে বন্ড সুবিধার আওতায় রফতানিমুখী প্যাকেজিং শিল্পের জন্য বিভিন্ন ধরনের পেপার বোর্ড, আর্ট কার্ড, ডুপ্লেক্স বোর্ড ইত্যাদি আমদানি করা হয়।
আরও পড়তে পারেন: বন্ডেড পণ্য কালোবাজারে, অসাধু চক্রকে রুখবে কে?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, সারাদেশে প্রতিটি এইচএস কোডের বিপরীতে কী পরিমাণ পণ্য আমদানি হয় তা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সফটওয়্যারে সংরক্ষিত থাকে।
যদিও বন্ডের অনিয়ম বন্ধে তিনটি সুপারিশ করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়, বন্ডেড ওয়্যারহাউস ব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয় বা অটোমেশন না হওয়ায় দেশীয় শিল্প হুমকির মুখে পড়ছে। এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী ও কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারী বন্ডের অব্যবস্থাপনা ও অস্বচ্ছতার সুযোগ নিচ্ছেন। এতে বন্ডের কার্যক্রমকে শুধু প্রশ্নবিদ্ধ নয়, বরং রাজস্ব ফাঁকি ও দেশীয় শিল্পকে হুমকির সম্মুখীন করছেন।
গত বছরের ২৬ জুলাই এনবিআর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার কাছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-১২ মোহাম্মদ মমিনুর রহমান স্বাক্ষরিত ওই বিশেষ প্রতিবেদনে দেশীয় শিল্পের গুরুত্ব তুলে ধরে বলা হয়, বন্ড কার্যক্রম স্থানীয় শিল্প বিকাশের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। সরকার এ লক্ষ্যে বন্ডেড ওয়্যারহাউসের মাধ্যমে সর্বোচ্চ সুবিধা দিয়ে থাকে। স্থানীয় বাজারে অবৈধভাবে শুল্কমুক্ত পণ্য প্রবেশের মাধ্যমে অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হচ্ছে, যা স্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে হুমকির মুখে ফেলছে এবং বেসরকারি রাজস্বের বিপুল পরিমাণ ক্ষতি করছে। ম্যানুয়াল কার্যক্রমে অদক্ষতার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ধরে রাখা কঠিন হবে। এতে রপ্তানিমুখী ব্যবসার খরচ ক্রমাগত বাড়বে। কিন্তু বন্ডের কাঁচামালের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে রপ্তানি প্রক্রিয়া এগিয়ে যাবে। স্থানীয় বাজারে অবৈধভাবে শুল্কমুক্ত পণ্য প্রবেশ বন্ধ করা সম্ভব হবে।
যোগাযোগ করলে হাউসের যুগ্ম-কমিশনার নাহিদ নওশাদ মুকুল বাংলানিউজকে বলেন, বন্ড সুবিধার চালানে রাজস্ব নেই বললেই চলে। কাস্টম হাউস শুধু সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে বন্ড কমিশনারেটের নির্ধারিত প্রাপ্যতা, ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র, ঘোষণা অনুযায়ী পণ্য এসেছে কিনা ইত্যাদি পরীক্ষা করে থাকে।
বন্ড কমিশনারেট চট্টগ্রামের কমিশনার মো. আজিজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, বন্ড সুবিধায় আমদানি করা ফেব্রিক্স, প্লাস্টিক দানা বেশি পাচার হতো। কাগজ তুলনামূলক কম পাচার হয়। আমাদের কঠোর নজরদারির কারণে চট্টগ্রামে বন্ডের পণ্য খোলাবাজারে পাচার বন্ধই বলা চলে। এ শহরটা ঢাকা, সাভারসহ আশপাশের তুলনায় ছোট হওয়ায় এবং একটিমাত্র প্রধান সড়ক থাকায় দুই ঘণ্টায় যেকোনো জায়গায় অভিযান চালাতে পারি আমরা। দরকার শুধু সঠিক তথ্য।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, একসময় চট্টগ্রামে প্রচুর তৈরি পোশাক কারখানা ছিল। দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৬ শতাংশে। স্বাভাবিকভাবে বন্ড সুবিধার পণ্য আমদানিও কমছে। তবে দেশের অন্য কোনো স্থান থেকে যেকোনো পণ্য চট্টগ্রামের স্থানীয় বাজারে ঢুকতে পারে। বিষয়টিও আমাদের নজরদারিতে থাকবে।
দেশে বর্তমানে ৬ হাজার ৫৬৫টি প্রতিষ্ঠানের নামে বন্ড লাইসেন্স থাকলেও অনিয়মের কারণে ১ হাজার ৭৫৭ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করেছে কাস্টমস। আবার কারখানা বন্ধ থাকার পরও বন্ড লাইসেন্স আছে ২৪৩৮টি পোশাক ও প্যাকেজিং কারখানার। চট্টগ্রামে ২০৫টি এক্সেসরিজ রফতানির প্রতিষ্ঠান বন্ড সুবিধা পায়। এর মধ্যে অর্ধেক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরনের বোর্ড, আর্ট পেপার, ডুপ্লেক্স বোর্ড আমদানি করে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৯ ঘণ্টা, মার্চ ১৪, ২০১৮
এআর/এইচএ/টিসি