ঢাকা, রবিবার, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

বৈশাখী মেলায় রং ছড়াবে ‘শখের হাঁড়ি’

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১০ ঘণ্টা, এপ্রিল ৮, ২০১৯
বৈশাখী মেলায় রং ছড়াবে ‘শখের হাঁড়ি’

রাজশাহী: আর মাত্র ক'দিন বাদেই বাংলা আর বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। বঙ্গাব্দের প্রথম দিন, বাংলা নববর্ষ। তবে পহেলা বৈশাখ উদযাপন এখন কেবল বাংলাদেশের নয়, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে সার্বজনীন এ উৎসব ছড়িয়ে পড়েছে সারাবিশ্বে। 

বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস আর প্রাণের স্পন্দনে বিশেষ এ দিনটিকে বরণ করবেন বাঙালিরা। শতভাগ বাঙালিয়ানা ফুটে উঠবে প্রতিটি আচার-অনুষ্ঠানেই।

বৈশাখী সেই উৎসব আরও রঙিন করতেই রাজশাহীতে তৈরি হচ্ছে 'শখের হাঁড়ি'।  

হ্যাঁ, ঢাকার বৈশাখী মেলাতেই রং ছড়াবে রাজশাহীর মৃৎশিল্পী সুশান্ত কুমার পালের শখের হাঁড়ি। প্লাস্টিক, সিরামিক, ধাতব, কাচ ও মেলামাইনের প্রচলনে মাটির তৈরি তৈজসপত্রের চাহিদা এবং ব্যবহার কমেছে ঠিকই। কিন্তু আজও 'শখের হাঁড়ি'র আবেদন একেবারে ফুরিয়ে যায়নি।  ছোট ছোট হাঁড়ি তৈরি করা হচ্ছে।  ছবি: বাংলানিউজএকটা সময় ছিল যখন শিল্পোপকরণের মধ্যে গ্রামবাংলার মানুষের জীবনসম্পৃক্ত শৌখিন 'শখের হাঁড়ি' ছিল অন্যতম। তাই এর রং ও নকশার শৈল্পিকতায় আবহমান বাংলার জীববৈচিত্র্যের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে আজও।  

এজন্য শখের হাঁড়িকে বাঙালি মানসের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের স্মারক বললেও ভুল হবে না। নিছক ব্যবহারিক উপকরণ বা শখের বহিঃপ্রকাশ নয়, ক্ষেত্রবিশেষ উৎসবের ধারকও বটে। আর এই চেতনাকে ধারণ করেই হয়তো বছরের পর বছর ধরে শত কষ্টেও মৃৎশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার অদম্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সুশান্ত কুমার পাল।  

মৃৎশিল্পী সুশান্ত কুমার পালের বয়স বর্তমানে ৬১ বছর। এই শিল্পীর পরিচিতি দেশজুড়ে। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া এই পেশায় জীবনটা কটিয়ে দিচ্ছেন। বংশ পরম্পরায় এই দীক্ষায় দীক্ষিত করেছেন পরবর্তী প্রজন্মকেও। বর্তমানে তার দুই ছেলে ও এক মেয়েও একই পেশায় নিজেদের সপে দিয়েছেন৷ 
রঙের তুলির শেষ আঁচড় কাটা হচ্ছে নানা আকৃতির পাকা শখের হাঁড়িতে।  ছবি: বাংলানিউজতাই বৈশাখ সামনে রেখে এখন রাজ্যের ব্যস্ততা ভর করেছে সুশান্ত কুমার পালের বাড়িতে৷ দিন-রাত সমানতালে চলছে শখের হাঁড়ি বানানোর কাজ৷ হাতে সময় কম, তাই কোনোভাবেই সময় নষ্ট করতে চান না তারা। চলছে শেষ সময়ের কর্মব্যস্ততা।

রাজশাহীর পবা উপজেলার বসন্তপুর এলাকার মৃৎশিল্পী সুশান্ত কুমার পালের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, ছোট ছোট হাঁড়ি তৈরি করছেন সবাই। কেউ হাঁড়ি তৈরি করছেন, কেউ তা রোদে শুকোতে দিচ্ছেন, কেউবা আবার রঙের তুলির শেষ আঁচড় কাটছেন নানা আকৃতির পাকা শখের হাঁড়িতে।

মৃৎশিল্পী সুশান্ত কুমার পালের বড় ছেলে সঞ্জয় কুমার পাল জানান, তার বাবা ও মা মমতা রাণী পাল গত চারমাস থেকে ঢাকার সোনারগাঁয়ে আছেন। এবারও সোনারগাঁ জাদুঘর চত্বর, বাংলা একাডেমি চত্বর, চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র চত্বরের বৈশাখী মেলায় তাদের স্টল থাকবে।

বাবা-মা ঢাকায় থেকে তারই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আর এখানে তারা দুই ভাই এবং তাদের স্ত্রী-সন্তানরা শখের হাঁড়ি তৈরি করছেন। এরই মধ্যে প্রথম চালান চলে গেছে। আগামী সোমবার (৮ এপ্রিল) দ্বিতীয় চালান যাওয়ার কথা রয়েছে তাদের।  

বাবা-মায়ের ঢাকায় আর তারা রাজশাহীতে বাংলা নববর্ষের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন জানিয়ে সঞ্জয় জানান, বাপ দাদার পেশাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন তারা। তার স্ত্রী মুক্তি রানি পাল, ছোটভাই মৃত্যুঞ্জয় কুমার পাল ও তার স্ত্রী করুণা রানি পাল এবং ছোট বোন সুচিত্রা রানি পালও এ পেশায় নিয়োজিত। এছাড়া তাদের সম্তানরাও এখন শখের হাঁড়ি তৈরির কারিগর। বাবা সুশান্তের অভাব-অনটনে লেখা-পড়া করা হয়নি তদের তিন ভাই-বোনের। হাতের কাজই শিখছেন। কাজের দক্ষতা দিয়েই গোটা পরিবার কর্ম করে খাচ্ছেন।  ছোট ছোট হাঁড়িতে রঙের তুলির শেষ আঁচড় দেওয়া হচ্ছে।  ছবি: বাংলানিউজজানতে চাইলে সঞ্জয় ও মৃত্যুঞ্জয় কুমার পাল জানান, তাদের তৈরি শখের হাঁড়ি ধর্মীয় আচার ও শাস্ত্রীয় নানা আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গেও যুক্ত। তাই সমাজ-সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় উৎসব-অনুষ্ঠানের আমূল পরিবর্তন সত্ত্বেও এর নান্দনিক উপযোগিতা দিন দিন বাড়ছে৷ শখের হাঁড়ির পুরনো সেই ঐতিহ্য এই বাংলা নববর্ষে আরও তাজা হয়ে ওঠে।  

তবে সারা বছর জুড়েই মাটির জিনিস তৈরির কাজ করেন তারা। কেবল চৈত্র মাসে এই ব্যস্ততা বাড়ে। বৈশাখী মেলায় স্টল দেওয়ায় একমাস আগে থেকে তাদের বাড়তি শ্রম দিতে হয়। মেলার স্টলগুলোতে শখের হাঁড়ি ছাড়াও তাদের হাতের তৈরি পাখি, মাটির ঝুড়ি, ছোট কলস, বাটি, থালা, বাটিসহ অন্তত ১০ রকমের মাটির জিনিসপত্র থাকবে। ১১ এপ্রিল তাদের শেষ চালান পাঠানো হবে ঢাকায়। এবার ভালো বেচাকেনার প্রত্যাশা রয়েছে তাদের।

বাবা সুশান্ত কুমার পালের কথা তুলতে সঞ্জয় জানান, শখের হাঁড়ির জন্য তার বাবাকে অনেকেই এখন এক নামে চেনেন। মৃৎশিল্পে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ কারুশিল্প পরিষদ, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন, জাতীয় জাদুঘর, কারিকা বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনসহ (বিসিক) সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অন্তত ২৫টি সনদ কুড়িয়েছেন এই কারিগর। পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় স্বর্ণপদকও।  
ছোট ছোট হাঁড়িতে রঙের তুলির শেষ আঁচড় দেওয়া হচ্ছে।  ছবি: বাংলানিউজএই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় তাদের মা মমতা রানি এখন মাঝে-মধ্যেই মৃৎশিল্পীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ করেন। অর্জন করেছেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সম্মাননা। ১৯৯৯ সালে বিসিকের শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৩ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত কারুশিল্পের প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।  

জাপানে সেবার ৪০ দিন ধরে তার শখের হাঁড়ি প্রদর্শনী চলেছিল। এছাড়া তার বাবা সুশান্ত কুমার পালের শখের হাঁড়ি নিয়ে এবছর বাংলা একাডেমি বই বের করেছে। সরকারি সহায়তা পেলে এই শিল্পকে তাদের জীবদ্দশায় ধরে রাখতে পারবেন বলেও জানান সঞ্জয় কুমার পাল।

বাংলাদেশ সময়: ১০৪৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৮, ২০১৯
এসএস/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।